রিয়া এক মারাত্মক অন্তরব্যাধি
০৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম

আল্লাহপাক কায়েনাতের সকল নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন এবং এসব নিয়ামতকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ও অনুগত করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে তাঁর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে মহান আল্লাহর একটি মহৎ উদ্দেশ্য। আর মহৎ উদ্দেশ্যটি হলো, মানুষ এবং জ্বিন জাতি আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করবে। মানুষ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে ঠিকই; কিন্তু এ ইবাদত-বন্দেগী অন্যকে দেখিয়ে নিজের বুজুর্গি জাহির করতে চায়। তারাই বড় আল্লাহওয়ালা সাজে। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আজকের প্রবন্ধে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
রিয়া এর পরিচয় : রিয়া শব্দের অর্থ হলো লোক দেখানো। মানুষকে উত্তম চরিত্র দেখিয়ে তাদের অন্তরে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাকে রিয়া বলে। ইমাম গাজ্জালী (রা.) বলেন, লোক দেখানো ইবাদতের মাধ্যমে নিজের মহত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই হলো রিয়া। জেনে রেখো রিয়া হারাম আর রিয়াকারী আল্লাহ তাআলার নিকট অভিশপ্ত। (ইমাম গাজ্জালী (রা.), তাসকীলে কিরদার, উর্দু, পৃষ্ঠা-১৭৬)। রিয়া এক ধরনের ধোকা ও প্রতারণা বিদায় হারাম রিয়াকারীর অন্তরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ভয়ের চেয়ে দুর্বল বান্দার ভয় বেশি থাকে। আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান হওয়ার চেয়ে বান্দার নিকট মর্যাদাবান হওয়ার প্রবণতা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এমনকি রিয়াকারী আল্লাহকে বাদ দিয়ে বান্দাকে খুশি করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এদিক দিয়ে রিয়াকারী বান্দাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই, এটা ব্যক্তি তার নিজের সাথে নিজে প্রতারণার সামিল।
রিয়া শিরকের অন্তর্ভুক্ত : নবীজি (সা.) রিয়াকে শিরকে আসগর বা শিরকে খফী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম গাজ্জালী (রা.) বলেন, রিয়াকারী একজন বান্দাকে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আল্লাহর চেয়ে বড় শক্তিশালী মনে করে অথবা বান্দার নৈকট্য অর্জন করা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেয়ে বেশি উত্তম মনে করে। নতুবা এমন রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর উপর অন্যকে কেন প্রধান্য দেবে? নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই বিন্দু পরিমান রিয়াও শিরক। হযরত সাদ্দাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন হুজুর এর খেদমতে হাজির হলাম। তাঁর চেহারা মোবারক বিষন্ন দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, এর কারণ কি? তিনি বললেন, আমার পরে উম্মত মুশরিক হওয়ার আশঙ্কা করছি। আমি বললাম, হুজুরের পরে কি শিরিকে লিপ্ত হবে? উত্তরে হুজুর বললেন, তারা তো নিশ্চয়ই চন্দ্র, সূর্য ,পাথর, মূর্তিপূজা করবে না তবে আমলে রিয়া করবে। আর আমলে রিয়াই হলো শিরক। (ইমাম গাজ্জালী (রা.), তাসকীলে কিরদার, উর্দু, পৃষ্ঠা-১৭৮)।
আল্লাহ তাআলা ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু সালাম যথাক্রমে কুরআন ও হাদীস শরীফে এই মারাত্মক অন্তরব্যাধি থেকে বেঁচে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীদের যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বেখবর; যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে এবং নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র অন্যকে দেয়না। (সূরা মাউন: আয়াত: ৪-৭)। রিয়া মুনাফিকের অন্যতম আলামত। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য মুসলমানদের দেখার জন্য নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী করতো। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আল্লাহ পাক বলেন, অবশ্যই মুনাফিকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুত তারা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায় একান্ত শিথিলতা ও লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। (সূরা নিসা: আয়াত: ১৪২ )। রিয়াকারীর কোন আমল আল্লাহ কবুল করবেন না। নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ এমন আমল কবুল করবে না যার মধ্যে বিন্দু পরিমান রিয়া থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, কিয়ামতের দিন মোহরাঙ্কিত করা কিছু আমলনামা আনা হবে তখন আল্লাহ ফেরশতাদেরকে বলবেন, এসব আমলনামাকে নিক্ষেপ করে দাও। ফেরেশতারা আল্লাহর দরবারে আরয করবেন, হে আল্লাহ! আপনার ইজ্জত ও জালালিয়্যাতের কসম, আমাদের তো এসব আমলনামা ভালোই মনে হচ্ছে। আল্লাহ বলবেন, হ্যাঁ, কিন্তু এসব আমল তো অন্যের জন্য করেছে। আমি শুধু ঐসব আমল গ্রহণ করি যা খালেসভাবে শুধু আমার জন্যই করেছে। (হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা.), গুনিয়াতুত তালেবীন, উর্দু, পৃষ্ঠা-৪৫১)।
রিয়া এক ধরণের ভ-ামি ও প্রতারণা। রিয়াকারী কেবল মানুষের সাথে নয় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রতারণা করতে চাই। তাই সে বড় প্রতারক ও ভ-। জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামত দিবসে আমার নাজাতের উসিলা কি হবে? উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, তুমি আল্লাহকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না। লোকটি বলল, আমি কিভাবে আল্লাহকে ধোকা দিবো? নবীজি (সা.) বললেন, কাজতো আল্লাহ যা হুকুম করেছেন তাই করবে কিন্তু উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু। রিয়া থেকে বেঁচে থেকো, কেননা রিয়া হচ্ছে শিরক। কিয়ামত দিবসে সমস্ত মাখলুকের সামনে রিয়াকারীদেরকে চারটি নামে ডাকা হবে। (১) হে কাফের (২) হে পাপী (৩) হে দাগাবাজ এবং (৪) হে ক্ষতিগ্রস্ত! তোমার সমস্ত আমল বরবাদ, তোমার প্রতিদান হয়ে গিয়েছে।আজ তোমার জন্য কিছুই নেই। হে প্রতারক! তুমি যার জন্য আমল করেছিলে আজ তার কাছ থেকে সওয়াব আদায় কর। (ইমাম গাজ্জালী (রা.), মিনহাজুল আবেদিন, বাংলা, পৃষ্ঠা- ২৩২)।
রিয়া মুনাফিকের চরিত্র আর মুনাফিকের স্থান জাহান্নামের সর্বনি¤œ স্তরে। তাছাড়া রিয়াকে যেহেতু মহানবী শিরক বলেছেন সেহেতু রিয়াকারী হবে মুশরিক। আর এর জন্য বেহেশত চিরস্থায়ীভাবে হারাম। ইমাম গাজ্জালী (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, কিয়ামত দিবসে বেহেশত কথা বলার শক্তি পাবে এবং ঘোষণা করে জানিয়ে দেবে যে, কৃপণ ও রিয়কারীর জন্য আমি হারাম। গাউসে পাক (রা.) বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা যখন জান্নাতে আদনকে সৃষ্টি করলেন তার মধ্যে এমন নিয়ামতসমূহ সৃষ্টি করেছেন যা না কোন চোখ দেখেছে, না কোন কানে শুনেছে, না কোন মানুষের অন্তরে খেয়াল এসেছে। তারপর তাকে বললেন, হে আদন! তোমার কিছু বলার থাকলে বলো। তখন জান্নাতে আদন বলবে- মুমিনরাই সফলকাম তারপর বলবে, আমি প্রত্যেক কৃপণ ও রিয়াকারীর উপর হারাম। (হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা.), গুনিয়াতুত তালেবীন, উর্দু, পৃষ্ঠা-৪৫৫)।
রিয়া আমলকে নষ্ট করে দেয়, রিয়াকারীর উপর আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হয়। পরকাল তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে যায়। আর এটি একটি মারাত্মক অন্তর ব্যাধি। সুতরাং রিয়া থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে বাঁচতে হবে। তার পরিবার ও সন্তানদের বাঁচাতে হবে। রিয়া থেকে বাঁচার জন্য কতিপয় করণীয় উপায় বর্ণনা করা হলো। প্রথমত: রিয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে যেহেতু অন্যের কাছ থেকে মান-মর্যাদা ও প্রশংসা ইত্যাদি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে বিদায় প্রথমে রিয়াকারীর অন্তর থেকে ঐ সব ধ্বংসশীল আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো ধুয়ে মুছে ফেলে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত: রিয়া হলো ইখলাসের বিপরীত অর্থাৎ যার অন্তরে রিয়া আছে তার অন্তরে ইখলাস নাই। ইখলাস অর্জন করলে রিয়া দূরীভূত হবে। সুতরাং ইখলাসের মাধ্যমে রিয়া থেকে বাঁচা সম্ভব। তৃতীয়ত: যেহেতু এসব গুনাহের মূল উৎস প্রদানকারী হলো নফস শয়তান। সেহেতু সর্বদা শয়তানী কর্মকান্ডের বিপরীত কাজ করতে হবে। চতুর্থত: এই ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য আরেক উপায় হলো হক্কানী-রব্বানী আলেমেদ্বীন ও পীর-মুর্শিদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাজকিরায়ে নফস বা আত্মার পরিশুদ্ধি লাভ করা। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, তোমরা এমন আলেমের মজলিসে বসো যিনি পাঁচটি (ধ্বংসাত্মক) বস্তু থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে পাঁচটি (কল্যাণকর) বস্তুর প্রতি উৎসাহিত করেন। যথা: এক. দুনিয়ার প্রেম থেকে বের করে তাকে তাকওয়া বা ণপরহেজগারীর প্রতি উৎসাহিত করে। দুই. রিয়া থেকে মুক্ত করে ইখলাসের শিক্ষা দেয়। তিন. অহংকার থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে নম্রতার শিক্ষা দেয়। চার. অলসতা থেকে মুক্ত করে উপদেশ দেয়ার প্রতি উৎসাহিত করে। পাঁচ. অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করে। পঞ্চমত: এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচার সর্বশেষ পন্থা হলো মহান আল্লাহ দরবারে রিয়ামুক্ত জীবনের জন্য দোয়া করা। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া ভালো-মন্দ করা না করার কোন ক্ষমতা কারো নাই। রিয়া থেকে বাঁচার উপরোল্লেখিত বিষয়গুলো অব্যাহত রাখার সাথে দোয়াও চালু রাখতে হবে। নবীজি (সা.) নিজেও এভাবে দোয়া করতেন-হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে নেফাক থেকে, আমার আমলকে রিয়া থেকে, আমার জিব্বাকে মিথ্যা থেকে এবং আমার চোখকে খেয়ানত থেকে পবিত্র রাখো। চোখের খিয়ানত ও অন্তরে গোপন অবস্থা সম্পর্কে তুমি অবিহিত। (হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা.), গুনিয়াতুত তালেবীন, উর্দু, পৃষ্ঠা-৪৭১, আদ-দাওয়াতুল কবীর ইত্যাদি)।
পরিশেষে বলতে চাই, রিয়া একটি মারাত্মক অন্তরব্যাধি। এই ব্যাধি মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আসুন, আমরা মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের দরবারে এ গর্হিত ও ঘৃণিত চরিত্র থেকে মুক্তি লাভের আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং একনিষ্ঠতার সাথে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্ট অর্জন করার চেষ্টায় শক্তি প্রার্থনা করি। আল্লাহ পাক আমাদের রিয়ামুক্ত রেখে তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে শীর্ষ চারে নিউক্যাসেল

জয়ের ম্যাচে এমবাপের লাল কার্ড অস্বস্তিতে রিয়াল

নাটকীয় জয়ে শিরোপার আরও কাছে লিভারপুল

র্যাংগস ই-মার্টে শুরু হলো এসি কার্নিভাল

ঈদুল ফিতরে ২১ হাজার উদ্যোক্তাকে ডিজিটাল রূপান্তরে সহায়তা করলো জাতিকইজি

‘মঙ্গল’ নাম বদলে ক্ষোভ, ব্যাখ্যা চান চারুকলার শিক্ষার্থীরা

এক হাজার শয্যার আধুনিক হাসপাতাল উপহার দিচ্ছে চীন

২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রিজার্ভ

বৈশাখের কালো ঘোড়া

কালবৈশাখী

বৈশাখ

আচানক এইসব দৃশ্য

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

নারায়ণগঞ্জে আরসা প্রদানসহ ছয় জনের ফের আট দিনের রিমান্ডে

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ সরদার বকুলের বিরুদ্ধে

ভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকিভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকি

কবিতায় বৈশাখ

দ্রুত সময়ে ময়মনসিংহে বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু হবে: বিভাগীয় কমিশনার মোখতার আহমেদ

নববর্ষ ও বিজাতীয় আগ্রাসন

নানার বাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে পুকুরে ডুবে প্রাণ গেলো শিশুর