বৃদ্ধা রওশনের তেলেসমাতি
২২ আগস্ট ২০২৩, ১১:৪০ পিএম | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৩ এএম
২০০৬ সাল, উত্তাল ঢাকার রাজপথ। প্রেসিডেন্ট ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। ২০০৬ সালের নভেম্বরের একদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ‘খালেদা জিয়ার পাতানো নির্বাচনে’ অংশ নেবেন না ঘোষণা দেয়ার লক্ষ্যে বারীধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। এরশাদের ফ্লাটে গিজগিজ করছে সাংবাদিক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। কোনো এক কারণে এরশাদের সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়া বিলম্ব হচ্ছিল। হঠাৎ খবর এলো রওশন এরশাদ গুলশানের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করছেন। পরিমরি করে বারীধারা থেকে সংবাদকর্মীদের গুলশানে দৌঁড়। রওশনের বাসায় সংবাদকর্মীদের জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। খাওয়া অর্ধেক হয়েছে এমন সময় রওশন এরশাদ সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা শুরু করলেন। পাশে গোলাম মসিহ ও এস এম আলম। রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং গোলাম মসিহকে মহাসচিব ঘোষণা দিলেন। একই সঙ্গে এইচ এম এরশাদকে চেয়ারম্যান পদ থেকে এবং এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেন। ‘এরশাদ জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের বি-টীম করে ফেলেছেন’ অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনের সমাপ্তি করেন রওশন এরশাদ। স্বামী এরশাদকে ল্যাং মারার ওই সময় বনানীর ‘হাওয়া ভবন’ এ রওশন এরশাদের ঘনঘন যাতায়াত ছিল। বেগম খালেদা জিয়ার অনুগত হিসেবে নিজেকে জাহির করতে রওশন এরশাদ নানান কর্মকা- করেছেন। সেই ২০০৬ সাল থেকে ১৬ বছর পর স্বামী এরশাদের মতোই দেবর জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে গতকাল নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন রওশন এরশাদ। এবারও তার পাশে সেই গোলাম মসিহ। এবার সংবাদ সম্মেলন নয় গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করলেন। জিএম কাদের ভারত সফরে রয়েছেন। তবে রওশন এরশাদের এই দাবিকে ‘ভুয়া খবর’ বলেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। দলের অন্য শীর্ষ নেতারাও বলছেন, তারা এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তে সম্মতি দেননি।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো রওশন এরশাদের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’ এই বিজ্ঞপ্তিতে তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সই করেছেন।
রওশন এরশাদ লিখেছেন, পার্টির নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক (চুন্নু) বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আর এভাবে পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
রওশন এরশাদের পক্ষে দাবি করা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকেও তারা অব্যাহতি দিয়েছেন। দাবি করা হয়, ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির ৪ জন কো-চেয়ারম্যান ও ২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য এক সভায় অংশ নেন। সেখানে দলের কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও নাসরিন জাহান রতœা উপস্থিত ছিলেন।
তবে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ এর দায়িত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা›র বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং সংবাদে তার নামটি প্রস্তাবকারী হিসেবে ব্যবহার করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি ওই সংবাদটিকে ভূয়া ও অসত্য বলে যিনি এই সংবাদটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জি এম কাদের এমপি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল আছেন। আমরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছি।
রওশন এরশাদের দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, তাঁদের দলে বিভক্তি আনার জন্য কোনো মহল এ ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে।
বাস্তবতা হলো রওশন এরশাদ বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক কো চেয়ারম্যান নন।
জাতীয় পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ সোয়া বছর বিদেশে চিকিৎসা নেয়া রওশন এরশাদ এখনো অসুস্থ। স্বামী এরশাদের মৃত্যু, নানা রোগ ও বয়সের কারণে তিনি কার্যত স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। এরমধ্যে ১৯ আগষ্ট তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আগের মতোই ঘোষণা দিয়েছেন বরাবরের মতো এবারও জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনুগত হয়ে প্রার্থী দেবেন। রওশন নিজেও ঘোষণা দিয়েছেন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে তিনি অংশ গ্রহণ করবেন। তবে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনার মতো শারীরিক অবস্থা তার নেই। কিন্তু গোলাম মসিহসহ কয়েকজন বহিস্কৃত ও পরিত্যাক্ত নেতা অসুস্থ রওশনকে ব্যবহার করছেন। তারা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির লক্ষ্যে জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দিয়ে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। যা জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের মধ্যে নেই। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতাদের বেশির ভাগই সুবিধাবাদি চরিত্র। তাদের মধ্যে দলীয় আদর্শ নীতি নৈতিকতার বালাই নেই। তারা মূলত পদ আর ক্ষমতার মধুলোভী রাজনীতি করেন। তারা এখন জিএম কাদেরের পক্ষ্যে রয়েছেন ঘোষণা করলে তাদের চরিত্রই হচ্ছে হাওয়া দেখে পক্ষ বদল করা।
