ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

ভোগ্যপণ্যে এলসি খোলা কমছে

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১২ এএম | আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১২ এএম

ডলার সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে মন্থরগতি। এর প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৪৮ (৪৭ দশমিক ৮০ শতাংশ) শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কমেছে ভোজ্যতেল আমদানি ঋণপত্র। এছাড়া শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য এবং জ্বালানি তেলের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিও আগের চেয়ে নি¤œমুখী। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

চলমান ডলার সংকটের মধ্যে স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানির বিল পরিশোধ দেরী হচ্ছে। তাতে করে, হ্রাস পেয়েছে এলএনজি সরবরাহ। এ পরিস্থিতিতে, আরেকটি গ্যাস সংকটের মধ্যে পড়েছে – শিল্প কারখানা থেকে শুরু করে আবাসিক গ্রাহক। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজারের কারণে যখন ভোক্তাচাহিদা কমছে, এবং সিমেন্ট, ইস্পাত ও পোশাক খাতসহ প্রায় সকল শিল্পই যখন তাতে জর্জরিত – তারমধ্যেই দেখা দিল এ সংকট। স্থানীয় বাজার-নির্ভর শিল্পের পাশাপাশি বিশ্ববাজার-নির্ভর উদ্যোগগুলোর জন্যও বড় প্রতিকূলতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই গ্যাস সংকট।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে এক হাজার ৫৮৯ কোটি ডলারের। যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই (প্রথম তিন মাস) সময়ের চেয়ে ৩৪৫ কোটি ডলার বা ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৩৮ কোটি ডলার। সাম্প্রতিক ডলার সংকটের প্রভাবে এলসি খোলা কমার পাশাপাশি পুরনো এলসির দায় পরিশোধও কমেছে। আলোচিত তিন মাসে আগের এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছিল ১৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ভোগ্যপণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৪২ কোটি ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৭২ কোটি ডলার। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ভোগ্যপণ্যে আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে ৪৭ দশমিক ৮০ শতাংশ আর ভোগ্যপণ্যের ঋণপত্রে নিষ্পত্তি কমেছে ১৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। আলোচিত সময়ে ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এলসি খোলা কমেছে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের। তিন মাসে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে ৮৭ দশমিক ৪০ শতাংশ আর এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ৭২ দশমিক ৭১ শতাংশ। একই চিত্র পরিশোধিত ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও। চলতি অর্থবছরের তিন মাসে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের ঋণপত্র খোলা কমেছে ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ভোজ্যতেলের ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ৫৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। খাদ্য আমদানিতে চাল ও গম আমদানির ক্ষেত্রে কমেছে ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ডাল আমদানিতে ৪১ শতাংশ, ওষুধ ও ওষুধজাত দ্রব্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরজুড়ে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির হার ছিল নি¤œমুখী। গত অর্থবছরে নানা পণ্যের মোট এলসি খোলা হয়েছিল ৬ হাজার ৯৩৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের। এটি আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২৬ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪২৬ কোটি ৯২ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্যের এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ২১৯ কোটি ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ কম। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ আর আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ২৪৯ কোটি ডলার।

এলএনজি আমদানিতে জড়িত রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠান– রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, চলতি মাসের শুরুতে মাত্র এক কার্গো এলএনজি পাওয়া গেছে। চাহিদা মেটাতে এই মাসে তারা আরও চালান আমদানি করবেন কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। এলএনজি আমদানিতে ওমান ও কাতারের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। নিয়মিত এ সরবরাহের বাইরে স্পট মার্কেট বা খোলা বাজার থেকেও এলএনজির দুই থেকে তিনটি কার্গো আমদানি করা হয়। ডলার সংকটে আমদানির মূল্য পরিশোধে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কর্তৃপক্ষটি স্পট মার্কেটের অংশ কমাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজ কর্পোরেশনটির কর্মকর্তারা জানান, গত ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এলএনজি সরবরাহকারীদের কাছে পেট্রোবাংলার মূল্য পরিশোধ বকেয়া ছিল ১৫০ মিলিয়ন ডলার।

এদিকে তীব্র গ্যাস সংকটের এই প্রভাব শুধু ব্যবসাবাণিজ্যেই নয়, পড়ছে আবাসিক গ্রাহকের ওপরও। অনেক বাসাবাড়িতেই জ্বলছে না গ্যাসের চুলা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর সামনে অপেক্ষমাণ যানবাহনের সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী, সরবরাহ করতে হিমশিম দশা ফিলিং স্টেশনগুলোর। এদিকে আগামী ১ নভেম্বর থেকে দেশের একটি বা দুটি রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এক্সিলারেট) রক্ষণাবেক্ষণ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে, যা চলবে অন্তত দুই মাস। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ কাজের ফলে গ্যাসের এ সংকট আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত থাকতে পারে। তবে আসন্ন শীতের মাসগুলোয় গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় চাহিদা কমলে, বিদ্যমান সরবরাহ দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) প্রকৌ. কামরুজ্জামান খান বলেন, স্পট মার্কেট থেকে আমদানি বাড়াতে না পারায় এবং নতুন একটি সার কারখানায় উৎপাদন চালু হওয়ায়– সবাইকে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ‹তাছাড়া, আমরা রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করব। কাজ শেষ হওয়ার আগে সরবরাহ স্বাভাবিক করা কঠিন। গত তিন ধরে চট্টগ্রামে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট বা প্রায় ১২ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। এতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে তৈরি পোশাক খাত। গ্যাসের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায় ছোট-বড় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন চালু রেখেছে। এতে জ্বালানি খাতে তাদের ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ফলে তৈরি পোশাকের উৎপাদন কমে গেছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ)-র ভাইস চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে প্রস্তুত করা পোশাকগুলোর এখন ফিনিশিং এর কাজ চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে এসব পণ্যের শিপমেন্ট শিডিউল রয়েছে। ‹কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কারখানায় গত তিন দিন ধরে কাজ বন্ধ। উৎপাদন এভাবে আরও ব্যাহত হলে চরম সংকটে পড়ে যাব।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) একজন পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আজম বলেন,›গ্যাসের প্রেশার কম থাকলে পোশাক পণ্যের কালার কোয়ালিটি নষ্ট হয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়ে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। চট্টগ্রামের গ্যাস সংকট দীর্ঘ হলে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ীরা।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাতপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান- বিএসআরএম এর দুটি কারখানায় দৈনিক রড উৎপাদনের সক্ষমতা সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন। চারটি বিলেট কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৬ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, কাঁচামাল সংকটের কারণে এমনিতেই উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন হচ্ছে। গ্যাস সংকটে যা আরো কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান