‘আমি ভারতের প্রার্থী’
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
এবারের জাতীয় নির্বাচনের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হচ্ছে ‘ডামি প্রার্থী’। এ ছাড়াও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ‘২৬ আসন সমঝোতা’ এবং ‘ইনু-মেননদের ৭ আসন’ ছেড়ে দেয়া, কিংস পার্টিগুলোর আত্মঘাতি অবস্থা ইত্যাদি আলোচনায় আসে। প্রতীক বরাদ্দের পর আলোচনায় চলে আসে ডামি প্রার্থীদের গণহারে ‘ঈগল’ মার্কা পাওয়া এবং এরশাদের আসন হিসেবে পরিচিত রংপুর-৩ আসনে জিএম কাদেরের লাঙ্গলের বিরুদ্ধে তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানীর ঈগল মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এ ছাড়াও কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর পোস্টারে ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী’ ফেনি-৩ আসনে লেফটেন্যাস্ট জেনারেল (অব) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর ‘মহাজোট সমর্থিত’ জাতীয় পার্টির প্রার্থী’ পোস্টার এবং পটুয়াখালি-১ আসনে রুহুল আমিন হাওলাদারের নির্বাচনী পোষ্টারে এরশাদের ছবির স্থলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পোষ্টার। এসব নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক-রসিকতা-ঠাট্টা-তামাশা চলছে মাঠে ময়দানে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নেটিজেনরা এসব নিয়ে নানান মন্তব্য করছেন; সুবিধাবাদী নেতাদের মুখোশ উন্মোচন করছেন। এছাড়াও এরশাদকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে শেখ হাসিনার ওপর জাপার সিনিয়র নেতাদের নির্ভরতায় তাদের নীতি নৈতিকতা এবং ক্ষমতালিপ্সা নিয়েও প্রতিবাদ-ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনাও ঘটছে, টিপ্পুনি কাটা হচ্ছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে বেসরকারি টিভির টকÑশো’র নিয়মিত চরিত্র হিসেবে পরিচিত মেহেরপুর-১ (মুজিবনগর, সদর উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী (স্বতন্ত্র) প্রফেসর আব্দুল মান্নানের বক্তব্য ‘আমি ভারতের প্রার্থী, হারার জন্য আসিনি’ বক্তব্য। প্রফেসর মান্নান এখন টক অব দ্য কান্ট্রি এবং সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। পশ্চিমবঙ্গের ‘কাঁচা বাদাম, দাদা কাঁচা বাদাম/ আমার কাছে নেইকো বুবু ভাজা বাদাম’ খ্যাত ভুবন বাদ্যকর এবং রানিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে লতা মুঙ্গেশকরের গান গেয়ে ভাইরাল হওয়া ‘রানু মণ্ডল’ এর চেয়েও প্রফেসর মান্নান বেশি আলোচিত।
আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে দুই মেয়াদের সংসদ সদস্য প্রফেসর আব্দুল মান্নানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন ওই আসনের নৌকার প্রার্থী প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রফেসর আব্দুল মান্নান যেটি করেছেন তা নির্বাচনের আচরণবিধি লংঘন। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে এমন কথা বলতে পারেন না। উনি ভারতের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে দাবি করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করছেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারত কোনো প্রার্থী দিতে পারে কিনা? সত্যিই কি প্রফেসর মান্নান ভারত সমর্থিত প্রার্থী? তাহলে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কোন পযায়ে? পিন্ডির শৃংখল ভেঙ্গে বাংলাদেশ কি দিল্লির দাসত্ববরণ করেছে? গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে প্রফেসর আবদুল মান্নানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে মেহেরপুর-১ আসনের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শক।
আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। সময়ের প্রয়োজনে ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন দলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির দুই বারের এমপি এবারের ডামি প্রার্থী প্রফেসর মান্নান নিজেদের ‘ভারত সমর্থিত প্রার্থী’ দাবি করে নির্বাচনে পরাজিত হতে আসেননি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। আর যে সরকারি কর্মকর্তাকে তিনি এই হুমকি দিয়েছেন সেই কর্মকর্তা প্রজাতন্ত্রের আইন অমান্য করে ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারও বা যুক্তিযুক্ততা কতটুকু? অথচ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বালুতে মুখ লুকিয়ে রেখেছে; আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা নীরব?
