পীর-আওলিয়াদের প্রতি ইলতুতমিশের অশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা-১
১৪ জুলাই ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম | আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
ভারতের মুসলিম সুলতান-স¤্রাট-শাসকগণের অধিকাংশই ছিলেন ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ও অনুসারী। ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে অবিস্মরণীয় অবদান। বিশেষ করে প্রথম দিকের সুলতান-স¤্রাট ও শাসকগণ রাজ্যবিজয় ও সা¤্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি ইসলামের বিকাশ ও প্রসারকে তাদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারত বিজয়ের সূচনা পর্বের সুলতান মাহমুদ, মুহম্মদ ঘোরী, কুতুবুদ্দিন আইবেক, ইলতুতমিশ, গিয়াসুদ্দিন বলবন প্রমুখ সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিজেতাই ছিলেন না, ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রসংগঠক ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা। ইসলামের প্রতি তাদের অনুরাগও ছিল অশেষ। ভারতে সম্পূর্ণ নতুন একটি সভ্যতা, সংস্কৃতি ও যুগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা। দিল্লি মুসলিম শাসনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দিল্লির সুলতান-স¤্রাটদের দরবার শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি চর্চার উত্তম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। খ্যাতিমান বিদ্বান, পন্ডিত, ঐতিহাসিক, কবি-সাহিত্যিক, আলেম-ওলামা, সুফী, পীর-মাশায়েখ সুলতান-স¤্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।
দিল্লির সুলতানদের মধ্যে ইলতুতমিশের অবস্থান, ভূমিকা ও অবদান সম্বন্ধে পূর্ববর্তী নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ড. এ এম এ হাবিবুল্লাহর মতে, কুতুবুদ্দিন আইবেক দিল্লির সালতানাতের কেবল গোড়াপত্তন করেছিলেন আর ইলতুতমিশ নিঃসন্দেহে ছিলেন এর প্রকৃত প্রথম সুলতান। এ মন্তব্যের সত্যতা অনস্বীকার্য। সুলতান হিসেবে, শাসক হিসেবে, নির্মাতা হিসেবে, বিচারক হিসেবে, দানবীর হিসেবে তার তুলনা তিনি নিজেই। এর বাইরেও তার জীবন ও চরিত্রে কিছু বিশেষ গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ লক্ষ করা যায়। তার সমকালীন ঐতিহাসিক মিনহাজুস সিরাজ বলেছেন, তার মতো ধার্মিক, দয়ালু, বিদ্বান, আলেম-ওলামা ও অলি-আওলিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল সুলতান দিল্লির সিংহাসনে দ্বিতীয়জন আরোহণ করেননি। তার দরবারে বহু জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত, আলেম-ওলামার সমাবেশ ঘটেছিল। স্মরণ করা যেতে পারে, মধ্য এশিয়ার মঙ্গলদের আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে ভারতে বিশেষ করে দিল্লিতে নিরাপত্তা লাভের আশায় ওইসব এলাকা থেকে জ্ঞানী-গুণী ও আলেম-ওলামা-পীর-আওলিয়াগণ ব্যাপক সংখ্যায় চলে আসেন। তাছাড়া ভারতে নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সা¤্রাজ্যে ইমলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠার একটা তাগিদও তাদের মধ্যে ছিল। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন, সুলতান ইলতুতমিশ আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, অলি-আওলিয়াদের প্রতি পরম ভক্তি ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। যখন বিখ্যাত কোনো আলেম, পীর বা আওলিয়া দিল্লিতে আসতেন, তিনি বহুদূর থেকে তাকে এগিয়ে আনার জন্য মিছিল সহকারে যেতেন। তিনি তাদের দিল্লিতে থাকার জন্য অনুরোধ করতেন। শেখ জালালুদ্দিন তাবরিজি দিল্লিতে এলে তিনি তাকে যথেষ্ট সমাদর করেন। পরে নানা কারণে তিনি বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হন। বাংলায় ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তার অসামান্য অবদান রয়েছে। দিল্লি থেকে দূরে অবস্থান করলেও অনেক সূফী ও আওলিয়াকে তিনি দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানাতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পছন্দ করতেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির খলিফাদের মধ্যে খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি ও শায়েখ হামিদুদ্দিন সূফী সাওয়ালী নাগোবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শায়েখ হামিদুদ্দিন সূফী সাওয়ালী নাগোবীতে (রাজস্থানের একটি প্রত্যন্ত এলাকা) বসবাস করতেন। তিনি কৃষিকাজ করে জীবন নির্বাহ করতেন। থাকতেন ফকিরের মতো। অথচ তিনি বিজ্ঞ আলেম ছিলেন, আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন, প্রখ্যাত লেখক ছিলেন। তার রচিত সুরুরুস সুদুর ও উসুলে তরিকায়ে ওলামায়ে সুফিয়া বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ। তাকে একবার সুলতান ইলতুতমিশ দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে আসতে আমন্ত্রণ জানান, যে অনুষ্ঠানে শায়েখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া মুলতানীও উপস্থিত ছিলেন।
সুলতান ইলতুতমিশের এই পীর-আওলিয়া প্রীতি আশৈশবকালের। তিনি শৈশবে কিছুদিন বাগদাদে ছিলেন। তখন যুগশ্রেষ্ঠ আওলিয়া শায়েখ সোহরাওয়ার্দী ও আহাদুদ্দিন কিরমানির মতো মনীষীদের সান্নিধ্যে আসেন। তার হৃদয়ে সুফী ভাবাবেগের সূত্রপাত সেখান থেকেই। পরবর্তীকালে তার বিকাশ ও পরিবৃদ্ধি ঘটে। তিনি হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির খলিফা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির পরম ভক্ত ছিলেন। তার পূর্বসূরী সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক ও খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি পরম শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবাক, কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির নামে দিল্লিতে নির্মিত ইসলামের বিজয়ের স্মারক মিনারের নামকরণ করেন কুতুব মিনার। কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ তিনি শেষ করতে পারেননি। এ কাজ প্রায় সর্বাংশে শেষ করেন ইলতুতমিশ। খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি তার শ্রদ্ধাভক্তি কতটা ছিল, এ থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি যখন তার খানকা ছেড়ে মূল দিল্লিতে আসতেন তখন সুলতান তাকে অশেষ সম্মান সমাদর করতেন। তবে কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি রাজ দরবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পছন্দ করতেন না। সুলতান স্বয়ং তার খানকায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি সুলতান ইলতুতমিশের ভক্তি-শ্রদ্ধা কতটা গভীর ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় একটি ঘটনায়। খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকির প্রতি সুলতানের বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন দরবারের অনেকে ভালোভাবে নিতে পারতেন না। তারা তার প্রতি ঈর্ষাবোধ করতেন। একথা জানতে পেরে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকিকে আজমীরে নিয়ে যেতে মনস্থ করেন। এ সংবাদে দিল্লির সর্বপর্যায়ের মানুষ হতবিহবল হয়ে পড়ে গভীর দুঃখে কাতর হয়ে পড়ে। মানুষ দলে দলে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। এ সম্পর্কে একজন লেখক লিখেছেন, খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি যখন তার পীর খাজা আজমীরীর সঙ্গে আজমীর রওনা হন তখন অসংখ্য মানুষ মিছিল করে তার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। তারা পথে পথে তার পদস্পর্শিত ধুলি কুড়াতে থাকে। তার প্রতি সারা শহরের মানুষের এই ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখে খাজা আজমীরী তাকে নিয়ে যাওয়া অসমীচীন মনে করেন। তাকে রেখেই তিনি আজমীরে ফিরে আসেন। উল্লেখ আবশ্যক, ওই গণমিছিলে স্বয়ং সুলতান ইলতুতমিশ শামিল ছিলেন। খাজা আজমীরীর সিদ্ধান্তে সুলতান অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত হন। খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দিল্লিতে ফেরেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ধামরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম কবিরের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
ঢাকা মহানগর মিশুক চালক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনী সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
খুলনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে যুবক আহত
কুমিল্লা জজকোর্টের ৩ পিপি-এপিপিকে সংবর্ধনা
চুয়াডাঙ্গার রেলস্টেশন এলাকা থেকে ১৪টি অবৈধ স্বর্ণেরবার উদ্ধার, আটক ৩
জাহাজে ৭ খুনের ঘটনার দ্রুত সুরাহা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
‘ছাত্র-জনতা সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছে’
পঞ্চগড়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করতে হবে: পীর সাহেব চরমোনাই
‘ট্রানজিটের নামে দিল্লিকে দেয়া করিডর জনগণ মেনে নেয়নি’
বদলির ৩ মাস পরই পূর্বের কর্মস্থলে ফিরলেন শরীয়তপুরে সদর হাসপাতালের ক্যাশিয়ার বজলুর রশিদ
বগুড়ায় যথাযথ মর্যাদায় বড়দিন পালন
শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক
সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি
রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও
আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০
কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার