বৃষ্টি সবজির আশীর্বাদ
০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পাল্টে গেছে ষড়ঋতুর গতি-প্রকৃতি। বর্ষায় বৃষ্টি নেই, শীতে নেই শীত। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের ফলে বহুল আলোচিত খনার বচনও এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ‘যদি বর্ষে আগনে/রাজা যায় মাগনে’ খনার এই বচনের মর্মার্থানুযায়ী অগ্রহাণে বৃষ্টি হলে ফসলের ক্ষতি হয় এবং দেশে অভাব দেখা দেয়। তবে এখন আর সে অবস্থা নেই। অগ্রহায়ের এই বৃষ্টি এখন কৃষির জন্য সোনায় সোহাগা। এবার বর্ষায় বৃষ্টি হয়েছে কম। তাই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অগ্রহায়ের এই বৃষ্টি প্রকৃতিকে ভিজিয়ে দিয়েছে। এতে মাটির নিচের পানির স্তরও রিচার্জ হয়েছে। বিশেষ করে এই বৃষ্টি বরেন্দ্র অঞ্চলে (রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নওগা, নাটোর) ফসলের জন্য বেশ ভাল হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে এখনও অনেক স্থানে আমন কাটা শেষ করতে পারেনি। আবার কেউ কেটে মাড়াইয়ের অপেক্ষায়। তারা বৃষ্টি নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়লেও গতকাল মেঘের কোলে রোদের হাসি দেখে তাদের দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শীতকালীন শাক-সবজি, বিভিন্ন ফল-ফসল চাষাবাদে এ বৃষ্টি অনেক উপকার হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড় মিগজাউয়ের ফলে গত বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দিনভর বৃষ্টিপাতে মুন্সিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায় আবাদকৃত বীজ আলুর জমিতে পানি জমে যাওয়ায় রোপণ করা বীজ আলু পচে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হেমন্তের এই বৃষ্টির ফলে কৃষি খাতে এর প্রভাব নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট তুলে ধরা হলো।
রাজশাহী থেকে রজাউল করিম রাজু জানান, ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের কারণে দু’দিনের মাঝারি বৃষ্টিতে খরা কবলিত বরেন্দ্র অঞ্চলে ফসলের জন্য বেশ ভাল হয়েছে। দু’দিনে বৃষ্টি ঝরেছে ৩৬ দশমিক নয় মিলিমিটার। বরেন্দ্র অঞ্চলের এখন অনেক স্থানে আমন কাটা শেষ করতে পারেনি। আবার কেউ কেটে মাড়াইয়ের অপেক্ষায়। তারা বৃষ্টি নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়লেও গতকাল রোদ ওঠায় সে দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। এখন বরেন্দ্র অঞ্চলে চলছে আলু, ডাল জাতীয় শষ্য, গম সরিষার মসলা জাতীয় শষ্য, রসুন, জিরা ধনে আবাদ। রয়েছে শীতকালীন শাক-সবজি। আলুর দাম বেশি হওয়ায় এবার বেশি আলু আবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ বাজারে উঠছে। পেঁয়াজের চেয়ে পেঁয়াজ ফুলের (ফুলকা) দাম বেশি। বিক্রি হচ্ছে দেড় হতে দু’শো টাকা কেজি দরে। আমন কাটার পর শুরু হয়েছে বোরো আবাদের প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে বীজতলার কাজ চলছে। বৃষ্টি তাতে উপকার বয়ে এনেছে। বৃষ্টি খানিকটা হলেও পুকুর খাল বিল রির্চাজ হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে তারা এবার বরেন্দ্র অঞ্চলে বারো হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাকসবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে। বৃষ্টিতে আমনের তেমন ক্ষতির শঙ্কা নেই। কারণ বৃষ্টি থেমে প্রকৃতিতে রোদ হাসছে। প্রবীণ কৃষকরা অগ্রহায়ণে বৃষ্টিকে নিয়ে খনার বচন আউড়িয়ে বলছেন এক অগ্রহায়ণে ধান তিন শাওনে পান। আগ্রহায়ণে যদি না হয় বৃষ্টি না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি।
বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, টানা দুইদিন বৃষ্টির পর বগুড়ায় গতকাল আর বৃষ্টি হয়নি। মেঘের আড়ালে সূর্য উঁকি দিয়েছে আকাশে। এতে জমিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি শুকিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। এতে আলুসহ রবি ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা দূর হয়েছে। পরিবেশ হয়েছে স্বাভাবিক হিম শীতল। আকাশের মেঘ উড়ে গিয়ে পরিষ্কার হলে শীত নামবে পুরোপুরি। বগুড়া আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক মো. আব্দুর রশিদ জানান, আপাতত আর বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। এবার ডিসেম্বরের যে স্বাভাবিক শীতার্ত পরিবেশ থাকে তা ফিরে আসবে।
এদিকে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ প্রান্তে যে বৃষ্টি হয়ে গেল সেটা রবি ফসলের জন্য বিশেষ কল্যাণের কারণ হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে শীর্ষস্থানীয় কৃষি বিজ্ঞানী ও বগুড়াস্থ জাতীয় মশলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ড. জুলফিকার হায়দার প্রধান বলেন, এসময়টায় প্রধানতম রবি ফসল আলু, সরিষা ও পেঁয়াজের খেতে এক দফার সেচ দিতে হয়। বৃষ্টিতে সেই কাজটাই হয়ে গেল। চাষিদের সেচের খরচ কিছুটা সাশ্রয় হলো।
খুলনা থেকে আসাফুর রহমান কাজল জানান, মাঠভরা রয়েছে শীতের সবজি। উঠে গেছে আমন। হলুদ হয়েছে সরিষার খেত। এর মধ্যে দেশে ছিল ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের সতর্কতা। তা কেটে গেলেও এর প্রভাবে খুলনায় বৃষ্টি হয়েছে ২৩ মিলিমিটার। বইছে শীতল বাতাস। নেমেছে শীত। অগ্রহায়ণে এমন বৃষ্টি এবং শীতে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষছে এ অঞ্চলের কৃষকেরা।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, রূপসা, তেরখাদা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা উপজেলা এবং মেট্রোতে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে শীতকালীন সবজির আবাদ হচ্ছে ৬২ হাজার ৫৮২ হেক্টর। মাঠে এখন আমন ধান কাটা শেষ হয়ে কৃষকের ঘরে উঠেছে। শুরু হয়েছে বোরোর বীজতলার কাজ। চলছে অগ্রহায়ণ মাস। এ সময়ের বৃষ্টিতে খুলনায় শীত জেঁকে বসেছে।
জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষক সুরেশ^র মল্লিক জানান, রবি মৌসুমের সবজির জন্য খেত প্রস্তুত করছি। বীজ বুনেছি অনেক জমিতে। এমন সময় শীত এবং বৃষ্টি। এর ফলে লাভ বা ক্ষতি কি হয়েছে বুঝতে পারছি না। তবে বৃষ্টি যদি বেশি পরিমাণে হতো তাহলে হিসেব ছাড়াই বলতে পারতাম, ক্ষতি হয়েছে। যেহেতু অল্প বৃষ্টি হয়েছে তাই বলতে পারি, বৃষ্টি উপকারই করেছে।
জেলার কয়রা উপজেলার কৃষক মো. রফিকুল সরদার জানান, আমাদের এলাকায় এখনো নোনা রয়েছে। ফলে এ বৃষ্টি অনেক উপকার করেছে। কিছুটা হলেও লবণাক্ততা কমিয়েছে। এখন আর বৃষ্টি না হলে ভাল হবে। জেলার কৃষিভান্ডার খ্যাত ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইনসাদ ইবনে আমিন জানান, অল্প বৃষ্টি কৃষকের জন্য আশির্বাদ। এখন বীজতলা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে আমন ধান উঠে গেছে। ফলে কৃষক লাভের পাড়েই রয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ থেকে মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এই অসময়ের বর্ষণে জেলায় আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবাদি আলু জমিতে পানি জমে যাওয়ায় লাগানো আলু পচে যাবার আশংকা রয়েছে। জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। ইতোমধ্যে জেলায় প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে আলু চাষ হয়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বৃষ্টিতে জেলায় প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমির বপন করা আলু পচে যাবে। কৃষক আপ্রাণ চেষ্টা করেও জমিতে জমে যাওয়া পানি সরাতে পারেনি। এ ছাড়া যে সব জমিতে ইতোমধ্যে সার দেওয়া হয়েছিল সেসব জমিতে পুনরায় সার দিয়ে চাষ দিতে হবে। যে সকল জমিতে আলু গাছ বড় হয়ে গেছে সে জমির ফলন ভালো হবে।
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান থেকে ইসমাইল খন্দকার জানান, দেশের সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে খ্যাত মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে কৃষকদের চোখে এখন কষ্টের পানি। ২ দিনের বৃষ্টিতে সিরাজদিখান উপজেলার আলু ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ উপজেলার কয়েক হাজার কৃষক এখন বিপদগ্রস্ত। লগ্নি করে এবং সুদে টাকা এনে আলু ফসল রোপণ করেছেন কৃষকরা। সেই আলু এখন কৃষকের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মঙ্গলবার ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম-এর প্রভাবে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে গত বুধবার দিবাগত রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টির কারণে রোপণ করা আলুর জমি পানিতে ডুবে গেছে। এছাড়া যে জমি এখন পর্যন্ত প্রস্তুত হয়নি সে সব জমিতেও বৃষ্টির কারণে আলু রোপণে বিলম্ব হবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার কৃষকরা তাদের আলু জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য সেচ মেশিন লাগিছে। কোনো কোনো কৃষক বালতি, বাটি দিয়ে পানি সেচ করছেন। আবার কেউ কোদাল দিয়ে মাটি সরিয়ে কেল করে দিচ্ছে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে মুহাম্মদ আতিকুল্লাহ জানান, গফরগাঁও উপজেলা সদরসহ ১৫টি ইউনিয়নে দুইদিনের বৃষ্টির ফলে সবজি চাষিদের মুখে হাঁসি ফুটেছে। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ রকিব আল রানা জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের ১৯ শত হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। এগুলো হচ্ছে শীত লাউ, সিম, বেগুন, টমেটো, করলা, মুলা, পালং শাক, গম, ভুট্টা ও কাঁচা মরিচ। গতকাল পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা গেছে, বৃষ্টির ফলে সবজি চাষিদের জন্য ভাল হয়েছে। প্রতিটি ব্লকের মাঠকর্মীরা কৃষকদের খোঁজ খবর নিচ্ছে। বৃষ্টি না হলে কৃষকদেরকে সেচের মাধ্যমে পানি দিতে হতো। গফরগাঁও উপজেলার ৩ নং চরআলগী ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা মোড়ের ৬ নং ওয়ার্ডের চরমছলন্দ গ্রামের কৃষক মো. আসাদুল জানান, দু’দিনের বৃষ্টিতে শাক-সবজির জন্য খুবই ভাল হয়েছে। তবে আলু ও মাঠে আমন ধানের আংশিক ক্ষতি হতে পারে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাকায় পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ
গোড়ারকান্দা দরবার শরীফের ওয়াজ মাহফিল ১৭-১৮ জানুয়ারি
সাটুরিয়ায় ৭০ কেজি জাটকা জব্দ করে এতিমখানায় বিতরন, দুই বিক্রেতাকে জরিমানা
মির্জাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি সাহাদত হোসেনের ইন্তেকাল
দুর্বার রাজশাহীকে বিসিবির কড়া বার্তা
কুষ্টিয়া সীমান্তে উদ্ধার ভূখণ্ডে সীমান্ত পিলার স্থাপন করবে বিজিবি
চীনের আধিপত্য রুখতে ট্রাম্পের পদক্ষেপ
সর্বদলীয় সভায় অংশ নিবেন বিএনপির সালাউদ্দিন আহমেদ
নারীর সঙ্গে মদ্দপ অবস্থায় পুলিশ-আ.লীগ ডান্স পার্টি ভাইরাল, ভিডিওতে যা আছে?
আশুলিয়ায় হিজড়াদের অশ্লীল মেলা বন্ধের দাবীতে এলাকাবাসীর গণসাক্ষর
কুতুবউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশে পূর্ব তিমুরের অনারারি কনসাল হিসেবে সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছেন
১৭ বছর পর কারামুক্ত বাবর
রোববার কার্যকর হবে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি, জানালেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী
এবার ৩০ যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে ২৪৬৬ সেনা ফেরত পেল রাশিয়া
দেশের মানুষ আর ভোট বিহীন সরকার দেখতে চায় না - আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী
সর্বদলীয় সভায় অংশগ্রহণে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি
কিশোরগঞ্জে ভূয়া মানবাধিকার চক্রের ৯ সদস্য আটক
ভারতের বক্তব্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তীব্র প্রতিক্রিয়া
লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতা ফয়েজ হত্যা : শেখ হাসিনাসহ ৪১ জনের নামে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
ঢাকা-লক্ষ্মীপুর মহাসড়ক বালিতে বায়ু দূষণ, অতিষ্ঠ জনসাধারণ