জানা যায়, মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অলোক কুমার দাস সরকারি কর্মকর্তা হয়েও নৌকার প্রার্থী প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের পক্ষ্যে নির্বাচনী প্রচারনায় নেমেছেন। সরকারি চাকরিবিধি লংঘন করে নৌকার প্রার্থীর পক্ষ্যে কাজ করা মেনে নিতে পরছেন না ওই আসনের দুই বারের সাবেক এমপি প্রফেসর মান্নান। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ডা. অলোক কুমার দাসকে ফোন করে হুমকি দেন। এরই মধ্যে ওই ফোনালাপের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ডা. অলোক কুমার দাসকে হুমকি দিয়ে প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেন, ‘তুমি বাইরে থেকে এসে মেহেরপুরে খুব আরামেই আছো। টাকা-পয়সা অনেক কামাই করছো। বাড়ি-ঘর করেছো। আমি যদি আর একটা কথা শুনি মন্ত্রীকে (প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন) ভোট দেওয়ার ব্যাপারে, আমি এমপি হই, আর না হই, তোমার মেহেরপুরের বাসা আমি উঠিয়ে দেব। আর যদি তুমি সাবধান হয়ে যাও তাহলে আমার প্রিয় পাত্র হয়ে থাকতে পারবে। এটুকু আমি তোমাকে বললাম। পারলে তোমার মন্ত্রীকে বলো।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনার প্রার্থী, আমি ভারতের প্রার্থী, এটি তোমাকে মনে রাখতে হবে। আমি এখানে (নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া) হারার জন্য আসিনি। সাবধান হয়ে যাও তুমি। আমি তোমার কোনো কথা শুনব না। আমি যে রিপোর্ট পেয়েছি, আমি খুব অসন্তুষ্ট তোমার প্রতি, তুমি সাবধান হয়ে যাও।’
প্রফেসর মান্নানের ‘আমি ভারতের প্রার্থী’ বক্তব্য আওয়ামী লীগের মধ্যসারির নেতাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। যারা নির্বাচনী প্রচারাণায় মাঠে রয়েছেন তাদের ‘নানান কথা’ শুনতে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, তারা এ ধরণের বক্তব্যে বিব্রতবোধ করছেন। আওয়ামী লীগের মতো দলের দুই বারের সাবেক এমপির এমন বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন। শুধু প্রফেসর আব্দুল মান্নানের ‘আমি ভারতের প্রার্থী’ বক্তব্যেই নয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উচ্ছিষ্টভোগী কিছু সাংবাদিক, অনুগত কিছু সুশীল নির্বাচন উপলক্ষ্যে ভারতের বিতর্কিত ব্যক্তি বিজেপি নেতা এম জে আকবর, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে ঢাকায় দায়িত্বপালন করা পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এবং ভারতের কিছু ভাড়াটে সাংবাদিককে ঢাকায় এনে ‘ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষে রয়েছে’ এমন বক্তব্য দেওয়ানোয় বিব্রতবোধ করছেন মাঠের নেতারা। তাদের বক্তব্য বিএনপির নির্বাচনে নেই ফলে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত। তারপরও এমন ব্যাক্তিদের ভাড়া করে এনে বক্তব্য দেওয়ানো আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের নামান্তর।
নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিজেপি নেতা এম জে আকবরকে ঢাকায় আনা হয়। নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রতিমন্ত্রী এই এক জে আকবরের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারীর অভিযোগ উঠে। যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রীসভা থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অথচ ধর্ষণের দায়ে মন্ত্রীত্ব হারানো সেই এম জে আকবর ঢাকার কিছু সুবিধাভোগী দলদাস সাংবাদিক ‘মহাজ্ঞানী’ হিসেবে প্রচার করে সেমিনার সিম্পোজিয়াম করেন। ওই দলদাস সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা কয়েকদিন আগে ঢাকায় কর্মরত ভারতের সাবেক হাইকশিনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীকে ভাড়া করে ঢাকায় এনেছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে নিয়ে সেমিনারেরও আয়োজন করে। সেমিনারে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘কিভাবে নির্বাচন করতে হয় বাংলাদেশের মানুষ তা জানে। এ নিয়ে বিদেশীদের (যুক্তরাষ্ট্র) মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে দাবি নিয়ে উম্মা প্রকাশ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘যুক্তরাষ্ট্র বিদেশী শক্তি’ হলে ভারত কি ‘স্বদেশী শক্তি’? বিদেশীদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই তাহলে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বিদেশী হয়ে ঢাকায় এসে এমন ‘ছবক’ দিচ্ছেন কেন? এর আগে দেশ-বিদেশে ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিত ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় অক্টোবর মাসে ঢাকায় আসেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। ঢাকা ঘুরে গিয়ে দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসে এক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা।’ যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের ‘ভারতকে বলেছি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে যা যা করা প্রয়োজন সব করতে হবে’ এবং ওবায়দুল কাদেরের ‘তলে তলে সব সমঝোতা হয়ে গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে, দিল্লি পাশে অছে অতএব ভয় নেই’। আওয়ামী লীগের বড় দুই নেতার এসব বক্তব্য অনেকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছিল; কিন্তু প্রফেসর আবদুল মান্নানের ‘আমি ভারতের প্রার্থী’ বক্তব্য অতীতের ভাইরাল বক্তব্যগুলোকে পিছনে ফেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন রাজত্ব করছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কোরের '৯ম কর্ণেল কমান্ড্যান্ট' অভিষেক অনুষ্ঠিত
দ. কোরিয়ায় ইয়ুনের আটক বাড়ানোর পর আদালতে হামলা ও বিক্ষোভ
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে ট্রাম্প
ইয়েমেন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ইসরাইলি বিমানবন্দর বন্ধ
৬০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ বেচবে সরকার, পাওয়া যাবে যেখানে
লাইফ সাপোর্টে কাজী নজরুল ইসলামের নাতি বাবুল
স্পেনের এনজিওগুলো ইলন মাস্কের বিরোধিতায় এক্স ছেড়ে যাচ্ছে
যে দেশ বা সমাজে ন্যায়বিচার নেই, সে জাতিকে ধ্বংস করে দেন আল্লাহ: আল্লামা মামুনুল হক
গাজায় প্রতিদিন ঢুকবে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ
যুদ্ধবিরতির আনন্দে গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের আবেগ-উল্লাস
ফের শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিলো আবহাওয়া অফিস
লিমায় স্প্যানিশ বিজয়ী ফ্রান্সিসকো পিজারোর মূর্তি পুনঃস্থাপন
আবারও পেছাল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে রিভিউ শুনানি
‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে’
রাজনীতির মধ্যে ঢুকতে চায় না ইসি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু সোমবার
টিকটকের যুক্তরাষ্ট্রে পরিষেবা বন্ধ, আইনি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
ইউল্যাবের হাল্ট প্রাইজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ
স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন হাসিনা : দ্য হিন্দু
আওয়ামী দুঃশাসনের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়: রিজভী আহমেদ
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি, আ.লীগের জয়জয়কার