ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১
কৃচ্ছ্রতা সাধনের নমুনা

আমলারা পাচ্ছেন দামি গাড়ি

Daily Inqilab পঞ্চায়েত হাবিব

০২ আগস্ট ২০২৩, ১১:২০ পিএম | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

আগামী ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সরকারি কর্মকর্তাদের ঠিক রাখতে গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই তা শিথিল করে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা এখন আগের চেয়ে বেশি দামের গাড়ি পাবেন। এর আগে সরকারি গাড়ি ব্যবহারে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়ে ছিলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গতবচল ২৭ অক্টোবর শুদ্ধাচার কৌশলপত্র বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বৈঠকে এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগেই সরকারি কর্মকর্তারা দামি গাড়ী পাচ্ছেন।

নির্দেশনায় গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার গাড়ি কেনা যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। ২০১৯ সালে এটি ছিল ৯৪ লাখ টাকা। গত মঙ্গলবার রাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে সোমবার প্রজ্ঞাপনটির অনুমোদন হয়।
একে তো ৩০ লাখ টাকার সুদমুক্ত ঋণে কেনা গাড়ি, তার ওপর রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ মাসে ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছে সরকার। উপসচিব থেকে সচিব মর্যাদার সরকারি কর্মচারীরা তিন বছর আগে থেকেই এমন সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু সুবিধাটির ব্যাপক অপব্যবহার করছেন একশ্রেণির প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তা।

গত ২ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে ও কৃচ্ছ্র সাধনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি দপ্তরে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় বন্ধ থাকবে বলে পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের সরকারি কর্মচারীদের জন্য যানবাহন ক্রয় বা বরাদ্দের ক্ষেত্রে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। গত সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কার, জিপ, পিকআপ, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, অ্যাম্বুলেন্স, কোস্টার বা মিনিবাস (এসি/ননএসি), বাস (ননএসি) ও ট্রাকের বাজারদর বিবেচনা করে যানবাহনের মূল্য পুনর্র্নিধারণ করা হলো। গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য জিপ (অনূর্ধ্ব ২ হাজার ৭০০ সিসি) কেনা যাবে ট্যাক্স ও ভ্যাটসহ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকায়। গ্রেড-৩ বা তার নিচের কর্মকর্তাদের জন্য জিপের (অনূর্ধ্ব ২ হাজার সিসি) দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৫ লাখ টাকায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের জিপের দাম ছিল ৯৪ লাখ টাকা এবং গ্রেড-৩ বা তার নিচের কর্মকর্তাদের জন্য ছিল ৫৭ লাখ টাকা। রেজিস্ট্রেশন ও ভ্যাটসহ কারের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা (অনূর্ধ্ব ১ হাজার ৬০০ সিসি)। ২০১৯ সালে যা ছিল ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ, এবার মূল্য ১০ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া পিকআপ (সিঙ্গেল কেবিন) ৩৮ লাখ টাকা এবং ডাবল কেবিন পিকআপের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ লাখ টাকা। মোটরসাইকেল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা, মাইক্রোবাস ৫২ লাখ টাকা, অ্যাম্বুলেন্স ৫৪ লাখ টাকা, কোস্টার বা মিনিবাস ৭৫ লাখ টাকা, ননএসি মিনি বাস ৩২ লাখ টাকা, বড় ও ননএসি বাস ৪৬ লাখ টাকা, ৫ টন ট্রাকের দাম ৩৯ লাখ এবং ৩ টন ট্রাকের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, একশ্রেণির কর্মকর্তা গাড়ি ঠিকই কিনছেন, কিন্তু তা পরিবারের সদস্যদের জন্য। সেসব গাড়ির জন্য মাসে মাসে জ্বালানি খরচও নিচ্ছেন তাঁরা। আর নিজেরা চলাফেরা করছেন সরকারি কমন গাড়িতে। অথচ যাঁরা গাড়ি কেনার জন্য ঋণ পান না, তাঁদের জন্যই কমন গাড়িগুলো বরাদ্দ। এসব অনিয়ম রোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের এ পর্যন্ত তিন দফা চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতিই হয়নি। প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী, গাড়ির সুবিধার প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হচ্ছেন উপসচিব পদে কমপক্ষে তিন বছর পার করেছেন এমন কর্মকর্তা, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিব। সরকার গাড়ি ঋণ বিষয়ে প্রথমে ২০১৭ সালের জুনে নীতিমালা করে। এরপর সরকারি কর্মকর্তাদের স্বার্থে ওই বছরের আগস্ট–সেপ্টেম্বরে তিন দফায় এবং সর্বশেষ চলতি বছরে আরেকবার নীতিমালাটি সংশোধন হয়।

নীতিমালা অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা একবারই ঋণ পাবেন। কোনো প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর থেকে গাড়ির সুবিধা পেলেও ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে ঋণের টাকায় গাড়ি কিনলে অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। ঋণের অর্থ সর্বোচ্চ ১২০টি সমান কিস্তিতে, অর্থাৎ ১০ বছরে আদায়যোগ্য। ফলে ৩০ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে মাসিক কিস্তি দাঁড়ায় ২৫ হাজার টাকা, যা ঋণগ্রহীতার প্রতি মাসের বেতন থেকে সরকার কেটে রাখে। এককালীনও এই ঋণ পরিশোধ করা যায়।কিন্তু এক বছর না যেতেই ঋণ নিয়ে অনিয়ম শুরু হয়। তা দূর করতে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর, ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর এবং এ বছরের ৮ মার্চ সতর্ক করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দুই মাস আগে ২৩ সেপ্টেম্বর দুদকও চিঠি দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু কিছু কর্মকর্তা সুদমুক্ত ঋণের গাড়ি নিজে ব্যবহার না করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন অধিদপ্তর, সংস্থা ও উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়িতে করে অফিসে যাতায়াত করছেন। কেউ কেউ পারিবারিক কাজেও গাড়ি ব্যবহার করছেন। রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে তুলে নিচ্ছেন। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়টি রোধে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও সরকারি গাড়ি অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। নীতিমালার ব্যত্যয় ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।

অপব্যবহার রোধে নির্দেশনা
সুবিধার অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা নিতে চারটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। এগুলো হচ্ছে ১০০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে; মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না, প্রেষণ, মাঠ প্রশাসন, প্রকল্পে কর্মরত কোনো কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক সরকারি যানবাহন ব্যবহারের সুবিধা থাকলে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে নির্ধারিত অর্থের ৫০ শতাংশ পাবেন ও কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান ইনকিলাবকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী গাড়ি কেনা ও ব্যবহারের বিধি লঙ্ঘনের মাধ্যমে একশ্রেণির সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যদি এমন চিঠি দিয়ে থাকে, তাহলে শুরুর দিকে তাদের চিহ্নিত করে তিরস্কার করা যেতে পারে এবং ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে এটা সঠিক হয়নি। সরকার চাইলে পরে দিতে পারতো।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান