সাগর একই ‘নিয়ম’ দুই
২৪ মে ২০২৩, ১১:৩৮ পিএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৩, ১২:০২ এএম
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। গত ২০ মে থেকে শুরু হওয়া নিষিদ্ধ সময় চলবে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রজনন মওসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ। দেশীয় হাজারো ট্রলার-নৌযান ঘাটে ঘাটে অলস বসে আছে। দুই মাসেরও বেশিদিন কর্মহীন বাংলাদেশের জেলেরা খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। তবে বসে নেই প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্রলার-নৌযান বহর। বরং বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ঢুকে মাছ চুরি ও লোপাট করে নিয়ে যাচ্ছে ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ডের ট্রলার নৌযানগুলো। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ফিশারি ঘাটে অলস বসে থাকা মাছধরা ট্রলারের কয়েকজন জেলে মাঝি-মাল্লা জানালেন, এমনিতেই ভারত, মিয়ানমারের ট্রলার নৌযানগুলো সুযোগ বুঝে বাংলাদেশের সীমানা থেকে প্রায় সময়েই মাছ ধরে নিয়ে যায়। এটা নিয়মিত সমস্যা। সাগরে নিষেধাজ্ঞার সময়ে আরো মরিয়া হয়েই তারা দাপিয়ে বেড়ায়।
দেশের মৎসজীবীরা বলছেন, নিষিদ্ধ সময়ে তাদের উৎপাত বেড়ে যায়। লাভবান হয় তারাই। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের টহল অভিযানে ভারতীয়সহ প্রতিবেশি দেশের মাছধরা ট্রলার নৌযান প্রায়ই আটক হচ্ছে। যে হারে প্রতিবেশী দেশের ট্রলার নৌযানগুলো বাংলাদেশের সীমানায় এসে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে তুলনায় ওইসব ট্রলার নৌযান আটক হয় কম। জেলেরা জানান, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্বে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন প্রান্তের মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের এবং খুলনা-চালনা-দুবলারচরের কাছাকাছি দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতীয় ট্রলার নৌযানগুলো এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। তাছাড়া ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকান ট্রলারের জেলেরা খুব দুর্ধর্ষ, ধূর্ত-ধুরন্ধর। তারা দেশীয় জেলেদের ধাওয়া এমনকি হামলাও করে। কোস্টগার্ডের গতিবিধি দেখলে এবং ধাওয়া খেলেই তারা ক্ষিপ্রবেগে পালিয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মো. হোসেন জামাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মাছধরায় স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) থাকাকালীন আমাদের জেলেরা সাগরে যায় না। এ সময়ে এখতিয়ার শুধু কোস্ট গার্ডের। আমাদের জেলেরা না গেলেও ভারত, মিয়ানমার, থাই জেলেরা মাছ ধরছে। লাভবান হয় তারাই বেশি। সুযোগ তো তারা নেবেই। ওদের ঠেকাতে কোস্ট গার্ড যথেষ্ট চেষ্টা করে। তারা যথেষ্ট কর্মক্ষম। কিন্তু অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তবে পাহারা আরো জোরদার করতে হবে।
ভিন্ন ভিন্ন নিষিদ্ধ সময়
সাগরে বাংলাদেশের যখন মাছধরায় ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে এবং বাংলাদেশি জেলে-মাঝিরা ট্রলার-নৌযান ঘাটে ঘাটে বেঁধে রাখে, ওই সময়ে ভারতসহ বঙ্গোপসাগরের পাশর্^বর্তী দেশসমূহের জন্য মাছ শিকারের ‘বৈধ’ সময়। ভারতীয় জেলেদের তখন পোয়াবারো! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই বঙ্গোপসাগর। অথচ দুই ‘নিয়ম’ কেন হবে? বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অন্যান্য দেশের জেলেরা মাছ ধরায় বঙ্গোপসাগর ‘জালমুক্ত ও জেলেমুক্ত’ থাকছে না। ১৪ জুন বঙ্গোপসাগরে ভারতের মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের জেলেদের ২৩ জুলাই পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। জেলেদের অভিযোগ, সাগরে মাছ ধরা বন্ধের সুযোগ নিয়ে ভারতীয় ও প্রতিবেশী আরো দেশের জেলেরা বাংলাদেশ অংশ থেকে মাছ সাবাড় করে নিচ্ছে। এর ফলে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন নিরাপদ হচ্ছে না। উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল মিলছে কম। মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা ফলপ্রসূ হওয়া প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী ড. হোসেন জামাল বলেন, এখানে সমস্যাটা হলো স্থলভাগের মতো বঙ্গোপসাগর তো সীমানা বেড়া বা ওয়াল ঘেরা নয়। সমুদ্র তো একটাই। নিষেধাজ্ঞার সময় ভিন্ন ভিন্ন কেন হবে? এপাশের মাছ ওপাশে যাবেই। তাই বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলংকা যৌথভাবে সমঝোতা ও সমন্বয় করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে স্যাংশন রাখা সম্ভব। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে মাছের ডিম ছাড়া বা প্রজনন সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে। এ বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দরকার। বঙ্গোগসাগর পাশর্^বর্তী দেশগুলোর যৌথ গবেষণার আলোকে মৎস্য প্রজননকালীন নিষেধাজ্ঞার সঠিক সময় প্রয়োজনে পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।
মাছধরায় নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সমুদ্রে দূষণ রোধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন ড. হোসেন জামাল। তিনি বলেন, দুই ভাবে বঙ্গোপসাগর দূষিত হচ্ছে। এক. স্থলভাগ ও উপকূলভাগ থেকে প্লাস্টিক-পলিথিন, কঠিন ও অপচনশীল বর্জ্য, রাসায়নিক ও বিষাক্ত যাবতীয় বর্জ্য-আবর্জনা ইত্যাদি সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। দুই. সাগরে জাহাজ, ট্যাংকার, ট্রলার নৌযান থেকে জ্বালানি তেল, পোড়া তেলসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর বর্জ্য সাগরে ফেলা হচ্ছে। নানামুখী দূষণের ফলে সামুদ্রিক মাছ ও হরেক জীববৈচিত্র্যের বিচরণ, প্রজনন, উৎপাদন প্রক্রিয়া মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাপক দূষণের লাগাম টেনে ধরা গেলে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের প্রজননে তা অনেক সহায়ক হবে।
সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি
বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় দেড় দশকের ব্যবধানে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫ লাখ ১৭ হাজার ২৮১ টন, আর ২০২১-২২ অর্থবছরে আহরণের পরিমাণ দাঁড়ায় রেকর্ড ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন। গত ১৩ বছরে সমুদ্রে মাছ উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ টন, যা ৪০ শতাংশেরও বেশি। গত এক বছরের ব্যবধানে মাছ উৎপাদন বেড়েছে ২৮ হাজার ৭২৩ টন। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫ হাজার ৮৭১ টন এবং ২০১৯-২০ সালে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ১০৪ টন মাছ ধরা হয়। সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর সূত্রে একথা জানা গেছে।
সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. হোসেন জামাল ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে আমাদের পানিসীমায় মাছের স্টক বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রজনন মওসুমে উৎপাদন বাড়াতে মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকার সুফল আমরা ইতোমধ্যে পাচ্ছি। আগের চেয়ে বড় সাইজের ইলিশ ধরা পড়ছে। তার মানে বেশিদিন সাগরে থাকার ফলে এবং জেলের জালে ধরা না হওয়ায় বড় সাইজ হচ্ছে। এটা অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সূচক বহন করছে। দেশের সমুদ্রসীমায় প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্রলার নৌযান এসে যদি মাছ ধরে নিয়ে না যায় তাহলে মাছের মজুদ ও উৎপাদনশীলতা আরো বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে মাছের বিচরণশীল পরিবেশ ও পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হলে মাত্রাতিরিক্ত হারে মাছধরা রোধ করতে হবে। বিদেশি ট্রলার নৌযান যাতে কোনমতেই দেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে মাছ শিকার করতে না পারে এর জন্য টহল তৎপরতা জোরদার করতে হবে। কেননা ওরা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ও বড় জাতের মাছ ট্রলারে মাছ রেখে কম দামি ‘অপ্রয়োজনীয়’ ও ছোট মাছ (ট্রাশ ফিশ) সাগরেই ফেলে দিয়ে যায়। এতে করে পোনাসহ অসংখ্য ছোট জাতের মাছ ও মাছের খাদ্যজীব মারা পড়ে। দলে দলে হাঙরের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। সাগরের পরিবেশ, মাছের স্থিতি, ভারসাম্য নষ্ট হয়।
মৎস্যসম্পদ নির্বংশ করছে ওরা
ভারতীয় জেলেরা দেশের পানিসীমায় এসে অবৈধভাবে মাছ শিকারই শুধু নয়; ট্রলিং জাহাজ নিয়ে সাগরের তলদেশে হরেক জাতের মাছের পোনা ও অন্যান্য জীববৈচিত্র নির্বংশ করছে। জেলে ও মৎস্যজীবীরা জানান, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার জেলেরা বড় বড় ক্ষিপ্রগতির ট্রলার নৌযান নিয়ে দেশের পানিসীমায় ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে ভারতীয় জেলেরাই বেশি তৎপর। তারা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে কোস্ট গার্ড আসতে দেখলে দ্রুত পালিয়ে যায়।
জেলেরা জানান, যে সব এলাকায় মাছের ঘনত্ব ও দামি মাছের আধিক্য রয়েছে সেখানে বিদেশি জেলেরা মাছ চুরি করতে আসে। ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ পাঁচ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে। তারা মাছের পোনা নিধন করছে। কড়া নজরদারির মধ্যেও ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরছে। আবার অভিযানে ধরাও পড়ছে। জব্দ ও বাজেয়াপ্ত হচ্ছে তাদের অবৈধ ট্রলার নৌযান। গত ছয় বছরে বাংলাদেশের পানিসীমায় ঢুকে মাছ শিকারের দায়ে এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় জেলেকে পাকড়াও করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, নির্বিচারে মাছ শিকারের পরিণতিতে গালফ অব থাইল্যান্ডে অনেক আগেই মাছ উজাড় হয়ে গেছে। আমাদের বঙ্গোপসাগরের ‘ব্লু-ইকোনমি’র অন্যতম দিক মৎস্যসম্পদ সুরক্ষায় সময় থাকতে সচেষ্ট হওয়া অপরিহার্য। তাছাড়া এ যাবৎ পরিচালিত সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ জরিপ ও গবেষণাসমূহেও একই গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দেশসেরা ব্র্যান্ডগুলোকে পুরস্কৃত করলো বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম
হাড়িদিয়া যুব সমাজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় শরিফ একাদশ চ্যাম্পিয়ন
কালীগঞ্জে আড়ম্বরপূর্ণ জুবিলী উপলক্ষে দুইদিন ব্যাপী উৎসব
বেগমগঞ্জে জুমার নামাজ শেষে ফেরার পথে বিএনপি কর্মিকে গুলি ও জবাই করে হত্যা
নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই দেশে পরিপূর্ণ সংস্কার হবে: আমিনুল হক
সাংবাদিক বশিরসহ জনবাণী’র সম্পাদকের উপর হামলার ঘটনায় ডিআরইউ-র্যাকের উদ্বেগ
রামগতিতে ভিক্ষুকের জমি রেজিস্ট্রি না দেয়ায় লাশ দাফনে বাঁধা
র্যাকের সভাপতি আলাউদ্দিন আরিফ, সাধারণ সম্পাদক তাবারুল
রাষ্ট্রদূত হলেন সেনাবাহিনীর ২ সিনিয়র কর্মকর্তা
ব্রাহ্মণপাড়ায় আলোচিত শফি উল্লাহ হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১
ফরিদপুরের ধলার মোড়ে ৮ম ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত
খালেদ মুহিউদ্দীনকে কী পাঠ পড়ালেন ড. আলী রীয়াজ
জানুয়ারিতে আরও ৫০ মডেল মসজিদ উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা
আটঘরিয়ায় বিএনপির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আলোচনা সভা ও মিছিল
আগে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
মহাবিশ্বের সুদূর পারে মিলল অতিকায় মহাসাগরের সন্ধান
‘সচিবালয়ে আগুন প্রমাণ করে দুস্কৃতিকারীরা সক্রিয়, সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে’
নৌযান শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের পণ্যবাহী ধর্মঘটে অচল আশুগঞ্জ নদী বন্দর
মাহমুদুর রহমান’কে হত্যাচেষ্টা মামলার অগ্রগতি শুন্য
সচিবালয়ে আগুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করার চক্রান্ত: ইউট্যাব