চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়ে তোলপাড়
২১ মে ২০২৩, ১০:৪৪ পিএম | আপডেট: ২২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হচ্ছে। বন্দরের বহিনোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য ‘শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর’ হিসেবে যে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ২০টির মালিক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। অথচ পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের মতো জটিল ও বিশেষ কাজের অভিজ্ঞতাও নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। এ ঘটনায় বন্দর শিপিং সেক্টরে তোলপাড় চলছে। অভিযোগ রয়েছে- লাইসেন্স পেতে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য আবেদন জমা থাকলেও কোন প্রকার টেন্ডার আহ্বান ছাড়াই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপিদের সুপারিশেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙরে বড় জাহাজ থেকে বছরে সাড়ে ছয় কোটি টন পণ্য খালাস করা হয়। বর্তমানে ৩২টি প্রতিষ্ঠান বহিনোঙরে পণ্য খালাসে নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের আমদানি পণ্য খালাস করে। বাকি ২৭টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আমদানিকারকের পণ্য খালাসে নিয়োজিত রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দরে শ্রমিক অসন্তোষ রোধসহ নানা কারণে যে লাইসেন্স প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই প্রথাকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো। অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেয়ার ফলে পণ্য হ্যান্ডলিংসহ বন্দরের সার্বিক উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সাথে পেশিশক্তির কাছে বন্দর জিম্মি হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বন্দরের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে এসব লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশনা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন।
এ বিষয়ে বন্দরের অবস্থান জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ও মুখপাত্র মো. ওমর ফারুক ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও আনুষঙ্গিক শর্তাবলী বিবেচনা করেই ওইসব প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে ব্যবসায়ী পরিচয় দেখা হয়েছে কারও কোন দলীয় পরিচয় আমাদের জানা নেই।
বন্দরের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহানের শেষ সময়ে গত ২৬ এপ্রিল ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়। যদিও বহু বছর ধরে চলে আসা লাইসেন্স প্রথা ২০০৭ সালে বাতিল করা হয়। এরপর শিপ হ্যান্ডলিং এবং বার্থ অপারেটিং প্রথা চালু করা হয়। অর্থাৎ টেন্ডারের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু কোনো আবেদন আহ্বান না করে একযোগে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়।
নতুন করে লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল শিপ হ্যান্ডলিং অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেল সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কুতুবদিয়া বহিনোঙর ও অন্যান্য বিশেষায়িত জেটিতে আসা দেশি বিদেশি জাহাজের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রেগুলেশনস ফর ওয়ার্কিং অব চিটাগং পোর্ট (কার্গো অ্যান্ড কনটেইনার) ২০০১ এর প্রবিধানমালা অনুসরণ না করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ও দরপত্র ছাড়া নতুন শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর তালিকাভুক্ত করেছে। যেখানে বন্দরের কর্মকা-ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে কুতুবদিয়া, বহিনোঙর ও অন্যান্য বিশেষায়িত জেটিতে কাজের জন্য দরপত্র ছাড়া শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর তালিকাভুক্তি ও নিয়োগ করা অত্যন্ত অযৌক্তিক ও বেআইনি।
লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হল- শালুটিকার অ্যাসোসিয়েটস, কে এ এস ট্রেডিং, আরিয়ান ট্রেডার্স, খুলনা ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস, এন এমটি-এমএসএন, ব্রিজেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, জিডি হারবার সার্ভিসেস, লামিসা এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল, গুড অ্যালায়েন্স সার্ভিসেস, আহমেদ মেরিটাইম লজিস্টিকস, আর কে করপোরেশন, শাহী শিপিং অ্যান্ড ট্রেডং, মা ট্রেডিং, এস ট্রেডিং, তাইফুল এন্টারপ্রাইজ, কিউ এন এস গ্লোবাল লজিস্টিকস, কেয়ার শিপিং অ্যান্ড ফ্রেইট, ওশেন কন্ট্রাক্টিং অ্যান্ড সাপ্লাইং ফার্ম, গফুর ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, এস এস কনসাল্টিং এবং এ বি করপোরেশন। তবে তালিকায় এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা আবেদনকারীর নাম উল্লেখ নেই। ঠিকানা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের ১৬টি। ঢাকার প্রতিষ্ঠান ৫টি। আর যশোর এবং খুলনার ১টি করে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পেয়েছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে- চট্টগ্রাম ও ঢাকার বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী, এমপির পরিবারের সদস্য, তাদের স্বজনদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে এবং তাদের সুপারিশে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এক উপ-মন্ত্রীর সুপারিশে লাইসেন্স পেয়েছে চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক চট্টগ্রামের একজন মন্ত্রীর স্ত্রী। বরিশালের সরকারদলীয় মন্ত্রী-মেয়র এবং মেয়র প্রার্থী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, মন্ত্রীর পিএসও রয়েছেন লাইসেন্স পাওয়ার তালিকায়। ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতা ও চট্টগ্রামের একজন কাউন্সিলরও লাইসেন্স পেয়েছেন। এক প্রতিমন্ত্রী এবং এক এমপির সুপারিশে পৃথক লাইসেন্স পেয়েছেন দুই ভাই।
শিপ হ্যান্ডলিং অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অপারেটররা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে শ্রমশান্তি বজায় রেখে দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করছে। করোনার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনশীলতা বজায় রেখেছে। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবেও বন্দরের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে অপেশাদার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে লাইসেন্স তুলে দেয়ায় বন্দরের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এসব লাইসেন্স বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও চাপের মুুখে পিছু হটেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে- সর্বশেষ ১৯৮২ সালে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের লাইসেন্স দেয়া হয়। এই দীর্ঘ সময়ে পণ্য আমদানি ছয় থেকে সাত গুণ বেড়েছে। পণ্য আমদানি বাড়ায় এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে নতুন করে লাইসেন্স দেয়া হয়। এর ফলে হ্যান্ডলিং অপারেটরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে তাতে হ্যান্ডলিং খরচ কমবে আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের উপর। বন্দরের সার্বিক উৎপাদনশীলতা আরও বাড়বে বলে দাবি করেন বন্দরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন- লাইসেন্স দেয়া মানেই সবাই অপারেটর হয়ে গেলেন তা নয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডারের মাধ্যমেই কাজ দেয়া হবে। যারা বন্দরের শর্ত পূরণ করতে পারবেন তারা তালিকাভুক্ত হবেন। রাজনৈতিক পরিচয় নয়, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা এর মালিকদের ব্যবসায়ী হিসেবেই বিবেচনা করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কে হবেন বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটার?
বোলারদের নৈপুণ্যে অল্প টার্গেটেও স্বপ্ন দেখছে পাকিস্তান
৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামোর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে: আমিনুল হক
পিরোজপুর প্রেসক্লাব নির্বাচন শামীম সভাপতি ও তানভীর সম্পাদক
বিরক্তিকর সময়কে গুডবাই বলুন! এন্টি ডোট হিসেবে সেরা অ্যাপ (পর্ব-১)
দেশের বিরাজমান সংকট উত্তরণে জাতির আস্থা তারেক রহমান : মীর হেলাল
টোল প্লাজায় দুর্ঘটনা: বাসের ব্রেকে সমস্যা ছিল, চালক নেশা করতেন
পাবনার আমিনপুরে মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে আগুন, শঙ্কিত পরিবার
দেশে এলো ভিভোর নতুন ফ্ল্যাগশিপ এক্স২০০
বিএনপির দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হলে কাউকে ছাড় নয়: শাহ সুলতান খোকন
সচিবালয়ে অস্থায়ী প্রবেশ পাসের জন্য বিশেষ সেল গঠন
যুদ্ধের দামামা, তালেবানের পাল্টা হামলায় ১৯ পাকিস্তানি সেনা নিহত
ফিরে দেখা ২০২৪: ফুটবলে ঘটনাবহুল বছর
বড় চমক অ্যাপলের, জ্বর ও হার্ট অ্যাটাকের আগেই সতর্ক করবে ইয়ারবাডস
রাস্তাটি সংস্কার করুন
থার্টি ফাস্ট নাইট এবং প্রাসঙ্গিক কথা
ইসলামী শক্তির সম্ভাবনা কতটা
কিশোরগঞ্জে দুই নারীর রহস্যজনক মৃত্যু, গ্রেফতার-১
সাধারণ মানুষের স্বস্তি নিশ্চিত করা জরুরি
দেশের পরিস্থিতি ঠিক না হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা