দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে : আইএমইডি
০৭ জুলাই ২০২৩, ১১:৩৩ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম
দেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক লবিংয়ের সুযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতে প্রকল্পে অযোগ্য সরবরাহকারীরা কাজ পাচ্ছে বলে আইএমইডি›র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হচ্ছে একটি লুটেরা মডেল। এই ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গত ১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার গচ্চা গেছে। ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়। বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তৈরি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ আসবে না এমন দাবিও মিথ্যা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে স্থানভেদে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রির সুবিধা রাখা এবং সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেবে এ দুটি শর্তই যথেষ্ট, সঙ্গে সহজ শর্তে ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়টিও থাকবে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চলমান ১২ প্রকল্পের মধ্যে ৭টির বাস্তবায়ন মেয়াদ ইতোমধ্যে ৭ থেকে ৯ বছর সময় পেড়িয়ে গেছে। কিন্ত এসব প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭৪শতাংশ। অন্যদিকে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে একটি প্রকল্পে বাস্তবায়িত অগ্রগতি মাত্র ৩০দশমিক৮৬ শতাংশ কাজ হয়েছে আইএমইডি›র এক প্রতিবেদনে বলা হয়। এছাড়া পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলেতেও নি¤œমানের যন্ত্রপাতি সরবাহের কারণে বিদ্যুৎ খাতের লোকসান ক্রমগত বেড়ে চলছে। দুর্নীতির কারণে অনেক প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ছে। এতে প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের বিদ্যুৎগ্রাহকরা। সম্প্রতি আইএমইডির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্ত্রণালয়, সচিবালয় কেন্দ্রীক ক্রয় কমিটি, সিপিটিইউ (সেন্টার প্রকিউমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) একদল দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা সরকারি ক্রয় আইন ও ক্রয় বিধিমালার দোহাই দিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে অযোগ্য (মূলত চীনা ও ভারতীয়) সরবরাহকারীদের পুনবার্সন কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে। উন্মুক্ত দরপত্রের সর্বনি¤œ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার নাম করে, বিদ্যুৎ খাতে যাবতীয় নি¤œমানের যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, নিশ্চয়তাহীন মেশিন ঢুকে গেছে। খুচরা যন্ত্রাংশ ও সাপোর্ট সিস্টেমের নামে ব্যালেন্স অব প্ল্যান্ট (বিওপি) খাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে শত কোটি ডলার, বলা হয় প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রাজনৈতিক লবিং এবং অযোগ্য ভেন্ডরের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কারণে (গ্যারান্টিহীন এফজিএমও) বড় ধরনের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণে আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে (এএফআর) বাস্তবায়ন না থাকায় ডিষ্ট্রিবিউশনের লোডও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্ট্রোল করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিভাগের বড় প্রকল্পগুলো সাধারণ টার্ণ-কী পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হয়। এতে দেখা যায় বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। ঠিকাদার সংস্থার ইচ্ছা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা হয়ে থাকে। বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইএমইডি থেকে বলা হয়, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকর্তার অবহেলা, দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ বা অন্য কোনো অসদুপায়ের কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা কিংবা ব্যয় বৃদ্ধি পেলে উক্ত কর্মকা-ের জন্য সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিতে আওতায় আনতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বড় সমস্যা হলো দক্ষ জনবল এবং অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের বদলির ভুল পলিসি, স্বয়ক্রিয় সিস্টেম (স্ক্যাডা) না থাকা। বহু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বয়ংক্রিয় কন্ট্রোল করার জন্য অটোমেটিক জেনারেশান কন্ট্রোল (এজিসি) কিংবা ফ্রি গভর্নর মুড অপারেশন (এমজিএমও) বাস্তবায়ন নেই। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাত বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি। এসব সমাধানে দরকার মেধাবী, দূরদর্শী, ভবিষ্যতমুখী স্বচ্ছ ও দায়বন্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ বিভাগের চলমান ৬৭টি প্রকল্পের অগ্রগতি প্রকাশ করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের আওয়াধীন দপ্তরগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি হতাশাব্যাঞ্জক বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চলমান ১২ প্রকল্পের মধ্যে ৭টির বাস্তবায়ন মেয়াদ ইতোমধ্যে ৭ থেকে ৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্ত এসব প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৭৪শতাংশ। একটি প্রকল্প ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে,তার অগ্রগতি মাত্র ৩০দশমিক ৮৬শতাংশ। পিজিসিবির ১৭ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ ৭ থেকে ৯ বছর ধরে চললেও তার ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৫১শতাংশ। এই সংস্থার ৬টি প্রকল্প ৪-৬ বছর ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোর বাস্তব অগগতি ৫০শতাংশ। একইভাবে পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৬টি প্রকল্পে ৪-৬ বছর ধরে চললেও তার ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৪৮ শতাংশ। এছাড়া ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো, ইজিসিবি, এসপিসিএল, সিপিজিসিবিএ ও স্রেডার বাস্তবায়ন অগ্রগতিও হতাশাব্যাঞ্জক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিদ্যুত প্রকল্পগুলো প্রায়শই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের গতির সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রিড উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন নির্মাণ কাজ যথাসময়ে সমাপ্ত হয়না। এতে সময়মতো পাওয়ার ইভ্যাকুয়েশন সুবিধা সৃষ্টি করা যায় না। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের লিমিডেটের (পিজিসিবি) প্রকল্পে ধীর গতির কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হওয়ার পরেও সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্ভব হয় না। আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (উত্তর) প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম জেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গতির সঙ্গে সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজের সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা না করে অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প নেওয়ার কারণে কখনো প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। প্রকল্প দপ্তরের অদক্ষতার কারণেও প্রকল্পের কাজের গতি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। বিপিডিবির বাস্তবানাধীন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় দ্বিতীয় ব্লকের ভূমি উন্নয়ন সংরক্ষণ ও সীমানা দেয়াল নির্মাণ প্রকল্পে সব কেনার কাজ সরাসরি পদ্ধতিতে করার পরেও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হয়নি। এছাড়া একই কারণে সোলার স্ট্রীট লাইটং গ্রোগ্রাম ইন সিটি কর্পোরেশন প্রকল্পের কাজে ৫ বছরে মাত্র ১২শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবিকে লোকসান গুনতে হবে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। এর আগের ১২ বছরে সংস্থাটি লোকসান গুনেছে ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার মোট যা লোকসান করেছে, তার চেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে গত দুই অর্থবছরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর কারণ, জ্বালানি ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের সরবরাহ করতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়।
আইএমইডি বলছে, ইউনিটপ্রতি উচ্চমূল্য, ক্যাপাসিটি ও ওভারহোলিং চার্জ, স্বল্পমূল্যে জ্বালানি ও জমি ক্রয়; সহজে ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তি এবং শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা বন্ধ না করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের তহবিল সংকটের সমাধান নেই। গত ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি নামে বিশেষ আইন করে সরকার। আইনটি দায়মুক্তি আইন নামেই বেশি পরিচিত। এ আইন বিদ্যুৎ খাতে লোকসান বয়ে আনছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, দায়মুক্তির সুযোগ দেওয়া এ আইনের বলে বিদ্যুৎ খাতের ইউনিটপ্রতি ক্রয়মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জসহ হিসাব করলে দেখা যায়, কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি বার্ষিক গড় মূল্য ১০০ টাকাও ছাড়ায়। মার্কিন ডলারে অর্থ পরিশোধ করা হয় বলে এতে পিডিবির লোকসান থামানো যাচ্ছে না। এই দুর্বৃত্তায়ন থামানো জরুরি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ মিনিটের গোলে পয়েন্ট হারাল মায়ামি
ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়
ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক