ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১
২৩ লাইসেন্সের ২০টিই পেলেন আওয়ামী লীগ নেতারা

চট্টগ্রাম বন্দরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়ে তোলপাড়

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

২১ মে ২০২৩, ১০:৪৪ পিএম | আপডেট: ২২ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হচ্ছে। বন্দরের বহিনোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের জন্য ‘শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর’ হিসেবে যে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ২০টির মালিক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। অথচ পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের মতো জটিল ও বিশেষ কাজের অভিজ্ঞতাও নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। এ ঘটনায় বন্দর শিপিং সেক্টরে তোলপাড় চলছে। অভিযোগ রয়েছে- লাইসেন্স পেতে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য আবেদন জমা থাকলেও কোন প্রকার টেন্ডার আহ্বান ছাড়াই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপিদের সুপারিশেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙরে বড় জাহাজ থেকে বছরে সাড়ে ছয় কোটি টন পণ্য খালাস করা হয়। বর্তমানে ৩২টি প্রতিষ্ঠান বহিনোঙরে পণ্য খালাসে নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের আমদানি পণ্য খালাস করে। বাকি ২৭টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আমদানিকারকের পণ্য খালাসে নিয়োজিত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দরে শ্রমিক অসন্তোষ রোধসহ নানা কারণে যে লাইসেন্স প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই প্রথাকে আবার ফিরিয়ে আনা হলো। অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেয়ার ফলে পণ্য হ্যান্ডলিংসহ বন্দরের সার্বিক উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সাথে পেশিশক্তির কাছে বন্দর জিম্মি হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বন্দরের বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে এসব লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশনা দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন।

এ বিষয়ে বন্দরের অবস্থান জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ও মুখপাত্র মো. ওমর ফারুক ইনকিলাবকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও আনুষঙ্গিক শর্তাবলী বিবেচনা করেই ওইসব প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে ব্যবসায়ী পরিচয় দেখা হয়েছে কারও কোন দলীয় পরিচয় আমাদের জানা নেই।

বন্দরের সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহানের শেষ সময়ে গত ২৬ এপ্রিল ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়। যদিও বহু বছর ধরে চলে আসা লাইসেন্স প্রথা ২০০৭ সালে বাতিল করা হয়। এরপর শিপ হ্যান্ডলিং এবং বার্থ অপারেটিং প্রথা চালু করা হয়। অর্থাৎ টেন্ডারের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু কোনো আবেদন আহ্বান না করে একযোগে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়।

নতুন করে লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল শিপ হ্যান্ডলিং অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুজ্জামান রাসেল সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কুতুবদিয়া বহিনোঙর ও অন্যান্য বিশেষায়িত জেটিতে আসা দেশি বিদেশি জাহাজের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রেগুলেশনস ফর ওয়ার্কিং অব চিটাগং পোর্ট (কার্গো অ্যান্ড কনটেইনার) ২০০১ এর প্রবিধানমালা অনুসরণ না করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ও দরপত্র ছাড়া নতুন শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর তালিকাভুক্ত করেছে। যেখানে বন্দরের কর্মকা-ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে কুতুবদিয়া, বহিনোঙর ও অন্যান্য বিশেষায়িত জেটিতে কাজের জন্য দরপত্র ছাড়া শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর তালিকাভুক্তি ও নিয়োগ করা অত্যন্ত অযৌক্তিক ও বেআইনি।

লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হল- শালুটিকার অ্যাসোসিয়েটস, কে এ এস ট্রেডিং, আরিয়ান ট্রেডার্স, খুলনা ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস, এন এমটি-এমএসএন, ব্রিজেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, জিডি হারবার সার্ভিসেস, লামিসা এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল, গুড অ্যালায়েন্স সার্ভিসেস, আহমেদ মেরিটাইম লজিস্টিকস, আর কে করপোরেশন, শাহী শিপিং অ্যান্ড ট্রেডং, মা ট্রেডিং, এস ট্রেডিং, তাইফুল এন্টারপ্রাইজ, কিউ এন এস গ্লোবাল লজিস্টিকস, কেয়ার শিপিং অ্যান্ড ফ্রেইট, ওশেন কন্ট্রাক্টিং অ্যান্ড সাপ্লাইং ফার্ম, গফুর ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, এস এস কনসাল্টিং এবং এ বি করপোরেশন। তবে তালিকায় এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা আবেদনকারীর নাম উল্লেখ নেই। ঠিকানা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের ১৬টি। ঢাকার প্রতিষ্ঠান ৫টি। আর যশোর এবং খুলনার ১টি করে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পেয়েছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে- চট্টগ্রাম ও ঢাকার বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী, এমপির পরিবারের সদস্য, তাদের স্বজনদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে এবং তাদের সুপারিশে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এক উপ-মন্ত্রীর সুপারিশে লাইসেন্স পেয়েছে চট্টগ্রামের একটি প্রতিষ্ঠান। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক চট্টগ্রামের একজন মন্ত্রীর স্ত্রী। বরিশালের সরকারদলীয় মন্ত্রী-মেয়র এবং মেয়র প্রার্থী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, মন্ত্রীর পিএসও রয়েছেন লাইসেন্স পাওয়ার তালিকায়। ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতা ও চট্টগ্রামের একজন কাউন্সিলরও লাইসেন্স পেয়েছেন। এক প্রতিমন্ত্রী এবং এক এমপির সুপারিশে পৃথক লাইসেন্স পেয়েছেন দুই ভাই।

শিপ হ্যান্ডলিং অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অপারেটররা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে শ্রমশান্তি বজায় রেখে দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করছে। করোনার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনশীলতা বজায় রেখেছে। এ কারণে আন্তর্জাতিকভাবেও বন্দরের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে অপেশাদার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে লাইসেন্স তুলে দেয়ায় বন্দরের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এসব লাইসেন্স বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও চাপের মুুখে পিছু হটেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হচ্ছে- সর্বশেষ ১৯৮২ সালে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের লাইসেন্স দেয়া হয়। এই দীর্ঘ সময়ে পণ্য আমদানি ছয় থেকে সাত গুণ বেড়েছে। পণ্য আমদানি বাড়ায় এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে নতুন করে লাইসেন্স দেয়া হয়। এর ফলে হ্যান্ডলিং অপারেটরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে তাতে হ্যান্ডলিং খরচ কমবে আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের উপর। বন্দরের সার্বিক উৎপাদনশীলতা আরও বাড়বে বলে দাবি করেন বন্দরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন- লাইসেন্স দেয়া মানেই সবাই অপারেটর হয়ে গেলেন তা নয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডারের মাধ্যমেই কাজ দেয়া হবে। যারা বন্দরের শর্ত পূরণ করতে পারবেন তারা তালিকাভুক্ত হবেন। রাজনৈতিক পরিচয় নয়, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা এর মালিকদের ব্যবসায়ী হিসেবেই বিবেচনা করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের

গরমে যেন শেষ সিলেট !

গরমে যেন শেষ সিলেট !

গল টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা

গল টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা

প্রেতাত্মাদের উসকে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন হাসিনা

প্রেতাত্মাদের উসকে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন হাসিনা

ময়মনসিংহে অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ছয় সদস্য গ্রেপ্তার

ময়মনসিংহে অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ছয় সদস্য গ্রেপ্তার

খাগড়াছড়িতে হামলা, প্রতিবাদে ইবির আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

খাগড়াছড়িতে হামলা, প্রতিবাদে ইবির আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নানকে জেলহাজতে প্রেরণ

সুনামগঞ্জে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম.এ মান্নানকে জেলহাজতে প্রেরণ

কালীগঞ্জে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন আটক

কালীগঞ্জে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আয়ূব হোসেন আটক

হাবিপ্রবিতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভিসি নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন

হাবিপ্রবিতে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভিসি নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন

ফ্যাসিবাদী দোসর মিডিয়া লীগে সংস্কার জরুরী

ফ্যাসিবাদী দোসর মিডিয়া লীগে সংস্কার জরুরী

যৌথবাহিনীর হাতে সিলেট আটক বিপুল পরিমান ভারতীয় পণ্য

যৌথবাহিনীর হাতে সিলেট আটক বিপুল পরিমান ভারতীয় পণ্য

পরাজিত শক্তি এবং সুবিধাবাদীরা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে লিপ্ত- বিমানবন্দরে সংবর্ধনা কালে যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুশাহীদ

পরাজিত শক্তি এবং সুবিধাবাদীরা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে লিপ্ত- বিমানবন্দরে সংবর্ধনা কালে যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা মুশাহীদ

নোয়াখালীতে জামায়াতের কর্মী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ‘জুলুম-নির্যাতন করে আস্তাকুঁড়ে চলে গেছেন কাদের মির্জা’

নোয়াখালীতে জামায়াতের কর্মী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ‘জুলুম-নির্যাতন করে আস্তাকুঁড়ে চলে গেছেন কাদের মির্জা’

পুলিশের সামনে হামলা বিএনপি ও যুবদল নেতা আহত

পুলিশের সামনে হামলা বিএনপি ও যুবদল নেতা আহত

গাজীপুরে ছুটির দিনেও ২৫ শতাংশ কারখানা খোলা ছিল

গাজীপুরে ছুটির দিনেও ২৫ শতাংশ কারখানা খোলা ছিল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা

তিন জেলাসহ সাত বিভাগের ওপর দিয়ে বইছে তাপপ্রবাহ

তিন জেলাসহ সাত বিভাগের ওপর দিয়ে বইছে তাপপ্রবাহ

তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর এর বিবৃতি

তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর এর বিবৃতি

দুই দিনেই পরাজয়ের ধ্বনি শুনছে বাংলাদেশ

দুই দিনেই পরাজয়ের ধ্বনি শুনছে বাংলাদেশ

ছাত্রআন্দোলনে শহীদ ছাত্রদলনেতা ওয়াসিমের কবর জিয়ারতে কেন্দ্রীয় নেতারা

ছাত্রআন্দোলনে শহীদ ছাত্রদলনেতা ওয়াসিমের কবর জিয়ারতে কেন্দ্রীয় নেতারা