এরশাদ যখন দলের চেয়ারম্যান ছিলেন তখণ থেকেই জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আলোচনায় শীর্ষে চলে আসে জাতীয় পার্টি। প্রায় সময়ই খবরের শিরোনাম হয় ক্ষমতাসীন সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এই দলটি। এবার তার ব্যাতিক্রম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে কয়েকদফা টানাটানি হয় দেবর জিএম কাদের ওভাবি রওশন এরশাদের মধ্যে। দলের মধ্যে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়ে যায়। জি এম কাদের হন দলের চেয়ারম্যান। এখনো দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি জি এম কাদেরের হাতেই। যদিও রওশনপন্থি হিসেবে এককালে পরিচিতি পাওয়া মুজিবুল হক চুন্নু এখন দলের মহাসচিব এখন। এর মধ্যে এইচ এম এরশাদের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী বিদিশা পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন। গত বছরের ৩১ আগস্ট জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে না জানিয়েই দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কাউন্সিলের আহ্বান করা হয়। এ কাউন্সিল আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২২ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে জাপার সংসদীয় দল বৈঠক জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা করার। ওই বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু সে আবেদন কার্যকর হয়নি। তবে মাঝখানে সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়ার কারণ জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান পদ অবৈধ দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় জিএম কাদেরকে কিছুদিন দলের ‘চেয়ারম্যান পদ’ দায়িত্ব পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। এ নিয়ে বিরোধের মধ্যেই জিএম কাদের, রওশন এরশাদ ও সাদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। অতপর বিরোধ মিটে যায়।
ক্ষমতাসীনদের ‘নাচের পুতুল’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন ভারত সফরে রয়েছেন, সে সময় রওশন এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় দলে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন দলের নেতারা। যদিও জাতীয় পার্টির মহাসচিবসহ নেতাদের অনেকে বলেছেন, তারা রওশন এরশাদের এ ঘোষণার ব্যাপারে কিছুই জানেন না। দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ চলছে অনেক দিন ধরেই। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, জাতীয় পার্টিতে দুই শীর্ষ নেতার বিরোধ তত বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে জাতীয় পার্টির ভেতরে নানা আলোচনা রয়েছে। আর জি এম কাদের বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ##
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
আলবেনিয়ায় ভুয়া ভিসার নামে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে উধাও
ধামরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম কবিরের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
ঢাকা মহানগর মিশুক চালক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনী সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
খুলনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে যুবক আহত
কুমিল্লা জজকোর্টের ৩ পিপি-এপিপিকে সংবর্ধনা
চুয়াডাঙ্গার রেলস্টেশন এলাকা থেকে ১৪টি অবৈধ স্বর্ণেরবার উদ্ধার, আটক ৩
জাহাজে ৭ খুনের ঘটনার দ্রুত সুরাহা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
‘ছাত্র-জনতা সংস্কারের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছে’
পঞ্চগড়ে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা অনুষ্ঠিত
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করতে হবে: পীর সাহেব চরমোনাই
‘ট্রানজিটের নামে দিল্লিকে দেয়া করিডর জনগণ মেনে নেয়নি’
বদলির ৩ মাস পরই পূর্বের কর্মস্থলে ফিরলেন শরীয়তপুরে সদর হাসপাতালের ক্যাশিয়ার বজলুর রশিদ
বগুড়ায় যথাযথ মর্যাদায় বড়দিন পালন
শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক
সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি
রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও
আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০
কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই