ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১
ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ নিবাসী

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত

Daily Inqilab যশোর ব্যুরো

২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ নিবাসী রাখার সঙ্গে দীর্ঘদিনের জনবল সঙ্কটে প্রকট আকার ধারণ করছে কেন্দ্রটিতে। জনবল সঙ্কটে খালি থাকা বিভাগ ও পদগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। একই সাথে পুষ্টিগুণসম্পন্ন ও পরিমিত খাবার গুরুত্বপূর্ণ হলেও কেন্দ্রে তা পাচ্ছেন না। একজন উঠতিবয়স্ক আহারের চেয়েও কম খাবার পাচ্ছেন কেন্দ্রটির নিবাসীরা। সরেজমিন কেন্দ্রেটিতে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।

১৯৯২ সালে পাঁচ একর জমির উপর যশোর শহরতলী পুলেরহাটে প্রতিষ্ঠিত হয় এ সংশোধানাগার। প্রথমে এটি শিশু কারাগার থাকলেও সরকার পরবর্তীতে এটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র হিসাবে নামকরণ করে। বিভিন্ন কারণে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকদের প্রচলিত জেলখানায় অপরাধীদের সঙ্গে রাখার পরিবর্তে সংশোধনের জন্যে এই কেন্দ্রটি ব্যবহার করা হয়।

কেন্দ্রটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী যশোরে আসনসংখ্যা ১৫০, তবে বর্তমানে সেখানে আছে ২৮৪ জন। অর্থাৎ আসনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি নিবাসী নিয়ে কেন্দ্রটি চলছে। কয়েক মাস পর পর তিন বা সাড়ে তিনগুণও হয়ে যায় নিবাসীদের সংখ্যা। বর্তমানে অবস্থান করা নিবাসীদের মধ্যে ৬৭ জন হত্যা মামলা, ৭০ জন নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, ৬৫ জন মাদক মামলা, ৪ জন অস্ত্র মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্তরা আছে। নিবাসীদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সীর বেশি ১২ জন। এখানে থাকার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ১৮ বয়স নিবাসীরা এখানে থাকার বিধান না থাকলেও জন্মনিবন্ধন জটিলতায় আদালতের নির্দেশে তারা রয়েছেন।

কেন্দ্রটিতে অনুমোদিত পদ ৪৯, এর মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন পদে কর্মরত ২৪ জন। সহকারী তত্ত্ববাবধায়ক, প্রবেশন অফিসার, প্রসিকিউশন অফিসার, সোশ্যাল কেস ওয়ার্কার, হাউস প্যারেন্টসহ ২৫টি পদই শূন্য। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমিত বাজেট, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত জনবল, অনুন্নত সংশোধন প্রক্রিয়া, পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে। নিবাসীদের স্বজন ও সম্প্রতি কেন্দ্রটি থেকে বের হওয়া কয়েকজন কিশোরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবনমান, খাবারদাবার অত্যন্ত নিম্নমানের বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পর্যপ্ত ঘুমানোর জায়গা, বরাদ্দের অভাবে পেটপুরে খাওয়া শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো সুযোগও পাচ্ছে না শিশুরা। এসব কারণে সংশোধনের পরিবর্তে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হিংস্র হয়ে উঠেছে। আছে ‘বড় ভাই’ কালচারও। যার যাঁতাকলে পড়ে কিশোরদের জীবন ওষ্ঠাগতপ্রায়। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে আইনভঙ্গের ঘটনা।

কেন্দ্রের নিবাসীদের মাথাপিছু মাসিক বরাদ্দ ৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানি বাবদ ২ হাজার টাকা বরাদ্দ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০০ টাকা। চিকিৎসায় বরাদ্দ ১০০ টাকা। প্রশিক্ষণে ১৫০ টাকা, পোশাক ৩০০ টাকা, তেল, সাবানসহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দ ২৫০ টাকা। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই ভ্যাট, ট্যাক্স, পরিবহন, ঠিকাদারের লভ্যাংশও এর মধ্যে থেকে রাখতে হয়। কেন্দ্রে সকাল দুপুর ও রাতে ভাত ও বিকালে নাস্তা দেওয়া হয়। প্রতি নিবাসীর মাথা পিছু চারবেলার খাবারের বরাদ্দ ১০০ টাকা। এই মধ্যে ৩০ টাকা কেটে নেওয়া হয় জ্বালানির জন্য। বাকী ৭০ টাকাতে তিন বেলা খাবার ও একবেলা নাস্তা দেয়া হয়। এই বাজেটে টানা এক যুগ একজন ঠিকাদার খাবার সরবরাহ করে এলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির কারণে এতদিন পর তিনিও এই দামে খাবার সরবরাহে অপারগতা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। কেন্দ্রটির ঠিকাদার শেখ হাবিবুর রহমান সাগর বলেন, এই টাকায় তিনবেলা খাবার ও বিকালে নাস্তা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও এ কাজ করতে হয় পেশা হিসেবে। তবে খাবারে কোন ফাঁকি দেয়া হয় না। যা বরাদ্দ থাকে সেভাবে আমি খাবার সরবরাহ করে থাকি।

কেন্দ্রটিতে কিশোরদের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে নেই কোনো চিকিৎসক। এখানকার নিবাসীদের কেউ অসুস্থ হলে তাদের পাঠানো হয় যশোর জেনারেল হাসপাতালে। তাদের চিকিৎসায় নেই কোনো চিকিৎসক, কমপাউন্ডার বা নার্স। এমনকি তাৎক্ষণিক অসুস্থ হলেও চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না।
কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, শিশুদের মানসিক বিকাশে ও সংশোধনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা আছে। শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের বিভিন্ন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। ফ্লোরের ভেতরে দাবা, কেরাম ও লুডু খেলার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া মাঠে বিভিন্ন টুর্ণামেন্টের আয়োজন করা হয় বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মঞ্জুরুল হাছান বলেন, আমাদের এখানে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ নিবাসী থাকছে। প্রতিজন খাবারের জন্য বরাদ্দ রয়েছে একশ’ টাকা। এতে করে শিশুরা মানসম্মত খাবার সেভাবে পাচ্ছে না। যেহেতু বাড়ন্ত শিশুদের বেশি ও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। সেখানে ঘাটতি থাকলে তাদের শারীরিক গঠনে সমস্যা হতে পারে। রয়েছে জনবলের তীব্র সঙ্কট। খাবারের বরাদ্দ ও জনবলের চাহিদা চেয়ে আমরা প্রতিবছর মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি।
সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে ছোট বড় ৮টি সংঘর্ষেও ঘটনা ঘটেছে কেন্দ্রটিতে। এর মধ্যে মারা গেছেন সাত নিবাসী। এছাড়া আত্মহত্যা করেছে ৪ জন। সর্বশেষ কেন্দ্রের ভেতরে তিন শিশুর একসঙ্গে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর আগে কেন্দ্রটির অব্যবস্থাপনা নিয়ে ১৫ কিশোর কাঁচ দিয়ে শরীর চিরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। এছাড়া সীমানা প্রাচীরের গায়ে থাকা পানির পুরোনো পাইপ বেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ছয় কিশোর। ফলে অন্যদুটি কেন্দ্রের থেকে সব সময়ই আলোচনায় থাকে এই কেন্দ্রটি।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নড়াইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল গ্রেফতার

নড়াইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল গ্রেফতার

বিচারবিভাগ নিয়ে আজ রোডম্যাপ দেবেন প্রধান বিচারপতি

বিচারবিভাগ নিয়ে আজ রোডম্যাপ দেবেন প্রধান বিচারপতি

নেছারাবাদে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার নিহতদের স্মরণে বিএনপির আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিল

নেছারাবাদে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার নিহতদের স্মরণে বিএনপির আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিল

নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় চীন: শি জিনপিং

নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় চীন: শি জিনপিং

পতিত স্বৈরাচারের দোষর মিডিয়া আর স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে

পতিত স্বৈরাচারের দোষর মিডিয়া আর স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে

পাকিস্তান-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্টও মুলতানে

পাকিস্তান-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্টও মুলতানে

৭০টির বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইআইই-তে অংশ নেবে

৭০টির বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইআইই-তে অংশ নেবে

সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা

সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে আজ প্রতিনিধিদল যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে আজ প্রতিনিধিদল যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে

৩ হাজার কয়েদির সাজা মওকুফ অথবা হ্রাস করতে যাচ্ছে ইরান

৩ হাজার কয়েদির সাজা মওকুফ অথবা হ্রাস করতে যাচ্ছে ইরান

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর শ্রীলংকায় প্রথম নির্বাচন আজ

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর শ্রীলংকায় প্রথম নির্বাচন আজ

জুনে ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন ১৭ শতাংশ কমেছে

জুনে ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন ১৭ শতাংশ কমেছে

রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট

রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট

গারো পাহাড়ের বালু খেকোদের বিরুদ্ধে এসিল্যান্ডের সতর্কবার্তা

গারো পাহাড়ের বালু খেকোদের বিরুদ্ধে এসিল্যান্ডের সতর্কবার্তা

রেকর্ডের মালা গেঁথে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়

রেকর্ডের মালা গেঁথে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর, চীনকে ঠেকাতে কোয়াড কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর, চীনকে ঠেকাতে কোয়াড কি এখনও প্রাসঙ্গিক?

টেলর সুইফটের পর কমলাকে বিখ্যাত বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক

টেলর সুইফটের পর কমলাকে বিখ্যাত বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি

মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি