লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক
০৮ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম
পবিত্র কাবা মুমিনের হৃদয় স্পন্দন। আবেগ ও অনুভূতির সর্বোচ্চ স্থান। তাই প্রতিটি মুমিন কাবার আঙ্গিনায় হাজির হওয়ার বাসনা পোষণ করে। বুকভরা ভালোবাসা আর আবেগঘন কন্ঠে প্রিয় নবীজীর রওজায় সালাম জানানোর সুযোগ সব মুমিনেরই লালিত স্বপ্ন। সাফা-মারওয়ার দৌড়ানো আর আরাফায় হাজিরা দেয়া বহুকালের মনের কামনা-বাসনা। পবিত্র ভূমির ধূলি গায়ে মাখতে সবার মন চায়। ইসলামের মূল পাঁচটি খুঁটির একটি হলো হজ। হজ অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ্জ মাসের নির্দিষ্ট তারিখে পবিত্র কাবা ঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ি, আরাফা মাঠ-মিনা-মুজদালিফায় অবস্থানসহ নির্ধারিত নিয়মে আনুষঙ্গিক ইবাদতসমূহ পালন করাকে হজ বলে।
হজ আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশের এক অনুপম বিধান। হজে রয়েছে নিখাঁদ আল্লাহ প্রেম। এই ইবাদতে একদিকে যেমন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন ফুটে ওঠে। অপরদিকে আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। হজ হলো অভিশপ্ত প্রথার বিরুদ্ধে বিশ্বজনীন এক ঈমানী জাগরণ। এখানে এসে এক হয়ে যায় শত কোটি মুসলিম। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ভাষা-বর্ণের ব্যবধান। বিলীন হয়ে যায় ভৌগোলিক সীমা-রেখার বিভেদ-প্রাচীর। স্বজাতীয় পোশাক ছেড়ে ধারণ করে ইহরামের শুভ্র একক ইসলামী পোশাক। লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত হয় লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। এখানে নেই ধনী-গরিব, মনিব-গোলামের কোনো প্রভেদ। নেই শাসকের প্রভূত্বসুলভ অহঙ্কার। নেই শাসিতের হীনমন্যতা। ভাষা-বর্ণ ছাপিয়ে সর্বত্র ভেসে উঠে সর্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মনোরম এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।
এ যেন আখেরাতের এক সফর : হজের সফরে ফুটে উঠে আখেরাত সফরের বিশেষ নিদর্শনাবলী। কেননা মানুষ যখন হজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়, তখন আত্মীয়স্বজন, বাড়িঘর, বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করে সে যেন পরকালের সফরে বের হয়। মৃত্যুর সময় যেমন বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করতে হয়, অনুরূপভাবে হজের সময়ও এ জাতীয় সবকিছু বর্জন করতে হয়। যানবাহনে আরোহণ, হাজিকে খাটিয়ায় সওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহরামের দুই টুকরো শ্বেতশুভ্র কাপড় হাজীদের মনে কাফনের কাপড়ের কথা জাগরূক করে দেয়। ইহরামের পর লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলা কিয়ামতের দিন আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সমতুল্য। সাফা মারওয়া সায়ী, হাশরের ময়দানে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করার মতো। আরাফার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অবস্থান, হাশরের ময়দানের জড়ো হওয়ার নমুনা বলে দেয়। সূর্যের প্রচন্ড খড়তাপের মধ্যে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় এ ময়দানে। এক কথায় হজের প্রতিটি আমল থেকেই আখেরাতের কথা ভেসে ওঠে হজীমনে। হজ্বের সূচনাতেই হজ্বযাত্রী নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার শপথ নেন। বংশ-গৌরব, সম্পদের গৌরব ও পদমর্যাদার গৌরবসহ সমস্ত পার্থিব আকর্ষণ ভুলে গিয়ে হজ্বযাত্রী পরিধান করেন শুভ্র সাদা কাফনের কাপড়। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষই যে সমান এবং শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি যে একমাত্র খোদাভীরুতা হজ্বযাত্রীদের সবার পোশাক তারই বার্তা বহন করেএটাই হলো হজের প্রধানতম তাৎপর্য ও রহস্য।
উত্তম আমল হজ : আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমল শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলকে বিশ্বাস করা। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলকে বিশ্বাস করা। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ-সংগ্রাম করা। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, কবুল হজ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯১৫১)। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহ, এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটছে, তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন কিছু নয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩)। আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করেছে এবং তাতে অশ্লীল কথা বলেনি, অশ্লীল কাজ করেনি; সে হজ থেকে ফিরবে সে দিনের মতো, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫২১)। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত আরো একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক ওমরাহ থেকে অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের জন্য কাফফারাস্বরূপ এবং কবুল করা হজের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন কিছু নয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিয়মিত হজ ও ওমরাহ করো। কেননা, এগুলো দারিদ্র্য ও গোনাহ দূর করে, যেভাবে হাপর লোহা এবং সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। কবুল করা হজের সওয়াব জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়। (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৩৮১৪)। আবু উমামা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, বলেছেন, যাকে শক্ত অভাব অথবা অত্যাচারী শাসক গুরুতর রোগ বাধা দেয়নি, অথচ সে হজ না করে মারা যায়, মরুক সে যদি চায় ইহুদি আর যদি চায় খ্রিস্টান হয়ে। (সুনানে দারেমি)। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হজ ও ওমরাহকারীরা হচ্ছে আল্লাহর অতিথি। অতএব তারা যদি তার কাছে দোয়া করে তিনি তা কবুল করেন এবং যদি তারা তার কাছে ক্ষমা চান তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ)
হজ না করার পরিণাম : যদি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও হজ না করে। প্রভুর প্রেমের আহ্বানে সাড়া না দেয়। তাহলে তার জন্য রয়েছে বড় ভীতিপ্রদ সতর্কবাণী। হজ করা থেকে বিরত থাকা ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মাদারিতে থাকে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হাদিসে এসেছে- হযরত আলী রা: বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার (খরচ বহনের) মতো সম্বল (ধন-সম্পদ) ও বাহনের অধিকারী হওয়ার পরও যদি হজ না করে তবে সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে মারা যাক তাতে (আল্লাহর) কোনো ভাবনা নেই (তিরমিজি)। সুতরাং সামর্থ্যবান ও হজের শর্ত পূরণকারী সব নারী-পুরুষের উচিত, হজ করার সামর্থ্য হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করা।
সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজের অন্যতম লক্ষ্য : হজের অন্যতম প্রধান একটি দিক হল, ইসলামের সামাজিকতা ও আন্তর্জাতিকতা। হজ আধ্যাত্মিক ইবাদতের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক ইবাদত। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজের অন্যতম লক্ষ্য। হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা পরস্পরের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে এবং কাফির ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। হজ উপলক্ষে সমবেত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানগণ স্বৈরতান্ত্রিক তাগুতি শক্তির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। আর এ জন্যই বারাআত বা কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। যা সূরা তাওবাতে স্পষ্টভাবেই বলে দেয়া হয়েছে।
হজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আল্লাহর নির্দেশ ও আইনকে সব কিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়া এবং ইসলামের স্বার্থে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। প্রতি বছর হজ আমাদেরকে সে জন্য প্রস্তুতি নেয়ার, প্রশিক্ষণ নেয়ার এবং যোগ্যতা অর্জনের ডাক দিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে পবিত্র ঘরের তাওয়াফ ও নবীর রওজার যিয়ারত নসিব করুন। হজের শিক্ষায় নিজের জীবনকে সাজানের তাওফিকক দান করুন। আমিন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ বিকেলে লুইস-অ্যাথানেজের 'আক্ষেপে' ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশে
রানআউট হজ,লুইসের ব্যাটে এগোচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
জমকালো 'কনটেনন্ডার সিরিজ',কে কার বিপক্ষে লড়বেন?
তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল
অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার
'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা
দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস
দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
করিমগঞ্জের নাম কি আদৌ শ্রীভূমি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন
মাছ ধরার নৌকার সঙ্গে ভারতীয় সাবমেরিনের সংঘর্ষ
যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে টোকিও : বাড়ছে ভিড়