ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

হিজরি সনের ইতিহাস ও তাৎপর্য

Daily Inqilab এসএম আনওয়ারুল করীম

১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০৫ এএম

হিজরি সন। মুসলিম জীবনের এক তাৎপর্যময় অধ্যায়। বিশ^নবি হজরত মুহাম্মদ (স)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক তাৎপর্যময় ঘটনার অবিস্মরণীয় স্মারক এ হিজরি সন। হিজরি সনের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোদ নবি করিম (স)। খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি চুক্তিপত্রের নিচে হিজরতের ৫ম বর্ষ উল্লেখ করার নির্দেশ দেন বলে ইসলামের ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা) স্বীয় খেলাফতকালে হিজরতের ১৭তম বর্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন গণনা শুরু করেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : হিজরি তারিখ গণনার সূচনা কিভাবে হলো, কবে থেকে হলো তা বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আল মাওসুয়াতুল ফিকহিয়া আল কুয়েতিয়া’ গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে এসেছেÑ ইসলাম আসার আগে আরবের সমষ্টিগত কোনো তারিখ ছিল না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর, মাস গণনা করত। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সন্তানরা কাবা শরিফ নির্মিত হওয়ার আগে তাঁর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে তারিখ নির্ধারণ করত। কাবা শরিফ নির্মাণের পর তারা বিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্ত এর আলোকেই সাল গণনা করতেন। তারপর বনু ইসমাঈলের যারা হেজাজের তেহামা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে অন্যত্র চলে যেত, তখন সেই গোত্র বেরিয়ে যাওয়ার দিন থেকে তারিখ গণনা করত। যারা তেহামাতে রয়ে যেত তারা বনি জায়েদ গোত্রের জুহাইনা, নাহদ ও সাদের চলে যাওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কাব বিন লুয়াইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ ধারা চলমান ছিল। পরে তার মৃত্যুর দিন থেকে নতুনভাবে সাল গণনা শুরু হয়। এটি চলতে থাকে হস্তীবাহিনীর ঘটনা পর্যন্ত। হজরত ওমর (রা) হিজরি নববর্ষের ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত আরবে হস্তীবর্ষই প্রচলিত ছিল।

হিজরি সনের গোড়াপত্তন : মহানবি (স)-এর হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা) হিজরি সনের আনুষ্ঠানিক অপরিহার্যতা বোধ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র চান্দ্রমাসের পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। কেন একটি নতুন সন গণনা প্রথা চালু করতে হলো, এ নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়।

আল্লামা ইবনে সমরকন্দী (র) লিখেছেন, হজরত আবু মুসা আশয়ারী (রা) ইরাকের গভর্নর থাকাকালে একবার হজরত ওমর (রা)-এর কাছে চিঠি লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে। কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সন গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা) হিজরি সনের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন।

যেভাবে সন গণনা শুরু : হজরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। যখন হজরত ওমর (রা) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তখন তিনি এক পরামর্শসভার আহ্বান করেন। সভায় হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) রাসুল (স)-এর ওফাত থেকে সন গণনার প্রস্তাব দেন। হজরত তালহা (রা) বিশ^নবি (স)-এর নবুয়তের বছর থেকে সন গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। আর হজরত আলী (রা) প্রস্তাব দেন হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে সন গণনার। অবশেষে সকলেই আলী (রা)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।

মাস নিয়ে মতপার্থক্য : এরপর কোন মাস থেকে শুরু হবে এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আবদুর রহমান বিন আউফ (রা) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেননা এটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমে আসে। হজরত তালহা (রা) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা এটি উম্মতের মাস। হজরত আলী (রা) ও ওসমান (রা) মহররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন।

হিজরতের সাল থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হলো, হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয় আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল তথা সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী বিষয় হিসেবে। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। প্রকাশ্যে আজান, নামাজ, জুমা, ঈদ ও অন্য সবকিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। এসব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

তাৎপর্য : হিজরি সন আরবি মাস হলেও এ সনটিকে মুসলিম উম্মাহর সন হিসেবেই গ্রহণ করার প্রয়োজন অনেক বেশি। হিজরি সন মূলত চান্দ্র বর্ষের মাস। আরবিতে একে ‘আশশুহুরুল কামারিয়্যা’ বলা হয়। এ জন্য হিজরি সন একটি চান্দ্রবর্ষ। যেমন ঈসায়ী সনের মাসগুলোকে বলা হয় ‘আশশুহুরুশ শামসিয়্যা’ বা সৌরবর্ষের মাস। এ চান্দ্রবর্ষকে তাই কেবল আরবদের সন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না; বরং হিজরি মুসলমানদের সন। এটি ইসলামের সন।

হিজরি সনের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব আছে। বিশেষত ইবাদতের তারিখ, সময় ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরি সনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে হিজরি সনের হিসাব স্মরণ রাখা মুসলমানদের জন্য জরুরি। ধর্মীয় অনেক ক্ষেত্রেই হিজরি সনের প্রভাব রয়েছে। যেমন : রমজানের রোজা, দু’ঈদ, হজ, জাকাত ইত্যাদি। (চলবে)


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা