নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে ভারত
২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম
বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে এবং বহির্বিশ্বে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতোই আরেকটি ‘পূর্ব নিধারিত ফলাফল’ নিয়ে আসবে। তাই এই নির্বাচন দেশে এবং বহির্বিশ্বে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচন বলতে যা বুঝায়- অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার কোনোটাই এই নির্বাচনে রয়েছে বলে দাবি করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি একতরফা নির্বাচন দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে এমন নির্বাচন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে ‘ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ : নির্বাচন, অর্থনীতি এবং বহিঃসম্পর্ক’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। আলোচনায় দেশের বরেণ্য ব্যাক্তিত্বরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বয়ান তৈরি করা হয়েছে। আমরা দেখেছি এখানে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে উন্নয়নের পক্ষে বয়ান তৈরি করা হয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালে কী পরিমাণ খাদ্য আমদানি করা হয়েছে তা সামনে আনা হয় না। দেখা যাচ্ছে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করিয়ে উন্নয়নের বয়ান তৈরি করা হয়েছে। এখানে বলা হয়- আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আরো বলেন, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা সেটি ঊর্ধ্বমুখী না হলেও নিম্নগামী ছিল না। এখন যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা বলা হচ্ছে, তা মূলত নিজস্ব বয়ান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে মিল থাকে না। এ থেকে বুঝা যায়, উন্নয়নের পক্ষে এই বয়ান কীভাবে তৈরি করা হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘বিরোধী দল খোঁজার’ প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সিট (আসন) ভিক্ষা করার রাজনীতি চলছে। ২৬ দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তাদের ১৩টি দলের নামও কেউ বলতে পারবে না। আসন ভাগাভাগির পর সরকারি দলের ২৪০ আসন নিশ্চিত। আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ‘নতুন সংজ্ঞা’ তৈরি করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই অংশগ্রহণমূলক। তাহলে স্বৈরশাসকদের সময়ের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেন? অংশগ্রহণমূলক মানে যারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করতে পারবে, সেসব দলের অংশগ্রহণ।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যে দলই এসেছে, তারা ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। ৫ শতাংশ ভোট পড়ছে, তা অন্তত ১৫ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। ভোট পড়ার যে হার, তা বিশ্বাসযোগ্য কি না। সবকিছু ঠিক থাকলেও আগামী নির্বাচনে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি হবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। অথচ এই নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতি হারিয়ে যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনীতি আর দেশে থাকবে না। উদার গণতন্ত্রের কথা ভুলে যেতে হবে, বিশেষায়িত গণতন্ত্রে প্রবেশ করব।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রচারণা রয়েছে বাংলাদেশে পশ্চিমারা হস্তক্ষেপ করছে। বাস্তবে এখানে (বাংলাদেশে) পশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে, আবার অ-পশ্চিমারাও (ভরত) হস্তক্ষেপ করে। এখন বলা হচ্ছে পশ্চিমারা এখানে হস্তক্ষেপ করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারত কি এখানে হস্তক্ষেপ করেনি? তারাও নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার দেশের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। বারবার বহিরাগত সমস্যাকে সামনে এনেছে। ভেতরের সমস্যা দিন দিন গুরুতর হয়েছে। ব্যাংকিং, দুর্নীতি, অপচয়, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় এই বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে দুটি চ্যালেঞ্জ। একটি অভ্যন্তরীণ, আরেকটি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমস্যা। সরকার বারবার বহিরাগত সমস্যাকে সামনে এনেছে। ভেতরের সমস্যা দিন দিন গুরুতর হয়েছে। ব্যাংকিং, দুর্নীতি, অপচয়, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় এই বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। মার্চে ঠিক হয়ে যাবে, এপ্রিলে রপ্তানি বাড়বে এসব কথা বলে লোকজনকে বোকা বানানোর চেষ্টা হয়। এসব সমস্যা অনুধাবন না করতে পারলে সমাধান হবে না। সরকারের ভ্রান্ত নীতি এবং নীতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নেই। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দেশ। একটু নাড়াচাড়া লাগলেই রপ্তানি হবে না। পোশাক খাতের কিছু হলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তার মানে বিকল্প রপ্তানি খোঁজা হয়নি। তিনি বলেন, সরকার প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, তা ভুল। কীভাবে প্রবৃদ্ধি হঠাৎ ৭ শতাংশ হয়ে যায়? প্রবৃদ্ধিই সব নয়। আয় ও সম্পদের বৈষম্য তো বাড়ছে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত খুবই বিভ্রান্তিকর। রপ্তানি নিয়ে সরকারের একেক সংস্থা একেক তথ্য দিচ্ছে। ৫ বছরের প্রকল্প ১০ বছর হয়ে যায়। ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৩০ হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। বিদেশ থেকে আনা ঋণের টাকা অপচয় করছি। ১০ টাকার জিনিসে ৫০ টাকা ব্যয় করলে কীভাবে ফেরত দেব? মানুষ কী চায়? টানেল চায় নাকি কালভার্ট চায়? বিশাল হাসপাতাল করলেন, ডাক্তার নাই। আমেরিকাতেও দুর্নীতি হয়। সেখানে জেল থেকে বের হলে কিছুই থাকে না। আর এখানে ঋণখেলাপি, চুরি করা লোকজন মহা আনন্দে বাড়ি কিনছেন, গাড়ি কিনছেন। বাইরে দুর্নীতি হলে সেটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে তো জবাবদিহি নেই, আইনের শাসন নেই। রাজনীতি ঠিক না হলে জবাবদিহি, নীতি ঠিক হবে না। এই বিষয়গুলো না দেখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার উন্নয়নের যে বয়ান দিচ্ছে, তার সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান, ভোগান্তির চিত্র মিলছে না। রাজস্ব, আমদানি, রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সূচক নিম্নমুখী। সরকার জিডিপির যে সংখ্যা দিচ্ছে, তাতে মনে হয়, শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছে। সরকার জিডিপির যে দাবি করে তা ধোপে টেকে না। জিডিপি তুখোড় বেগে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাকি সূচক নিচে নামছে। উন্নয়নের বয়ান দিয়ে চলা যায়, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন করা যায় না। সরকার মূল্যস্ফীতিকে চাপিয়ে রাখছে। ১০ শতাংশ পার করতে দেয় না। নির্বাচনের পর সরকারের সামনে আরো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে আশঙ্কা ব্যক্ত করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, যে নকশাতেই নির্বাচন হোক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব না দিলে তা আত্মঘাতী হয়ে যেতে পারে।
আগামী নির্বাচনে সরকারি দলের হারার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ সুষ্ঠু নির্বাচন। গত ৫২ বছরে এ পদক্ষেপই নেওয়া যায়নি। অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু রাজনীতিবিদ ও আমলারা মিলে একটি চক্র তৈরি করেছেন। এই চক্র ভাঙা ছাড়া পথ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার মানুষের আখাঙ্কার বিরুদ্ধে একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, এই পাতানো ডামি প্রার্থীর নির্বাচনে ভারত, রাশিয়া ও চীন সমর্থন দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা অর্জিত আয় দিয়ে পণ্য ক্রয় করি। ইউরোপ, আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে আয় করি। এক জায়গায় আমরা খরচ করি, আরেক অঞ্চল থেকে আয় করি। স্বার্থ কোন দিকে বেশি, সেই অর্থনৈতিক অঙ্কও হিসাব করতে হবে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড. আই. খান পান্না, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমান্ডার (অব) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, সিজিএস’র চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রমূখ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ওপারে ভালো থাকবেন ডেভিড লিঞ্চ
হাজারীবাগে ছাত্রী হোস্টেল থেকে শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
গুপ্ত হত্যা, গুম ও ক্রসফায়ার ছিলো শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়: রিজভী
জনতার বাজার মনোপলি সিন্ডিকেটের ঊর্ধ্বে থাকবে- ঢাকা জেলা প্রশাসক
ভ্যাট না বাড়িয়ে সরকারকে খরচ কমানোর পরামর্শ বিএনপির
গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের কৃষকের স্বপ্ন এখন ইরি-বোরোয়
রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ২০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর
জাতীয় কবির নাতি দগ্ধ, আইসিইউতে ভর্তি
উখিয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার দায়ে ১ জনকে ১০ দিনের সাজা, ট্রাক ও এক্সেভেটর মেশিন জব্দ
নগরকান্দায় ২ গ্রামবাসীর সংঘর্ষে পুলিশ সাংবাদিক নারীসহ আহত অর্ধশত
দুষ্ট লোকেরা বলে, আ’লীগকে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে দেখতে চায় বিএনপি: শহীদুজ্জামান
কটিয়াদীতে তারুণ্যের উৎসব ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত
রুপির দাম তলানিতে, নিয়ন্ত্রণে যে সিদ্ধান্ত নিলো ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক
অবিবেচকভাবে ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে: ড. দেবপ্রিয়
‘উন্নয়নের অংশীদার, প্রবাসীরাও দাবিদার’ শ্লোগানে রিয়াদে প্রবাস মেলা’র ১১ বর্ষে পদার্পণ উদযাপন
এবার বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার
হিলিতে ব্যাডমিন্টন ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএফডির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি: দোয়া চাইলেন তারেক রহমান
মাঘের শুরুতে আবার আসছে শৈত্যপ্রবাহ