তরতরিয়ে বাড়ছে পণ্যের দাম
১২ মে ২০২৩, ১০:৫৮ পিএম | আপডেট: ১৩ মে ২০২৩, ১২:০২ এএম
শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার গত বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই তবে অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এ কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।’ গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি কাচা বাজারে গিয়ে প্রতিমন্ত্রীর কথার বাস্তবতা দেখা গেল। মানুষ সাপ্তাহিক বাজার করতে গিয়ে দামের কারণে হা-হুতাশ করছেন। প্রয়োজনের তুলনায় পণ্য কম কম করে কিনে ঘরে ফিরছেন।
বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ কাজে আসছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রতিদিন টিভিতে বক্তৃতা করছেন। সচিবালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তার বক্তব্য টিভিতে প্রচার হচ্ছে; পত্রিকায় খবর ছাপা হচ্ছে। ওই পর্যন্তই। মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকার পরিষদ বাজারে অভিযান চালাচ্ছেন। কোনো কিছুই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজারের দাহিদা ও সরবরাহের চরিত্র বুঝতে না পারা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতার অসৎ ব্যবসায়ীরা সি-িকেট করে বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেল সত্যিই পণ্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাইরে। অতিরিক্ত চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মাছ, গোশত, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ-রসুন ও আদাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। এছাড়া বাজারে এক মাসের ব্যবধানে চিনির কেজি ১১৫ থেকে বেড়ে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশের অন্যতম সবজি সরবরাহকারী জেলা বগুড়ায় সাতদিন আগে যেখানে পটলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৬০ টাকা সেখানে এ সপ্তাহে তা হয়েছে ৮০ টাকা। করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০ টাকা, সজনে ৪১ টাকা, ঢেঁড়শ ৪০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, বরবটি ৪০ টাকা ও কাঁচামরিচ ১৬০ টাকা। উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ সবজি বাজার মহাস্থান কাঁচা বাজারের আড়তদার নভেল আহমেদ খঅন জানান, এক মাস আগেও দাম এত বেশি ছিল না। গরমে দেশি সবজি নষ্ট হয়েছে তাই দাম বেড়েছে। প্রচ- গরমের কারণে সবজির ফলন কম হওয়ায় সরবরাহ কমেছে।
ঢাকার যাতাবাড়ি, কারওয়ান বাজার পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরবরাহ কমে যাওয়ার ব্ড় ধরনের প্রভাব পড়েছে সব ধরনের সবজির দরে। বছরজুড়ে সবার সাধ্যের মধ্যে থাকা পেঁপেরও দাম নাগালের বাইরে, বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিদরে; গ্রীষ্মকালীন অন্য সবজির কেজিও ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই। সরবরাহ সংকটের কথা বলে কিছু সবজির দাম অনেক বেশি নেওয়ার তথ্যও মিলছে। তবে অনেক পণ্যের দাম পাইকারি চেয়ে খুচরা বাজারে দ্বিগুন তিনগুন নেয়া হচ্ছে। বগুড়ায় সজনে যেখানে ৪০ টাকা, সেখানে ঢাকার বাজারে তা ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচামরিচ বগুড়ায় ১৬০ টাকা হলেও ঢাকায় তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়।
দামের এমন পার্থক্য নিয়ে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ির সবজি ব্যবসায়ী সোলায়মান খান বলেন, আমাদের তো কেনা দামই বেশি পড়ছে। বগুড়া থেকে যখন এক গাড়ি সবজি আসে তখন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ভাড়া যায়। ওইখানে ৬০ টাকা হইলে ঢাকায় আসতে আসতে দাম হয়ে যায় ১১০ টাকা। কেনাই যদি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা পড়ে তাহলে দাম তো এমন হবেই।
বাজারে তড়তড়িয়ে বাড়ছে আলু-পেঁয়াজ-চিনি-সয়াবিনসহ কাচা শাক-সবজির দাম। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাস আগে বাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। তখন ছিল রোজা; সেই মাসে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নানা তদারকিও ছিল মাঠপর্যায়ে। তবে ওই মাস যেতে না যেতেই বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজের দাম হয় কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, আমদানি করা পেঁয়াজ ওঠে ৬০ টাকা পর্যন্ত। এ সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় এবং আমদানি পেঁয়াজের দাম উঠেছে ৭০ টাকা কেজি পর্যন্ত। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে দুই ধরনের পেঁয়াজে দ্বিগুণ দাম বেড়েছে। যাত্রাবাড়ি এলাকায় ছোট আকারের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা কেজিদরে। আকারে একটু বড় পেঁয়াজের কেজি ৭৫ টাকা। এ বাজারের পেঁয়াজ-আলু বিক্রেতা মো. ইদ্রিস মিয়া বলেন, কয়েকদিন আগে পেঁয়াজ ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। তবে গত সপ্তাহে দাম বেড়ে ৫৫ টাকা হয়। বড়টা ছিল ৭০ টাকা। আড়তে পেঁয়াজের অভাব নাই কিন্তু দাম বাড়তি। আমরা তো আর জিজ্ঞেস করি না কেন বাড়তি। বাজারে যে দর চলে সে দরেই কিনে আনি। এখন একটা যুক্তি হইছে দাম বাড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেই আমদানি না থাকা, ডলারের ক্রাইসিস এগুলোর কথা বলে।
যাত্রাবাড়ির এলাকার বাসিন্দা ঢাকা বারের নেতা অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাজারে গেলে মাথা ঘোরায়। কোনো কিছুর দাম কমেনি। সবকিছুর দাম বেড়েছে। অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে। যেমন কয়েকদিন আগে চিনি ১১৫ থেকে ১২০ টাকার মধ্যেই কিনেছি। আজ ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে কিন্তু অনেক ভাবার আছে। এর মধ্যেই আবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
যাত্রবাড়ির পাইকারি মার্কেটের দোকানি শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, পশ্চিম বঙ্গের কোলকাতায় এখন চিনি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেই চিনি ঢাকায় দেড়শ টাকা। চিনির দাম না শুধু, দেশের বাজারে সবকিছুর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চিনি নিয়ে দেশের বাজারে অনেক বড় সিন্ডিকেট আছে। ফলে চিনির দাম এতো বেশি। বাজারে এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁপে ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর শনিরআখড়া, ধোলাইপাড়, ফকিরাপুল সায়েদাবাদ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাপ্তাহের ব্যবধানে সবপণ্যের দাম বেড়েছে। বাজার ভেদে প্রতি কেজি টমেটো ৪০ থেকে ৫০ টাকা টাকা, ঢেঁড়স ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা, পটল ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা, কাঁকরোল ১০০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৮০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাছের বাজারও চড়া। বাজার ভেদে তেলাপিয়া ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, শিং মাছ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, শোল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়, পাঙাস ২২০ টাকা, চাষের কই ৩০০ টাকা, কাতল ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা, চিংড়ি ৭০০ টাকা, টেংরা ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজে কেজি প্রতি দাম বেড়েছে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ আজকে বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। এক সাপ্তহ আগে চায়না রসুনের কেজি ছিলো ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা সেটা শুক্রবার বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। আর দেশি রসুন কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা। আদার দাম আগের মতোই রয়েছে। দেশি আদা আগের দামেই ২৫০ টাকা আর চায়না আদা ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একাধিক ক্রেতা বলেন, এইতো কয়েকদিন আগেও পেঁয়াজ কিনেছি ৪০ টাকায় আজকে বাজারে এসে সেই পেঁয়াজ কিনতে হলো দ্বিগুণ দামে ৮০ টাকায। এভাবে বাজারে সামগ্রীর দাম বাড়ছেই। আমাদের বাজার এমন কোন সামগ্রীর দাম বাড়লে সেটা আর কমে না। এখন আমাদের কিন্তু বেতনভাতা বাড়ছে না। তাহলে কিভাবে আমরা রাজধানীতে টিকে থাকবো। সরকারি কর্মকর্তারা নানা সুবিধা পেলেও বেসরকারি যারা চাকুরিজীবী তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
এছাড়া ভোজ্যতেলের প্রতিলিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৫ টাকায় বিক্রি করছে বিক্রেতারা। দুই লিটার তেল ৩৭৪ টাকা থেকে ১০/১২ টাকা বেড়ে ৩৮০-৩৯০ টাকা, ৫ লিটার তেল ৯০৬ থেকে ২০/২১ টাকা বেড়ে ৯১৫-৯২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শনির আখড়ায় বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী শফিউর রহমান নিজের অক্ষমতার চিত্র তুলে ধরে বলেন, তিন সন্তান নিয়ে পলাশপুরে থাকি। যে টাকা কাজ করে বেতন পাই প্রায় সব টাকা বাজার আর সন্তানদের পড়ালেখায় চলে যায়। কেউ যদি অসুস্থ হয় তাহলে ডাক্তার না দেখিয়েই মরতে হবে। এভাবে নিত্যসামগ্রীর দাম বাড়লে ঢাকা শহরে থাকাটাই মুশকিল হয়ে যাবে। এখন আমাদের দেখার কেউ নেই। এভাবে দাম বাড়লে কি খাবো আমাদের মত নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