কোরবানির পশুর চামড়া সিন্ডিকেটের দখলে
০১ জুলাই ২০২৩, ১১:০৯ পিএম | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
কোরবানির পশুর চামড়া সিন্ডিকেটের দখলে। যার কারণে এবার কোরবানির ঈদেও পশুরু চামড়ার যথাযথ দাম পাওয়া যায়নি। দেশের মাদরাসা ও এতিমখানার আয়ের অন্যতম উৎস কোরবানির পশুরু চমড়া দাম না পাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন হচ্ছে এসব ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যথাযথ দাম না পাওয়ায় অনেক মাদরাসায় এতিমদের ভরণপোষণের জন্য সংগৃহিত কোরবানির পশুর চামড়া লবন দিয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চামড়ার দাম না পাওয়ায় ঢাকার অদূরে সাভারের হেমায়েতপুর ট্যানারি সংলগ্ন মাঠে অস্থায়ী টিসেড তৈরি করে এলাকার বিভিন্ন মাদরাসার এতিমখানায় দানকৃত কোরবানির পশুর চামড়া লবন দিয়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এসব মাদরাসার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন। হেমায়েতপুরের মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি আব্দুল্লাহ ফিরোজী গতকাল শনিবার এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চলতি বছর দেশে কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও দাম গতবছরের তুলনায় খুব একটা বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। যার কারণে মাদরাসা ও এতিমখানার মতো প্রতিষ্ঠান যাদের আয়ের একটি অন্যতম উৎস কোরবানির পশুর চামড়া তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাদরাসার এতিমখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার তারা গতবারের তুলনায় কিছুটা কম চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আর দামও ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০০ টাকার মধ্যেই উঠানামা করেছে। যার কারণে খুব একটা আয়ের মুখ তারা দেখতে পাচ্ছেন না।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, এ বছর সারা দেশে ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে এক কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কোরবানি হয়েছে। এরমধ্যে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু। বাকি পশুদের মধ্যে মহিষ, ছাগল ও ভেড়া উল্লেখযোগ্য। গত বছরের তুলনায় এবার ৯১ হাজারের বেশি পশু কোরবানি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ৬০০ টাকা করে হিসাব করলেও দেশে এবার শুধু গরুর চামড়ার বাজারের আকার ২৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বেশি হবার কথা।
সরকার এ বছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে বিক্রি করতে গিয়ে এর চেয়ে কম দাম পেয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠছে। সিন্ডিকেটের প্রতিবাদে বিশ হাজার চামড়ায় লবন দিয়ে রেখেছে বিজিএলসি। সরকারের তরফ থেকে মূল্য বেঁধে দেওয়া পরেও সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না দেশের এতিমখানা মাদরাসাগুলো। সিন্ডিকেটের প্রতিবাদে সাভারের যমযম নূর গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফেজ মাওলানা নূর মোহাম্মদ এবং ইত্তিহাদুল উলামা সাভার উপজেলার সভাপতি ও যাদুরচর মাদরাসার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা আলী আকবর কাসেমীর উদ্যোগে বাংলাদেশ গ্রীন লেদার কোম্পানী (বিজিএলসি) নাম দিয়ে বৃহত্তর ঢাকা জেলা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জের প্রায় চল্লিশটি মাদরাসার আঠারো হাজার চামড়া লবন দিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে রাখা হয়েছে।
এদিকে, রাজধানী ঢাকার তেজতুরী বাজার এলাকায় অবস্থিত রহমতে আল ইসলাম মিশন এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ১৩০০ মতো ছেলে-মেয়ে আবাসিকভাবে পড়াশুনা করেন। এদের কারো কাছ থেকেই বেতন বা থাকা-খাওয়ার খরচ নেন না তারা। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আট শতাধিক শিক্ষার্থী এতিম। পুরো প্রতিষ্ঠানটির অর্থের বড় যোগান আসে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সার্বিক সহযোগিতা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট থেকে। খরচের কিছু অংশ আসে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ থেকে যদিও এর পরিমাণ বর্তমানে খুবই কম।
ইসলাম বলেন, এবছর ৯৫৮টি চামড়া শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছেন তারা। এসব চামড়া প্রতিটি ৪০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন তারা। এবছর তেমন একটা আয় হয়নি বলেন তিনি। এই আয় এই প্রতিষ্ঠানটির মোট বার্ষিক খরচের তুলনায় খুবই নগন্য বলে জানান তিনি। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের কোরবানির ঈদে তাদের সংগ্রহে ছিল ১০১২টি চামড়া। তবে সেবছরও দাম অনেকটা একই রকম গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কত বছর আগে চামড়ার দাম ভাল পেয়েছেন জানতে চাইলে ইসলাম বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে তারা চামড়ার বেশ ভাল দাম পেয়েছেন। সেসময় প্রতিটা চামড়া তারা দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২৩০০-২৪০০ করে বিক্রি করেছেন বলে জানান। “ওই সময় যা হইতো (টাকা) এখন তো তার অর্ধেকও পাওয়া যায় না।” তিনি বলেন, “এসময়(কোরবানির সময়) আমরা ১৮ লাখ, ১৬ লাখ, এই রকম বেশিও পাইতাম আরো। এখন তো কয়েকটা বছর ধইরা এতো দাম কম, একেবারেই কম। ইসলামি সমাজ এমন একটি সমাজ, যে সমাজে পরস্পর সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন সম্প্রীতি বর্তমান থাকে। এ জন্য এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ. আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘(রহ নবি) আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না।’ (সুরা দুহা, আয়াত-৮) এতিমদের প্রতি যে সম্পদ ব্যয় করবে তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া উচিত।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আহারের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও (আল্লাহর ভালোবাসায়) অভাবী, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। (এবং তারা বলে) শুধু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার্য দান করি। বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না।’ (সুরা দাহর, আয়াত-৮, ৯)। আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। এই প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মাহমাদুল এহসান বলেন, বর্তমানে তাদের অধীনে ১৪০ জনের মতো ছেলে মেয়ে রয়েছে। এবছর তারা একেবারেই চামড়া সংগ্রহ করতে পারেননি। যেখান থেকে খবর পেয়েছেন সেখান গিয়ে নিয়ে এসেছেন চামড়া। তবে সেটাও হাতে গোনা কিছু। তাদের সংগ্রহ করা চামড়ার পুরোটাই গরুর চামড়া। এহসান জানান, যে চামড়া তারা সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলো বিক্রিও করেছেন খুব কম দামে। “খুব বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছি এমন না। চারশ, সাড়ে চারশ এমন দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে(প্রতিটি গরুর চামড়া)। ”
তিনি জানান, বর্তমানে চামড়া সংগ্রহ কমে যাওয়ার নানা রকম কারণ রয়েছে। আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে চামড়ার দামও। মি. এহসান বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও তারা বেশ চড়া দামে চামড়া বিক্রি করেছেন। চামড়া থেকে লাখ টাকা আয় হলেও সেটি কমে এখন হাজারে নেমে এসেছে। “চামড়া থেকে আমার তেমন টাকা আসতেছে না। খুব সামান্য আসতেছে,” বলেন তিনি। এদিকে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে খাত সংশ্লিষ্টরা চাহিদার তুলনায় বিপুল পরিমাণ চামড়া উৎপাদন হওয়াকে দায়ী করছেন। একই সাথে চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে রপ্তানী কমে যাওয়া বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, রফতানি কমে যাওয়া প্রভাব পড়েছে স্থানীয় চামড়া বাজারে। যার কারণে কমে গেছে দাম। চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ হলেও সেখানে রফতানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের সনদ এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিবেশ স্বীকৃতি সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনটিই নেই বাংলাদেশের। এ কারণে ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না।
রফতানি কমার পেছনে সরকারকে দোষারোপ করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালে সরকার অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে পরিবেশবান্ধব পরিবেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা থাকবে বলে আশ্বাস দিলেও সেটা শেষমেশ হয়নি। এছাড়া খুব বেশি ট্যানারি সেখানে গিয়ে স্থায়ী হতে পারেনি। সরকার অবশ্য এর আগে বলেছিলে যে, চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে গত বছরের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক আওয়ামী লীগ তা কখনও চায়নি : শিমুল বিশ্বাস
এনপি জনগণকে নিয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবে- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এজেডএম ডাঃ জাহিদ হোসেন,
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামীলীগের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার
শেখ হাসিনা ও শামীম ওসমানসহ ৩৬ জনের নামে নারায়ণগঞ্জে মামলা।
আড়াইহাজারে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার
গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ
ছাত্র জনতার এই অর্জনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চলছে-জামায়াত নেতা আব্দুল করিম
সরকার পতন আন্দোলনের মূল কারিগর তারেক রহমান : রিজভী