দুরূদ শরীফ পাঠের ফজিলত ও প্রয়োজনীয়তা
৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:২৯ এএম | আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:২৯ এএম
ফার্সি শব্দ দরুদ। আরবিতে সালাত। সালাত শব্দের বহু অর্থ। আভিধানিক বিবেচনায় নামাজ, দোয়া, ইস্তেগফার, রহমত ইত্যাদির সবগুলোই সালাত অর্থে ব্যবহার হয়। তবে ইসলামের প্রচলিত পরিভাষায়, সালাত বলতে নামাজকেই বোঝায়। আর সালাত শব্দটি দ্বারা যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বুঝায় অর্থ্যাৎ ‘সালাত আলান নবী’ বললে এর অর্থ দাঁড়ায়, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ শরীফ। এই দরুদ শরীফই অত্র লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।
মুসলমানদের জন্য রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা সকল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। ফেরেশতাগণ ও ঈমানদারকে নবীর প্রতি দরূদ পড়ার নির্দেশ আল্লাহতায়ালা নিজেই দিয়েছেন। নবীর প্রতি দরূদ পড়ার অর্থই হলো- আল্লাহর আদেশের বাস্তবায়ন ও হুকুম পালন করা। আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তার ফেরেশতারা নবীর প্রতি সালাত-দরূদ পেশ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তার প্রতি সালাত পেশ করো এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।’ (সূরা আহজাব : ৫৬)।
দুরূদ শরীফ সমস্ত বিধানের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম কাজ। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলা কোন বিধানে নিজের ও নিজের ফিরিশতাদের কথা উল্লেখ করেননি- আমিও এ কাজ করছি, তোমরাও করো। একমাত্র দুরূদ শরীফ ব্যতীত। সমস্ত ফেরেশতারা কোন নির্দিষ্টকরণ ছাড়াই, সর্বদা হুযূরে পাকের উপর দুরূদ শরীফ প্রেরণ করেন। দুরূদ শরীফ গোটা জীবনে একবার পাঠ করা ফরজ। যেখানেই মহানবীর নাম আসে, একবার পাঠ করা ওয়াজিব। নামাযের অভ্যন্তরে ‘আত্তাহিয়্যাতু’-এর পর পাঠ করা ‘সুন্নাত’। আর সর্বদা পাঠ করা মুস্তাহাব।
আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবের প্রশংসা ও গুণগান মর্যাদাময় স্থানে করেছেন এবং তাঁর উপর রহমত প্রেরণ করেছেন। ফেরেশতাগণও রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মহত্ব বর্ণনা করেছেন। অতএব, মুসলমানদেরও এরূপ মর্যাদা সহকারে দুরূদ সালাম প্রেরণ করা জরুরি। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু মহান আল্লাহ্ তা‘আলার গুণগান করে, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা স্বয়ং তাঁর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করেন। এজন্য দুরূদ শরীফ পাঠ করা একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর আস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার ওপর দশবার দরূদ পাঠ করবেন।’ (সহিহ মুসলিম : ৩৮৪)।
হজরত ইবনে মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি সব লোকের তুলনায় আমার বেশি নিকটবর্তী হবে, যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমার ওপর দরূদ পড়বে।’ (সুনানে তিরমিজি : ৪৮৪)। হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রকৃত কৃপণ সেই ব্যক্তি, যার কাছে আমি উল্লিখিত হলাম (আমার নাম উচ্চারিত হল) অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না।’ (সুনানে তিরমিজি : ৩৫৪৬)। হজরত কাব ইবনে উজরা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা মিম্বরের কাছে একত্রিত হও। আমরা উপস্থিত হলাম। যখন তিনি মিম্বরের প্রথম স্তরে চড়লেন তখন বললেন, ‘হে আল্লাহ কবুল করুন’।
তারপর যখন দ্বিতীয় স্তরে চড়লেন তখনও বললেন, ‘হে আল্লাহ কবুল করুন’। তারপর তৃতীয় স্তরে চড়ে আবারও বললেন, ‘হে আল্লাহ কবুল করুন।’ খুতবা শেষে যখন মিম্বর থেকে অবতরণ করলেন তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আজ আমরা আপনার থেকে এমন কিছু শুনলাম যা এর পূর্বে আর কখনও শুনিনি। তখন তিনি বললেন, আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এসে বলল, যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও তাকে ক্ষমা করা হলো না- সে বঞ্চিত হোক। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ কবুল করুন। যখন দ্বিতীয় স্তরে চড়লাম তখন তিনি বললেন, যার কাছে আপনার নাম উল্লেখ করা হলো কিন্তু সে আপনার ওপর দরূদ পড়ল না- সেও বঞ্চিত হোক। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ কবুল করুন। যখন তৃতীয় স্তরে চড়লাম, তখন তিনি বললেন, যে পিতা-মাতাকে অথবা তাদের কোনো একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না সেও বঞ্চিত হোক। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ কবুল করুন। (বায়হাকি : ১৪৬৮)।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি- ‘যে ব্যক্তি আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী হবো।’ (আল্ ক্বওলুল বদী)। হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত- ‘নিঃসন্দেহে প্রত্যেক দোয়া আসমান ও যমীনের মধ্যখানে ঝুলন্ত থাকে, তা থেকে কিছুই উপরে আরোহন করে না, যতক্ষণ না তুমি তোমার নবীর উপর দুরূদ শরীফ পড়বে।’ দুরূদ পাঠের অসংখ্য ফজিলত রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ফযিলত হল দুরূদ পাঠকারীর উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। কেননা, আল্লাহর এক বিন্দু রহমত সমগ্র পৃথিবীর চেয়েও বড় এবং প্রশস্ত।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার ওপর দরুদ শরিফ পাঠ কর এবং যথাযথভাবে সালাম প্রেরণ কর।’ (সূরা আহজাব : ৫২)। এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় আল্লাহর কাছে দরুদ শরিফের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কী পরিমাণ এবং এটা যে কত প্রিয় আমল। এই আমল নবীজির ও আল্লাহতায়ালার মাহবুব ও প্রিয়পাত্র হওয়ার বড় সহায়ক। কিছু দরুদ শরিফ উল্লেখ করা হলো।
এক. হজরত কাব ইবনে উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন- কীভাবে আমরা আপনার ওপর দরুদ পড়ব? তখন নবীজি বললেন, ‘তোমরা এভাবে বল- ‘আল্লাহুম্মা সল্লিআলা মুহাম্মাদিউ ওয়ালা আলী মুহাম্মাদ- কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলী ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুন মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিউ ওয়ালা আলী মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলী ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুন মাজিদ। অর্থ: ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাম্মদের পরিবার এবং পরিজনের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। যেভাবে রহমত বর্ষণ করেছেন ইবরাহিম আলাইহিস সাল্লাম ও তার পরিবার পরিজনের ওপর। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও মহান। ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাম্মদের পরিবার এবং পরিজনের ওপর বরকত করুন। যেভাবে বরকত নাজিল করেছেন ইবরাহিম আলাইহিস সাল্লাম ও তার পরিবার পরিজনের ওপর। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও মহান। (সহিহ বোখারি)।
দুই. হজরত আবু মাসউদ আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এইভাবে দরুদ পড়- ‘আল্লাহুম্মা সল্লিআলা মুহাম্মাদিউ ওয়ালা আলী মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলী মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ফিল আলামিন ইন্নাকা হামিদুন মাজিদ। অর্থ: ইয়া আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবারের ওপর রহমত নাজিল করুন, যেমনিভাবে ইবরাহিমের ওপর নাজিল করেছেন এবং পৃথিবীতে মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবার এবং পরিজনের ওপর বরকত নাজিল করুন, যেমনি ইবরাহিমের পরিবারের ওপর বরকত নাজিল করেছেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত মহান।’ (সহিহ মুসলিম)।
তিন. হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, (নবীবে প্রশ্ন করা হলো)‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার ওপর কীভাবে দরুদ পড়ব?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা বল- আল্লাহুম্মা সল্লিআলা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া রাসূলিকা কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া বাকির আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা ওয়ালা আলী ইবরাহিমা। অর্থ: ইয়া আল্লাহ! আপনার রাসূল ও বান্দা মুহাম্মদের ওপর রহমত নাজিল করুন, যেমনিভাবে ইবরাহিমের ওপর নাজিল করেছেন এবং মুহাম্মদের ওপর ও মুহাম্মদের পরিবারের ওপর বরকত নাজিল করুন, যেমনিভাবে বরকত নাজিল করেছেন ইবরাহিমের পরিবারের ওপর।’ (সহিহ বোখারি)। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত সব সময় প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বেশি বেশি দরূদ পড়া। বিশেষ করে যে কোনো প্রয়োজনের দোয়ার আগে দরূদ পড়ে নেয়া। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাদের সৌভাগ্যের সব রহমত বরকত মাগফেরাত লাভে বেশি বেশি দরূদ পড়ার তাওফিক দান করুন। হাদিসে ঘোষিত দরূদের সব ফজিলত ও মর্যাদা লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ বিকেলে লুইস-অ্যাথানেজের 'আক্ষেপে' ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশে
রানআউট হজ,লুইসের ব্যাটে এগোচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
জমকালো 'কনটেনন্ডার সিরিজ',কে কার বিপক্ষে লড়বেন?
তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল
অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার
'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা
দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস
দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
করিমগঞ্জের নাম কি আদৌ শ্রীভূমি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন
মাছ ধরার নৌকার সঙ্গে ভারতীয় সাবমেরিনের সংঘর্ষ
যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে টোকিও : বাড়ছে ভিড়