ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ : দুই হাজার মেগাওয়াটে সাশ্রয় ১১ হাজার কোটি টাকা
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম
শিল্প-কারখানা ও ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন জনপ্রিয় করতে বাংলাদেশকে যথষ্টে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে দুই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা হলে বছরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সাশ্রয় হবে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১১ হাজার ৩২ কোটি টাকা। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎ ক্রয়ের কারণে সরকারি সংস্থা বিপিডিবি প্রতি বছর উচ্চ মাত্রার রাজস্ব ঘাটতির সম্মুখীন হয়। ভবনের ছাদে বাস্তবায়িত সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয় হ্রাসে ভূমিকা রাখতে পারে।
গতকাল সোমবার বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানাইসিসের (আইইইএফএ) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, এর সরবরাহ ব্যাহত হওয়া এবং নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায়, বাংলাদেশের জন্য ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের অর্থনৈতিক সুবিধা পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সারা দেশের শিল্প-কারখানার ছাদ থেকে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এ পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চচাহিদা দেখা গেছে, প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। বিদ্যুৎ বিভাগের দেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল যা ছিল ১৫৬৪৮ মেগাওয়াট। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে নেট-মিটারিংয়ের আওতায় ও এর বাহিরে ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা আছে ১৬০.৬৩ মেগাওয়াট। ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ এখন প্রতি ইউনিটে ৫ টাকার মতো। অন্যদিকে শিল্প-কারখানা প্রতি ইউনিট গ্রিডের বিদ্যুতের জন্য ৯.৯০ টাকা এবং বাণিজ্যিক ভবন গ্রিডের বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট জন্য ১০.৫৫ টাকা ব্যয় করছেন। ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে দিনের বেলা গ্রিড বিদ্যুতের তুলনায় অর্ধেক কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব হবে।
গবেষণা প্রতিবেদনের লেখক এবং বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বিষয়ক আইইইএফএ›র প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম বলেন, জ্বালানি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত আমদানি কমাতে বাংলাদেশের ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো উচিত। এ খাতকে সঠিক পথে পরিচালনায় দেরি হলে সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। আইইইএফএ›র নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটিতে ছাদেসৌরবিদ্যুতের ব্যাপক প্রসারের লক্ষ্যে ছয়টি মূল চালিকা শক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো হলো সচেতনতা বৃদ্ধি করা, অর্থায়নকে সহজ করা, নীতিমালায় ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়ে পরিবর্তন আনা, গুণগত মান নিশ্চিত করা, ইউটিলিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিজনেস মডেল অনুসরণ করা এবং মূল অংশীজনদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। শফিকুল আলম বলেন, যদিও বিনিয়োগকারীরা সুদের হার, নেট মিটারিং নির্দেশিকা এবং নীতি পরিবর্তন সম্পর্কিত তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করতে চান, এ খাতে তথ্য সম্পর্কিত অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। ছাদে সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহারের আরেকটি প্রধান বাধা হলো পর্যাপ্ত লোকবল না থাকা এবং গুণগতমান নিশ্চিতকরণ এবং প্রকল্প মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাব। কাজেই, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচির জন্য সুনির্দষ্টি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। সাথে অংশীজনদের জন্য সফল প্রকল্পে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যদিও স্রেডা পরিচালিত সৌর হেল্প ডেস্ক থেকে অনুরোধের ভিত্তিতে খাত সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়, তবে অংশীজনরা মনে করেন যে প্রয়োজন এবং প্রাসঙ্গিকতার আলোকে সেবার মান বৃদ্ধিতে হেল্পডেস্কের কাজের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি ক্রেডিট রিস্ক গ্যারান্টি স্কিম ঋণ প্রদানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি কমাবে। এতে ছাদে বাস্তবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণ প্রদান সহজ হবে। একইভাবে, ফার্স্ট-লস গ্যারান্টি স্কিম ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট এবং কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) কম্পানিগুলির ঝুঁকি কমাবে। প্রতিবেদনটির গবেষকের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ পুনঃঅর্থায়ন স্কিমটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী যা থেকে ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বল্প সুদে পুনঃঅর্থায়ন পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই তহবিলটির আকার মাত্র ৪০০ কোটি টাকা (৩৬.৪ মিলিয়ন মার্কিন ইউএস ডলার) এবং আরো ৬৯টি পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতার করতে হয়, বিধায় সকল উপযুক্ত ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে পুনঃঅর্থায়ন পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক পর্যায়ে মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের জন্য অর্থায়নে প্রাক-অনুমোদন দিলে, পুনঃঅর্থায়ন প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা দূর হবে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কম্পানি লিমিটেডও (ইডকল) ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে অর্থায়ন করে, তবে তা এই খাতের মোট চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অদূর ভবিষ্যতে এখাতের ঋণের চাহিদা পূরণে বহুপাক্ষিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন এবং স্থানীয় বন্ড বাজারের সুযোগ নিতে পারে। বর্তমানে এ খাতে ব্যবহৃত সোলার প্যানেল এবং চারটি আনুষঙ্গিক উপকরণের (অ্যাকসেসরিজ) ওপর আরোপিত আমদানি শুল্ক ১১.২ শতাংশ থেকে ৫৮.৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে, এই খাতে প্রণোদনা প্রদানে যেন উচ্চ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। প্রতিবেদনে আরো সুপারিশ করা হয়, একটি নির্দষ্টি ভবনের ছাদে তার অনুমোদিত লোডের (ওয়াট/কিলোওয়াট/মেগাওয়াট) সমপরিমাণ সক্ষমতার সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনে যেন অনুমতি প্রদান করা হয়। শফিকুল আলম বলেন, যেহেতু ছাদে স্থাপিত সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উচিত এ প্রকল্পকে টপ প্রায়োরিটি (সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার প্রক্রিয়া সহজ করা। আর এ খাতের দ্রুত সম্প্রসারণের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাদে সৌরবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ঋণ বিতরণের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিতে পারে। প্রতিবেদনটিতে ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপন জনপ্রিয় করতে ইউটিলিটি সেবার কম্পানিগুলো যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তাও তুলে ধরা হয়েছে। বিজনেস মডেল অনুসরণ করে, ইউটিলিটি সেবাদানকারী সংস্থা বা কম্পানিগুলো প্রকল্পের সংখ্যা যেমন বাড়াতে পারে তেমনি রাজস্ব বাড়াতে পারে। ইউটিলিটি সেবাদানকারী সংস্থা বা কম্পানিগুলো তাদের অঞ্চলের ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের পুরো সম্ভাবনাকে একত্রিত করতে পারে এবং এভাবে দেশের সামগ্রিক ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের বাজারের আকার নির্ণয় করা সম্ভব। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগের প্রয়োজন সম্পর্কে ধারণা পাবে।
প্রতিবেদনে ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের প্রতি আগ্রহ বাড়ার সঙ্গে, পর্যাপ্ত টেস্টিং ল্যাব স্থাপন এবং বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট)-কর্তৃক বাজার মনিটরিং বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মানসম্পন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ইপিসি কম্পানিগুলো এবং সৌরবিদ্যুতের সরঞ্জাম সরবরাহকারীদের জন্য একটি কনজিউমার ফিডব্যাক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ খাতে পরিষেবা প্রদানকারী কম্পানিদের জন্য, স্রেডা সার্টিফিকেশন চালু করতে পারে। এই খাতে যথষ্টে সফলতা পেতে হলে একেবারে নতুন করে শুরুর প্রয়োজন নেই। বরং নীতিনির্ধারকদের উচিত চলমান পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো এবং অন্যত্র বাস্তবায়িত সফল উপকরণ বা স্কিম অন্তর্ভুক্ত করা।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
খুশদীলের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে রংপুরের আটে আট
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশের ভিসা
মেডিকেল কলেজে শিক্ষক বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার
ছাত্রদলের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি আজ
গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ইইউ
ভারতের উদ্বেগের মধ্যে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে পাকিস্তান
সান্ত¡না খুঁজে পাচ্ছেন না, দুই দেশে কলঙ্কিত টিউলিপ
দুর্নীতির মামলায় ইমরান খান ও বুশরা বিবির কারাদণ্ড
বিদেশে টাকা পাচারের রাজনীতি মানুষ চায় না : পীর সাহেব চরমোনাই
শেখ পরিবারের রক্তের জন্যই দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন টিউলিপ -রিজভী
নামাজ মু’মিনের জন্য মেরাজস্বরূপ
ক্রেডিট কার্ডে বিদেশে বাংলাদেশিদের লেনদেন কমেছে
স্বনির্ভর অর্থনীতির পথে দেশ
বগুড়ার বিমানবন্দর দ্রুত চালুর দাবি
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশকে মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করতে হবে : হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
হাজারীবাগের ট্যানারির গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
জুলাই বিপ্লব ঘোষণাপত্র দেওয়া জরুরি : নুরুল হক নুর
গণঅভ্যুত্থানের ইশতেহারে বিএনপির ভূমিকা লিখতে হবে : জয়নুল আবদিন
নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতাদের পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে