বিপাকে ভারতের চাষিরা
০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:১৮ পিএম
পেঁয়াজ নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ভারত সরকার অনেক ‘নাটক’ করেছে। হঠাৎ করে ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মোদী সরকার বংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন স্থল বন্দর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশমুখি পেঁয়াজের ট্রাক ফেরত নেয়া হয়। এতে পেঁয়াজের তীব্র সংকট দেখা দেয়। দেশের মানুষকে ২৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ ক্রয় করতে হয়। সরকার বাধ্য হয়ে তুরস্ক, পকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানি করে। ওই সময় বিমানে এক কেজি পেঁয়াজের পরিবহণ খরচ একশ টাকা পড়ে যায়। ভারতের ্ওই ধাক্কার পর দেশের কৃষকরা পেঁয়াজ ফলনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখন দেশে পেঁয়াজের ফলন বাড়ছে। সে কারণে ভারত থেকে পণ্যটির (পেঁয়াজ) আমদানির প্রয়োজন পড়ছে না। এতে ভারতের চাষিরা এ বছর পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে পড়ে গেছেন। দেশটির গণমাধ্যমগুলোয় এমন বক্তব্য দিচ্ছেন কৃষক নেতারা। এর আগে ২০১৫ সালে ভারতের গরু বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশ এখন গরু উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছে।
২০২০ সালে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি মাঝেমধ্যেই অনিশ্চয়তার পড়ায় বাংলাদেশে পেঁয়াজ চাষে আরো বেশি জোর দেওয়া হয়। চাষিরা ভাল দামের আশায় পেঁয়াজ চাষে মনোযোগী হন। কৃষি খাতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত তিন বছর ধরেই পেঁয়াজের ভালো দাম পাওয়ায় বাংলাদেশের কৃষকেরা পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকেছেন। তাতে উৎপাদন বাড়ছে। এতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমতে শুরু করেছে।
ভারতের গণমাধ্যমগুলো বলছে, চলতি বছর অবশ্য ভারতেও পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আগের মতো রপ্তানি করতে না পারায় ভারতীয় চাষিরা পেঁয়াজের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। ভারতের মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাটসহ একাধিক রাজ্যের কৃষকরা এক রুপী, দুই রুপীতে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। অনেক কৃষক পেঁয়াজের গোলায় আগুন দিয়েছেন এমন সচিত্র খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে দেশীয় চাষিদের সুরক্ষা দিতে গত ১৫ মার্চ থেকে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করেছে বাংলাদেশের সরকার। পেঁয়াজ আমদানি অনুমোদনের (আইপি) মেয়াদ নতুন করে বাড়ানোর চিন্তা সরকারের নেই বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানির যে ব্যবস্থা, তাতে ব্যবসার প্রকৃত ধরন ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে ধরাবাঁধা কোনো অনুশীলন দেখা যায় না। তবে এটা খেয়াল রাখা উচিত দেশের কৃষক যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন বছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন পণ্যটির বার্ষিক চাহিদা ২৮ লাখ টন অতিক্রম করে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৬ লাখ টন। তার আগের বছর দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ৩৪ লাখ টন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছর উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ টন। অর্থাৎ, গত দুই অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের পেঁয়াজের ট্রাক বন্ধ করে দেয়া নাটকের পর বাংলাদেশের কৃষকের আগ্রহের কারণেই দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টনের বেশি। যেভাবে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে, তাতে এবারও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই সময়ে কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য সরকার আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের অন্যতম উৎপাদনকারী এলাকা মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সেখানকার কৃষকেরা। বাড়তি ফলনের কারণে তারা এ বছর পেঁয়াজের দাম পাচ্ছেন না। পেঁয়াজের দাম এতটাই কমেছে যে কৃষকেরা প্রতি কেজি মাত্র দু’তিন টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন অবস্থায় অনেক কৃষক মাঠেই ফসল নষ্ট করছেন। মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি বেশ কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রদেশ আর গুজরাটেও পেঁয়াজ চাষ শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশের বাজারেও ভারতীয় পেঁয়াজের রপ্তানি কমে গেছে। সব মিলিয়ে ভারতের পেঁয়াজচাষিরা এবার বেশ সমস্যায় পড়েছেন। ভারতের কৃষকদের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্টের (সিপিআইএম) কৃষক সংগঠন অল ইন্ডিয়া কিষান সভার মহারাষ্ট্রের উপ-সভাপতি সুনীল মালুসারে ভারতের পেঁয়াজ চাষীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বলেন, নতুন পেঁয়াজ মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে আসতে শুরু করে। তখন পুরোনো পেঁয়াজ শেষ হয়ে যায়। ভারতের সরকারি সংস্থা অ্যাগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি বা এপিএমসি যে দামে পুরোনো পেঁয়াজ কিনেছিল, তা কৃষকদের বিরাট সর্বনাশ করেছে। কারণ, উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ টাকার বেশি হলেও, প্রতি কেজি ৪, ৫ টাকা পাওয়া গিয়েছে সরকারের থেকে অনুদান বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) হিসেবে। তিনি বলেন, পেঁয়াজ রফতানির বেসরকারি বাজারের মধ্যে প্রধান একটি বাজার হলো বাংলাদেশ। কিন্তু তারা পেঁয়াজ নেওয়া বন্ধ করেছে। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে ভারতের কৃষকেরা আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। বাংলাদেশ যদি পুরো মৌসুম পেঁয়াজ না নেয়, তাহলে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরাও বড় ক্ষতির মধ্যে পড়বেন।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রকার ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। গত বছরের এ সময়ে দেশীয় পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা।
পেঁয়াজের বাজারে সংকট নেই মন্তব্য করে রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী মো. আবদুল মাজেদ সাংবাদিকদের বলেন, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ভালো, সরবরাহও ভালো। তাতে দাম অস্বাভাবিক হওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোদী সরকার গরু প্রবেশ বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশের কৃষরা গরু প্রতিপালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দেশ এখন গরুর গোশতে চাহিদা মেটাচ্ছে। পেঁয়াজেও দেশের কৃষকরা চাহিদা মেটাতে পারবেন বলে আশা করছি।
অবশ্য বাংলাদেশ যখন পেঁয়াজ আমদানিনির্ভর ছিল তখন পরিস্থিতি এমন ছিল না। এমনও হয়েছে বাংলাদেশের যখন পেঁয়াজের অনেক বেশি দরকার, তখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পেঁয়াজের অভ্যন্তরীণ সংকটের আশঙ্কার কথা বলে রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজ কখনো কখনো প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে দেশের পেঁয়াজের বাজারে অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। তখন দেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদা ছিল ২৬ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন বা মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দিতেন দেশের কৃষকেরা। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বা ১০ লাখ টনের মতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মিয়ানমার বা তুরস্কের মতো দেশ থেকে আসত। বর্তমানে সেই অবস্থা আর নেই। পেঁয়াজ উৎপাদন এখন লক্ষ্যমাত্রার বেশি। তাতে বাজারে আমদানি না করলেও চলে। তবে পচনশীল পণ্য হওয়ায় উৎপাদনের পুরোটা ব্যবহার করা যায় না। এ ছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতা বিবেচনায় মাঝেমধ্যে আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
দেশের কৃষি কর্মকর্তারা জানান, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সরকার ইতিমধ্যে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো কৃষকদের পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণে সহায়তা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্প্রসারণ। তা ছাড়া বাজার সংযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষকদের আয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য হ্রাস করা। ##
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ
গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই
নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন
গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন
চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ
সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে
নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন
ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা
আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন
গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক
ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার
উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার