অর্থনীতিতে আস্থার সঙ্কটে উদ্বেগ
১৪ মে ২০২৩, ১১:১৫ পিএম | আপডেট: ১৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
সাড়ে ৭ শতাংশের নিচে প্রবৃদ্ধি হবে- প্রবৃদ্ধি নিয়ে এ প্রাক্কলন বাস্তবতা নির্ভর নয়। এটা ব্যাস্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা সমর্থন করে না। বাস্তবতা হলো, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির পেক্ষিতে ৫ বা ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই অনেক বেশি। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনো দেশই এই নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বাংলাদেশ সেখানেই অবস্থান করছে। একই সঙ্গে আগামী ৫ থেকে ৭ মাসের মধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এছাড়া দেশের আর্থিক খাতের ওপর মানুষের আস্থার যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তা রাতারাতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তাই কমার বদলে অর্থপাচার আরো বাড়তে পারে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এসব বিষয় সমাধানে সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
গতকাল রোববার পলিসি রিচার্চ ইন্টিস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত প্রি-বাজেট প্রেস ব্রিফিং অ্যান্ড ডিসকাশন শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন। পিআরআই-এর চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তারের সভাপতিত্বে কি-নোট উপস্থাপন করেন পিআরআই স্টাডি সেন্টার অন ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক। পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন থিঙ্ক ট্যাঙ্কটির চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার। সভায় ড. সাত্তার ও ড. রাজ্জাক দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আস্থার সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গবেষণা সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাকের হিসাব অনুসারে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৫৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের রাজস্ব আদায়ের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে পিআরআই প্রক্ষেপণ করছে, এনবিআর ৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারবে। সংস্থাটি বলছে, বর্তমান এনবিআর দিয়ে রাজস্ব বাড়ানো অবাস্তব। এরমধ্যে অর্থনীতিতেও নেতৃত্ব সঙ্কট আছে। এ সঙ্কট সামাল দিতে শক্ত টিম গঠনসহ ৫ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে বিশেষ সুযোগ ঘোষণা করা হয়েছিল। কোনো টাকাই ফেরত আসেনি। স্বার্থান্বেষী মহল কেউ কেউ এ সুবিধা নেবে। কিন্তু নৈতিকভাবে এটা সঠিক নয়। বদনামের ভাগিদার হবে, কিন্তু উপকার আসবে না। সরকারের এটা একটি আন-ওয়াইজ ও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এবার আবার প্রত্যাহার হবে। আমারা সাধুবাদ দেবো, এটা আর দরকার নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত ১৫ মাস ধরে একটি সমস্যা আছে এবং তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এটা যত দীর্ঘায়িত হয়, সমস্যা বড় হবে। ক্ষত ততটা বাড়তে থাকবে। সাধারণ মানুষের ওপরে দীর্ঘস্থায় বোঝা চাপতে থাকবে এবং তা বড় হতে থাকবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার একটা শক্তিশালী অর্থনৈতিক টিম গঠন করবে, যেটার মাধ্যমে নীতিগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কয়েকটি সুপারিশ দিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার যেটা এখন পর্যন্ত করেছে, তা খুবই ক্ষুদ্র, বড় কিছু করেনি। বড়র মধ্যে করেছিল এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত। সরকার এখনো সুদ হার পরিবর্তন করেনি। মূল্যস্ফীতিকে অ্যাড্রেস করার জন্য এখনো পর্যন্ত একটি পলিসি করেনি; মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। রিজার্ভ নিয়ে এখন পর্যন্ত যে পলিসি নিয়েছে, তাতে হ্রাস বন্ধ হয়নি। এটা চলছেই। গত ৯ মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। আগামী ৮-৯ মাস যদি আরও ৮-৯ বিলিয়ন হারায়, তাহলে আমরা কোথায় থাকবো?
তিনি বলেন, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতি কাজ করছে না। যদি কাজ না করে তাহলে নীতির পরিবর্তন করতে হবে। সরকারের নীতি হওয়া উচিত, আমরা আরও রিজার্ভ বিক্রি করবো না, প্রত্যেকে মার্কেটে যাও। তাহলে মার্কেটে মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হবে। আস্তে আস্তে স্থিতিশীলতা আসবে। আর সরকার যে ধার করে নিয়ে আসবে, সেটা জমা হবে। রিজার্ভ বাড়বে। আমাদের যেটা হচ্ছে, আস্থার ঘাটতি। রিজার্ভ সাশ্রয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। আর এর ফলে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। ঝুঁকিতে পড়বে প্রবৃদ্ধি, উল্লেখ করেন পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক।
অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষ না কিন্তু নিয়ন্ত্রণে সার্থক বলে মনে করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, তারা বাজেট কমিয়ে দেবে। বাজেটের খরচ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে খুবই শক্তিশালী। অন্তত ২০টি দেশে কাজ করেছি। এ সব দেশকে এত কার্যকর ম্যানেজ করতে দেখিনি। বাংলাদেশে কর্মরত বহুজাতিক কোম্পানি অডিট করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের অডিট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্টিং ও অডিটের ধরন আন্তর্জাতিক মানের হয়। মানহীন অডিট ফার্ম দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অডিট করানো হলে এবং সেখানে নেতিবাচক কিছু বের হলে তাতে দেশের সুনাম ক্ষুন্ন হবে।
ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, দেশের ব্যাস্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে চাপের আভাস থাকলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের ৫০ বছরের পরিক্রমায় আজকে যে অবস্থানে, তা একটি ইতিবাচক চিত্র। বাংলাদেশ এখন আর তলাহীন ঝুড়ির প্রসঙ্গে নেই; এটি অগ্রগতি ও উৎসাহব্যঞ্জক কতকগুলো সাফল্যের গল্প বলে মনে করেন তিনি। পিআরই চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেন, এখন আমরা শুধুই সামনে যাচ্ছি। বাজেট ব্যবস্থাপনায় এক অসাধারণ কাজ করছে বাংলাদেশ। ব্যাস্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অসাধারণ করছে। এটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত স্বীকার করেছে। গত ২০ থেকে ২৫ বছরে আমরা ব্যাস্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ভালো করেছি। বৈদেশিক বাণিজ্যে যদিও ঘাটতি রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে নেতিবাচক সূচক সামনে এসেছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি হচ্ছে। এগুলো হয়েছে সময় উপযোগী ব্যবস্থা না দেওয়ার কারণে, এমন নয়। বরং সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান জায়েদি সাত্তার।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ট্রেড ঘাটতি হলো। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হলো। যদিও পদ্ধতিটা ঠিক ছিল না, তারপরও এ উদ্যোগ ফল দিয়েছে। আইএমএফ ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে শুরু সময় থেকে বলা হচ্ছে শর্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু এখানে শর্তের কোনো বিষয় নেই বলে জানান জায়েদি সাত্তার। তিনি বলেন, শর্তের বিষয়টি গণমাধ্যমের সৃষ্টি। প্রকৃত বিষয় হলো সরকারের সাথে বোঝাপড়া; সরকার কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলে ঋণ দেয়া হবে না, এটাও ঠিক না।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ব্যাস্টিক অর্থনীতির লক্ষপূরণ হবে না বলে জানান ড. এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়, প্রবাসী আয়, রফতানি আয় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন চাপে আছে। এই ঘাটতির ওপর আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট প্রাক্কলন করা হবে। প্রসঙ্গত, ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের একটি শর্ত হিসেবে, বাংলাদেশকে আগামী অর্থবছর নাগাদ জিডিপিতে করের অবদান শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আন্তর্জাতিক ঋণদাতাটির হিসাব অনুসারে, চলতি অর্থবছরে এনবিআর হয়তো ৩ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারবে। যদিও পিআরআই এর তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় আইএমএফের হিসাবের চেয়ে ২১ দশমিক ৪০ হাজার কোটি টাকা কম হবে। এই ব্যর্থতার জন্য এনবিআরের সক্ষমতার ঘাটতি এবং দরকারি সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে পিআরআই। একইসঙ্গে প্রবাসী আয়, রফতানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পড়তি অবস্থা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন রাজস্ব সংগ্রহকে দেশের অর্থনীতির জন্য প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে গবেষণা সংস্থাটি। ড. রাজ্জাক বলেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে চাপের মধ্যে রয়েছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম