দুর্যোগ অধিদপ্তরে প্রকল্পের টাকা লুটপাট
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
৬ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশে ১৩ হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এর মধ্যে ১৯৬ সেতুর পরিবীক্ষণে ৫৬টিতে ত্রুটি পেয়েছে আইএমইডি। সেতুগুলো নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের অনেক টাকা লুটপাটে সাথে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা জড়িত বলে আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রকল্পের শতভাগ প্রতিফলন হয়নি বলে জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় দেশে ১৩ হাজার সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। পরিবীক্ষণের এই প্রকল্পের ১৯৬টি সেতু সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছে আইএমইডি। তার মধ্যে ১৯৬টি সেতুর মধ্যে ৫৬টিতেই নানা ধরনের সমস্যা ও ত্রুটি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি পেয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, প্রকল্পের শতভাগ প্রতিফলন নয়। কিছু সমস্যা রয়েছে। লোকবলের ঘাটতি আছে। কিছু সেতু উঁচু। কিন্তু উঁচু না করা হলে নৌযান চলাচলে সমস্যা হতো। আইএমইডির সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়েছে। কালভার্টটি মূল সড়ক থেকে অনেকটা ভেতরে। দুই পাশে সংযোগ সড়ক সেভাবে নেই।
আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২৩টি সেতুর সংযোগ সড়ক (অ্যাপ্রোচ রোড) দেবে গেছে। ৭টি সেতুর উচ্চতা খুব বেশি, ১২টি সেতুর ক্ষেত্রে খাল সংকুচিত করা হয়েছে এবং অন্তত ১০টির ক্ষেত্রে কাজের মান খুবই খারাপ। আর ২টি সেতুর স্থান নির্বাচন সঠিক হয়নি। ২টির রেলিংয়ে এখনই ভেঙ্গে গেছে।এ প্রকল্পের অধীনে ১২ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের বক্স কালভার্ট হবে ৭ হাজার ৮০০টি। এর মধ্যে ৬ হাজার ৪২৭টি কালভার্টের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আর ১২ মিটারের বেশি গার্ডার সেতু হবে ৫ হাজার ২০০টি। এর মধ্যে মাত্র ৪৬৪টির কাজ শেষ হয়েছে। নদী’র ওপর নির্মাণ করা হয়েছে সেতুটি। এরই মধ্যে ধসে যাওয়ার উপক্রম সংযোগ সড়কের। রংপুরের পীরগাছার সোনারায় খোঁড়া নদী’র ওপর নির্মাণ হয়েছে সেতুটি। এরই মধ্যে ধসে যাওয়ার উপক্রম সংযোগ সড়কের।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আপনী আপনা পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। আমি এখন বাসায়। অফিসে আসেন বক্তব্য দিব। এখন এ বিষয়ে বলতে পারবো না।
জানা গেছে, গত ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি শুরু হয় আর গত ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও সরকারের তহবিল অপর্যাপ্ত পাওয়ায় সময়মতো দরপত্র আহ্বান করা যায়নি। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। অথচ চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৫০ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের বাকি ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ, বি এবং সি ক্যাটাগরিতে পুনর্বিন্যাস করা হয়। বি ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর সরকারি বরাদ্দের অংশের ২৫ শতাংশ কর্তন করা হয়। অর্থাৎ এসব প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। প্রকল্পটি বি ক্যাটাগরিতে থাকায় সরকার অর্থছাড় কম করেছে।
আইএমইডির প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পরিদর্শনে,এ প্রকল্পের অধীনে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় রামগড় ইউনিয়নের তোকানিয়া খালের ওপর নির্মিত ১৩ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর পার্শ্বদেয়াল কম ও রেলিং ক্রমান্বয়ে ভেঙে যাচ্ছে। পাতাছড়া ইউনিয়নের হালদা খালের ওপর নির্মিত ১৩ মিটার সেতুর পার্শ্বদেয়াল কম দেওয়ায় মাটি সরে সংযোগ সড়ক ঠিক থাকছে না। লক্ষ্মীছড়ি ইউনিয়নে নির্মিত একটি ১১ মিটার সেতুর দুই পাশের মাটি সরে গেছে ও সংযোগ সড়ক দেবে গেছে এবং সিমেন্ট পর্যাপ্ত না দেওয়ায় সেতুটির রেলিংয়ের আস্তরণ ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা ইউনিয়নের আলাইপুরের খালের ওপর ৬ মিটার কালভার্টটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। এটির পার্শ্বদেয়াল কম থাকায় দুই পাশের মাটি সরে সংযোগ সড়ক দেবে গেছে। ফলে এটি রিকশা, ভ্যান ও মোটরসাইকেল চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নে একটি সেতুর কাজ চলছে। আইএমইডির প্রতিনিধিদল দেখেছে,সেতুটির নির্মাণকাজের গুণগত মান সন্তোষজনক নয়। সড়ক থেকে অনেক উঁচু করে নির্মাণ করায় যানবাহন চলাচলেও সমস্যা হবে। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলাতেও নির্মাণাধীন একটি সেতু সড়ক থেকে অনেক উঁচুতে নির্মাণ করা হচ্ছে।
কয়লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ সোহেল রানা বলেন, কালভার্টটি মূল সড়ক থেকে অনেকটা ভেতরে। দুই পাশে সংযোগ সড়ক সেভাবে নেই। তাই সেখানে মানুষের যাতায়াতও কম। কাছেই মূল সড়ক। সেখানে কালভার্ট দরকার হলেও তা করা হয়নি। আইএমইডির প্রতিবেদন এই প্রকল্পের শতভাগ প্রতিফলন নয়। তবে কিছু সমস্যা রয়েছে। লোকবলের ঘাটতি আছে। কিছু সেতু উঁচু। কিন্তু উঁচু না করা হলে নৌযান চলাচলে সমস্যা হতো। আইএমইডির সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়েছে।
এ প্রকল্পের অধীনে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নে নির্মিত সেতুটির উচ্চতা সড়কের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ছোট যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। খালের তুলনায় সেতুর দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় খালের দুই পাশে মাটিও ভরাট করতে হয়েছে। পার্শ্বদেয়াল ছোট হওয়ায় এখনই মাটি সরে যাচ্ছে।
প্রকল্পে সেতুর যে নকশা করা হয়েছে, তাতে দুর্বলতা পেয়েছে আইএমইডি। অঞ্চল ভেদে খালের আকার ও গভীরতায় ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পে মাত্র দুটি আকৃতির নকশা ঠিক করা হয়েছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সেতুর পাশের দেয়ালও অনেক ছোট। ফলে উঁচু সেতুগুলোর সংযোগ সড়ক দেবে ভেঙে পড়ছে। কিছু সেতুর উচ্চতা সড়কের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় যানবাহন ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে হচ্ছে। পুরো প্রকল্পটিতে তদারকির ঘাটতি রয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ছাড়া আর কোনো কারিগরি লোকবল নেই। প্রকল্পটির তদারকি হচ্ছে ঢাকার মূল কার্যালয় থেকে। প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়নের অংশ হিসেবে কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ ও গোপালগঞ্জ জেলায় মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করা হয়েছিল। প্রতিটি সেতুর জন্য আলাদা নকশা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া সেতুর দুই পাশে সংযোগ অংশ ঢালাই করা, মাটি ধরে রাখতে পাকা দেয়াল নির্মাণ, কাঠের সাটারিং না করা, দৃশ্যমান সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু নির্মাণ প্রকল্প না নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
আইএমইডি নিবিড় পরিবীক্ষণে গিয়ে দেখতে পায়, মধ্যবর্তী মূল্যায়নে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, অতিপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেতু নির্মাণ প্রয়োজন হলেও ১৫ মিটার পর্যন্ত বাধ্যবাধকতা থাকায় সেতুটি প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক ফুটের জন্য সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের জুলাইয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে সেতুর দৈর্ঘ্য ২-১ মিটার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। তবে তা কার্যকর হয়নি।
প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত বাবদ বরাদ্দ না রাখায় ইতিমধ্যে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়া সেতু বা কালভার্টের সংস্কার করা হচ্ছে না। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই এগুলো ভগ্নদশায় পরিণত হবে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়।
গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান সাংবাদিকদের জানান, আসলে সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া কীভাবে এ প্রকল্পের কাজ নেওয়া হয়। এসব সেতু রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে দিনে দিনে ব্যবহার অনুপযোগী হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা
ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন
ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ
এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫
ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত
চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫
চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ,দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার
গাজীপুরে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় যুবকের মৃত্যু
সউদীতে এক সপ্তাহে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার
শহীদ মিনারে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আরাফাতের জানাজা বিকালে
নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নারীকে পুড়িয়ে হত্যা
ঘনকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০
আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!
ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ
তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী
গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস