আতঙ্কের নাম বজ্রপাত
২৪ মে ২০২৩, ১১:১০ পিএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১২:০৩ এএম
ঝড়বৃষ্টি হলেই গ্রামের মানুষের মধ্যে বজ্রপাতের আতঙ্ক দেখা দেয়। বিশেষ করে যারা মাঠেঘাটে কাজ করেন তাদের মধ্যে শুরু হয়েছে বজ্রপাত নিয়ে আতঙ্ক উদ্বেগ। যখন তখন বজ্রপাত হতে পারে এবং আক্রান্ত হলে মাঠ থেকে ঘরে নাও ফিরতে পারেন এ ভীতিই তাদের মধ্যে কাজ করছে। আবার ঝড়বৃদ্ধির সময় মাঠে যেতেই হয়, ক্ষেতমজুর-কৃষকদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। গত মঙ্গলবার সারাদেশে একদিনে বজ্রপাতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকালও মৃত্যের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সারাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এক কোটি তাল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা করা হয়। সারাদেশে ৩৮ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে প্রকল্প মাঠে মারা গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তালগাছ মরে গেছে। অথচ আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এখন প্রায় ঝড়বৃষ্টি চলতেই থাকবে। ঝড়বৃষ্টি হলেই বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়ে যায়।
দেখা যাচ্ছে, এবারও ঝড় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়েছে বজ্রপাত। প্রচ- তাপদাহের পর বৃষ্টি প্রশান্তি না এনে বজ্রপাতের আতঙ্ক নিয়ে এসেছে। বৃষ্টি আর ঝড় হলেই বজ্রপাতে মৃত্যু যেন অনিবার্য।
ফিনল্যান্ড ভিত্তিক বজ্রপাত বিষয়ক গবেষণাসংস্থা ভাইসালার তথ্য মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে যারা মারা যান, তাদের ৭০ ভাগই কৃষক বা যারা খোলা মাঠে কাজ করেন। এছাড়া বাড়ি ফেরার পথে ১৪ শতাংশ এবং গোসল ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশের বজ্রপাতের ফলে মৃত্যু হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, শহরে বেশিরভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক দ- থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুতেমন হয়না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। তাদের কথা দেশের হাওড় এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানকার বেশিরভাগ ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে তা মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটিপায় সেখানে গিয়ে পড়ে। বৃক্ষহীন হাওর এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় মাঠে বা খোলা জায়গায় যেখানে উঁচু কোনো গাছ নেই বা বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নেই সেখানে যারা থাকেন তারা শিকার হন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে বজ্রপাতে কমবেশি ২৬৫ জনের মৃত্যু হয়। গত এক যুগে তিন হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন বজ্রপাতে। ২০২১ সালে মারা গেছে ৩৬৩ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন এবং ২০১৫ সালে ১৬০ মারা গেছেন। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের গবেষণা সেলের প্রধান আবদুল আলীমের মতে, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ দুইটি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গাছ বিশেষ করে মাঠের উঁচু গাছ কেটে ফেলা। হাওর অঞ্চলের মাঠে আগেও তেমন গাছ ছিল না। এখন অন্যান্য এলাকার গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে মাঠে বা খোলা জায়গায় যে সব মানুষ থাকেন বজ্রপাতের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিবাহী উঁচু জিনিস হিসেবে সেই মানুষকেই পায়। মানুষ না থাকলে মাঠের গবাদি পশু। ফলে মানুষ মারা যায়, গবাদি পশুও মারা যায়।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বজ্রপাত প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন বাঁচাতে সারাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এক কোটি তাল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলো সরকার। সারাদেশে ৩৮ লাখ চারা রোপণের পর দেখা যায় তা এক বছরের মধ্যেই অযতেœ অবহেলায় মারা যায়। এই পরিকল্পনা যথার্থ ছিলো না বলে মনে করেন বজ্রপাত বিশেষজ্ঞরা। কারণ তারা মনে করেন তালগাছ রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও এগুলো বড় হয়ে মানুষের চেয়ে উঁচু হতে ২০-৩০ বছর সময় লেগে যায়। তাদের মতে এখন প্রয়োজন হলো, ফাঁকা জায়গাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র এবং টাওয়ার স্থাপন করা। টাওয়ারের উপরে লাইটিনিং প্রটেকশন সিস্টেম বসাতে হবে। এর দুইটি পদ্ধতি আছে লাইটিনিং অ্যারেস্টর ও এয়ার টার্মিনাল। অল্প সময়ে সহজ পদ্ধতি হলো বজ্র নিরোধক দন্ড। এগুলো বসাতে হবে। দীর্ঘ পরিকল্পনায় তাল গাছ, নারকেল গাছ লাগানো যেতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে বৃষ্টিপাত থাকতে পারে টানা পাঁচ দিন। মঙ্গলবার বিকেল থেকে শুরু হওয়া ঝড়ের সময় বজ্রপাতে সারাদেশে মারা গেছেন ১৪ জন। এদের মধ্যে নরসিংদীতে ৫ জন, পাবনায় ২ জন, কুড়িগ্রামে ২ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২ জন, নওগাঁয় একজন, পটুয়াখালীতে একজন ও কিশোরগঞ্জে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও ইনকিলাবের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, গতকাল নরসিংদী জেলার সদর, রায়পুরা, মনোহরদী ও শিবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে নারীসহ ৫ জন মারা গেছেন। নিহতরা হলেন- রায়পুরা উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের ফকিরের চর গ্রামের মোমরাজ মিয়ার স্ত্রী সামসুন নাহার (৪৫) ও নিলক্ষা ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের ইসমাইল মিয়ার ছেলে জাবেদ মিয়া (১২), মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের পাতরদিয়া গ্রামের মৃত বাদল মিয়ার ছেলে রায়হান মিয়া (২৫), শিবপুর উপজেলার দক্ষিণ সাদারচর গ্রামের খোরশেদ মিয়ার ছেলে খোকন মিয়া (৩০) ও পৌর শহরের পশ্চিমকান্দাপাড়া মহল্লার সুকুমার রায়ের ছেলে শুপ্তকর (১৪)।
পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশা ইউনিয়নের বেতুয়ান গ্রামের মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে ২ কৃষি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, চাটমোহর উপজেলার সাইকোলা নদীপাড়া এলাকার মো. রুমিজ (২৮) ও শাকিল (২০)। এছাড়া ভাঙ্গুড়ায় পৃথক বজ্রপাতে শিক্ষার্থীসহ আরো ১৪ জন আহত হয়েছেন। কুড়িগ্রামের উলিপুর ও চিলমারী উপজেলায় বজ্রপাতে ২ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের গণক পাড়ার শাহাজালাল (৪৫) ও চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের বাগানবাড়ী এলাকায় অবরু শেখ (৫০)। নওগাঁর রানীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নের ভবানিপুর গ্রামে ক্ষেত থেকে ভুট্টা ওঠানোর সময় বজ্রপাতে জামিল হোসেন (২২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় পৃথক বজ্রপাতে মারা গেছেন দুজন। তারা হলেন- নাসিরনগর উপজেলার গোয়ালনগর ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের মতি মিয়ার ছেলে মোজাম্মেল হক (৩২) ও উপজেলার মানিকপুরের বাসিন্দা মনু মিয়া (৪৫)। পটুয়াখালী জেলার দশমিনা উপজেলা সদর ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে গরু নিয়ে ফেরার পথে বজ্রপাতে মো. আবদুর রব হাওলাদার (৬০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় একটি গরুও মারা যায়।কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার আগানগর ইউনিয়নের লুইন্দা খলাপাড়া গ্রামে বজ্রপাতে কাজী জিল্লুর রহমান (৫০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে হয়েছেন। তিনি পৌর শহরের জগন্নাথপুর লক্ষ্মীপুর মাক্কু মোল্লা ফুড কারখানায় চাকরি করতেন।
আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হামিদ মিয়া জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় ঝড় বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এসময় দিন ও রাতের তাপমাত্রা কমতে পারে। এই পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে বেড়ে আগামী পাঁচ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
র্যাকের সভাপতি আলাউদ্দিন আরিফ, সাধারণ সম্পাদক তাবারুল
ব্রাহ্মণপাড়ায় আলোচিত শফি উল্লাহ হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১
ফরিদপুরের ধলার মোড়ে ৮ম ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত
খালেদ মুহিউদ্দীনকে কী পাঠ পড়ালেন ড. আলী রীয়াজ
জানুয়ারিতে আরও ৫০ মডেল মসজিদ উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা
আটঘরিয়ায় বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আলোচনা সভা ও মিছিল
আগে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
মহাবিশ্বের সুদূর পারে মিলল অতিকায় মহাসাগরের সন্ধান
‘সচিবালয়ে আগুন প্রমাণ করে দুস্কৃতিকারীরা সক্রিয়, সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে’
নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের পণ্যবাহী ধর্মঘটে অচল আশুগঞ্জ নদী বন্দর
মাহমুদুর রহমান’কে হত্যাচেষ্টা মামলার অগ্রগতি শুন্য
সচিবালয়ে আগুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার চক্রান্ত: ইউট্যাব
মির্জাপুরে ঘর ভেঙে দিয়ে সরকারি জমি উদ্ধার
নামাজ পড়ে সাইকেল উপহার পেলো ৫৬ শিশু
দৌলতদিয়ায় আগুনে গবাদি পশুসহ বাড়ি পুড়ে ছাই
ভারতের সাথে বন্ধুত্ব চাই সমমর্যাদার ভিত্তিতে: আলতাফ হোসেন চৌধুরী
মাদারীপুরে ২ পক্ষের সংঘর্ষে বাবা-ছেলেসহ নিহত ৩, আহত ১০
মাত্র ২ ডলার টিপস দেয়ায় গর্ভবতী মহিলাকে ১৪ বার ছুরিকাঘাত
সেলিনার পর ডুয়া, বছরের শেষেই বাগদান সারতে চলেছেন পপ গায়িকা
'তুই প্রফেসরগিরি দেখাস আমার সাথে'