ঢাবি শিক্ষার্থীদের মাঝে নেই পর্যাপ্ত কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা

বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা

Daily Inqilab রাহাদ উদ্দিন

২২ আগস্ট ২০২৩, ১১:২৪ পিএম | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৩ এএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন শেখ মঞ্জরুল হক নামক এক শিক্ষার্থী। গত সোমবার বিকেলে এই ঘটনা ঘটে। মৃত্যুর পর ওই শিক্ষার্থীর সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতো মঞ্জু। কিন্তু মাঝপথে বাদ সাধে মাদকের ছোঁয়া। আর্থিক অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মঞ্জুরুল মাদকের সাথে পরিচয়ের পর থেকেই পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। টানা দুই বছর ড্রপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী মৃত্যুর পূর্বে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাস করতেন বলে জানা যায়। মঞ্জুরুল মাদকের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাওয়া, পারিবারিক চাপ, জীবন নিয়ে হতাশা অথবা নারীঘটিত সমস্যায় পড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলা ধারণা করছেন তার সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। অথচ উপযুক্ত কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের হলগুলোতে কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট (মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ) নিয়োগ দেয়া হয় না। অপরদিকে মেয়েদের পাঁচটি হলে রয়েছেন ৫ জন সাইকিয়াট্রিস্ট। কিন্তু সেখানেও রয়ে গেছে শুভঙ্করের ফাঁকি। এসব সাইকিয়াট্রিস্ট সপ্তাহে একদিন করে হলে আসেন। তাদের সিডিউল পেতে শিক্ষার্থীদের হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া রয়েছে কাউন্সিলিং সেশনের উচ্চমূল্য। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের শরণাপন্ন হন না।
ছেলেদের হলেও সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়োগের দাবি এখন অনেকের। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুলতান মাহমুদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় ৪ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই বেশি হতাশাগ্রস্ত থাকে এবং বিগত বছরগুলোতে যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মাঝে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছেলে। আমাদের প্রতিটি হলেই হাউজ টিউটর রয়েছেন কিন্তু তাদেরকে কালে-ভদ্রে দেখা যায়। তাদের উচিত শিক্ষার্থীদের সাথে দূরত্ব কমিয়ে তাদের যেকোনো সমস্যার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং প্রতিটি হলেই সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের মানসিক সেবা নিশ্চিত করা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের চারতলায় আছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ। যেখানে ‘নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট’-এ কাউন্সিলিং করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অংশ হিসেবে নয়, বরং প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম চালায় প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে প্রতি সেশন ৮০০ টাকা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ সবার জন্য একই। শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ছাড় নেই। এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে সিরিয়াল নিতে সময় লাগে অন্তত এক মাস। কখনো কখনো দেড় থেকে দুইমাসও সময় নিতে দেখা যায়। জরুরি ভিত্তিতে দেখানোর জন্য স্বাভাবিকের দ্বিগুণ টাকা (১৬০০ টাকা) ফি নেয়া হয়।
মেয়েদের ৫টি হলে সাইকিয়াট্রিস্টদের জন্য ১টি করে রুম বরাদ্দ রয়েছে। যেখানে কালেভদ্রে একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে বসতে দেখা যায়। এছাড়া সপ্তাহের পুরো সময়টাতে সেসব কক্ষে তালা ঝুলতে থাকে। এছাড়াও এসব সাইকিয়াট্রিস্টের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব নিয়েও রয়েছে নানান প্রশ্ন। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের এক শিক্ষার্থী জানান, হলে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট থাকলেও মেয়েরা ওনার কাছে যেতে চায় না। অনেকেই জানেনই না হলে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট রয়েছেন। আমি দুই তিনবার চেষ্টা করেও সিডিউল পাইনি। ফোন দিলে একটা তারিখ দেয় আবার সেই তারিখে গেলেও পাওয়া যায় না। এসব সাইকিয়াট্রিস্টের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও অবগত নয় শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, মানসিক সমস্যাগুলোর চিকিৎসা খুবই সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। যে কোনো ক্লিনিকে সাইকিয়াট্রিস্ট কাউন্সিলিং-এর জন্য হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ভিজিট দিতে হবে। আর প্রতিটি সেশন ৫০ মিনিটের হয়ে থাকে। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ১২ থেকে ১৬টা সেশন নিতে একজনের প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এমন ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেক শিক্ষার্থী।
মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলগুলোতে সিলিং ফ্যান তুলে নিয়েছে, কিন্তু হলগুলোতে সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারেনি। এছাড়া প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে অনেক শিক্ষার্থীকেই সিলিং ফ্যান ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতা স্পষ্ট। মানসিকভাবে দুর্বল কিংবা ভেঙেপড়া শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাববার সময় কি এখনো হয়নি!
ঢাবির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, আমাদের সমাজে ছেলেরা নানাবিধ সমস্যায় ভোগে যা অনেকেই দেখতে পায় না। একটা মেয়ে অনেকদিক থেকে সুবিধা পেয়ে থাকে। অথচ ছেলেদের প্রতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যাশা পাহাড়সম। কিন্তু মেয়েদের প্রতি অতটা প্রত্যাশা থাকে না। ফলে স্বভাবতই নানানরকম চাপে ছেলেদের মাঝে অনেক বেশি হতাশা কাজ করে। তাই মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আরো বেশি মানসিক সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও আমাদের মেয়েদের হলগুলোতে যেহেতু সাইকিয়াট্রিস্ট রয়েছে সুতরাং ছেলেদের হলেও থাকাটা অনেক বেশি প্রত্যাশিত।
তবে ছেলেদের হলে সাইকিয়াট্রিস্ট না থাকার বিষয়ে সরাসরি কোনো মতামত দেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অন্য উপায়ে এগুলো অ্যাড্রেস করতে হবে। আরো সোশ্যাল, কর্পোরেট রেসপন্সিবিলিটি আছে, সেভাবে এটা করতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, সচেতনতার জায়গাটা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা অ্যালামনাইয়ের সাথেও কথা বলেছি যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে সার্ভিসটার পরিধি বাড়ানো যায়।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জাহাজে ৭ খুনের ঘটনার দ্রুত সুরাহা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার
৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু
আরও

আরও পড়ুন

ধামরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম কবিরের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

ধামরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম কবিরের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

ঢাকা মহানগর মিশুক চালক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনী সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

ঢাকা মহানগর মিশুক চালক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনী সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

খুলনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে যুবক আহত

খুলনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে যুবক আহত

কুমিল্লা জজকোর্টের ৩ পিপি-এপিপিকে সংবর্ধনা

কুমিল্লা জজকোর্টের ৩ পিপি-এপিপিকে সংবর্ধনা

চুয়াডাঙ্গার রেলস্টেশন এলাকা থেকে ১৪টি অবৈধ স্বর্ণেরবার উদ্ধার, আটক ৩

চুয়াডাঙ্গার রেলস্টেশন এলাকা থেকে ১৪টি অবৈধ স্বর্ণেরবার উদ্ধার, আটক ৩

জাহাজে ৭ খুনের ঘটনার দ্রুত সুরাহা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

জাহাজে ৭ খুনের ঘটনার দ্রুত সুরাহা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

‘ছাত্র-জনতা সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছে’

‘ছাত্র-জনতা সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছে’

পঞ্চগড়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত

পঞ্চগড়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির  বন্ধনকে  মজবুত করতে হবে: পীর সাহেব চরমোনাই

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করতে হবে: পীর সাহেব চরমোনাই

‘ট্রানজিটের নামে দিল্লিকে দেয়া করিডর জনগণ মেনে নেয়নি’

‘ট্রানজিটের নামে দিল্লিকে দেয়া করিডর জনগণ মেনে নেয়নি’

বদলির ৩ মাস পরই পূর্বের কর্মস্থলে ফিরলেন শরীয়তপুরে সদর হাসপাতালের ক্যাশিয়ার বজলুর রশিদ

বদলির ৩ মাস পরই পূর্বের কর্মস্থলে ফিরলেন শরীয়তপুরে সদর হাসপাতালের ক্যাশিয়ার বজলুর রশিদ

বগুড়ায় যথাযথ মর্যাদায় বড়দিন পালন

বগুড়ায় যথাযথ মর্যাদায় বড়দিন পালন

শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক

শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক

সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি

রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও

রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও

আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০

ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০

কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই

কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার

নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার