ভারতের অভিলাষ ষোলকলা পূরণ

‘টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’

Daily Inqilab শফিউল আলম

০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম

২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির (‘ট্রানজিট’ ও ‘করিডোর’ একথা বলা হয়নি) শিরোনামে উল্লেখ আছেÑ ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। মোদ্দা কথায় চুক্তি অনুসারে ভারতের পণ্য যাবে ভারতেই। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিট সুবিধা অনুমোদন দিয়ে সরকার চুক্তিটি দাফতরিক কার্যকর করে বিগত ২৪ এপ্রিল’২৩ইং। এর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদেশ (এসআরও) জারি করে। চুক্তি কার্যকর সংক্রান্ত আদেশে সমুদ্রবন্দরে জাহাজ ভিড়া, ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের ঘোষণা, ফি-মাশুল-চার্জ, এজেন্ট নিয়োগ, পণ্যের পরীক্ষা, সিলবদ্ধকরণ, ট্রানজিট সময়কাল, ডেলিভারি পরিবহন, নিরাপত্তা প্রদান এসব প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়। ভারতের ট্রানজিট পণ্য চালান বন্দরে খালাসে দ্রুততা এবং সাময়িক মজুদ রাখার ক্ষেত্রে বেশি ফ্রি-টাইম দেয়া হয়েছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনে প্রধান চারটি ট্রানজিট রুট চুড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআই গত ৪ আগস্ট’২৩ইং এক প্রতিবেদনে জানায়, ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তনা চাকমা ওই তথ্য জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন। বাংলাদেশ সরকার পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য চারটি রুট অনুমোদনের কথা জানিয়েছে। রুটগুলো হলো, চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলা বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।

কেন শুভঙ্করের ফাঁকি : বাংলাদেশের উভয় আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর ও কাস্টমস চট্টগ্রাম এবং মোংলা। ট্রান্সশিপমেন্ট, ট্রানজিটের আমদানি-রফতানি চালানে ফি, শুল্কায়ন, মাশুল, চার্জ, ভাড়া ইত্যাদি আন্তর্জাতিক বন্দর-শিপিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বত্র প্রচলিত নিয়ম-বিধিতে ডলারে ধার্র্য্য হওয়ার কথা। কিন্তু ডলারের পরিবর্তে ‘টাকা’য় নির্ধারণ করা হয়েছে। তাও মামুলি নামেমাত্র ফি-চার্জ। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আছে সমালোচনা। ২০১০ সাল পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি ছিল প্রতি কন্টেইনারে ১০ হাজার টাকা। ২০২০ সালের জুলাইয়ে ভারতের পরীক্ষামূলক (ট্রায়াল রানে) চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ট্রানজিট পণ্যবাহী প্রথম জাহাজ ‘এমভি সেঁজুতি’র ট্রান্সশিপমেন্ট ফি আদায় করা হয় কন্টেইনারে ৫শ’ টাকা। সর্বশেষ সরকারি আদেশে ট্রান্সশিপমেন্ট ফি কার্যকর হয়েছে টন প্রতি ২০ টাকা হারে। সড়কপথে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানযোগে প্রতি টন আগে (২০১০ সাল) ছিল এক হাজার টাকা। ২০২০ সালে তা কমিয়ে ধার্য হয় ২০ টাকা। এখন সেই ফি কন্টেইনার বা লরি প্রতি কিলোমিটার হিসাবে দিতে হচ্ছে মাত্র ৮৫ পয়সা। তাছাড়া পুলিশ এসকর্ট ফি ৮৫ টাকা, প্রতি কন্টেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা, প্রতি চালান প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ একশ’ টাকা, প্রশাসনিক ফি একশ’ টাকা, প্রতি কন্টেইনার বা গাড়ির জন্য প্রতি কি.মি. এসকর্ট (পাহারা) ফি ৮৫ টাকা নির্ধারণ হয়। এনবিআর’র মাধ্যমে সরকারি আদেশে ট্রান্সশিপমেন্ট (ট্রানজিট-করিডোর) গাইডলাইন দেয়া হয়। বন্দরে কন্টেইনারবাহী পণ্যের প্রচলিত ফ্রি টাইম (বাড়তি মাশুল ছাড়া) সর্বোচ্চ চার দিন। অথচ ট্রানজিট পণ্যে সেই সুযোগ দেয়া হয়েছে ২৮ দিন। ‘ভারত থেকে ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহন বাবদ নামকাওয়াস্তে ট্রানজিট ফি-মাশুল মিলবে!

‘সমানে-সমানে’ এবং ডলারে হওয়াই যুক্তিযুক্ত -ড. মইনুল : ট্রানজিট-করিডোরের ফি-চার্জ-মাশুল প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ট্রানজিটের ফি মাশুল চার্জ ইত্যাদি ডলারে নির্ধারণ করাই ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ডলারের পরিবর্তে টাকায় ধার্য্য হওয়ায় ট্রানজিট ব্যবস্থায় লাভালাভ প্রচণ্ডভাবে ভারতের স্বার্থানুকূলে গেছে। টাকায় হওয়াতে ভারতের সুবিধাই হয়েছে বেশি। অথচ এসব ফি-চার্জ থেকে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। আমাদের ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ (সমানে-সমান) লাভের সুযোগ ছিল। তা কিন্তু হয়নি। এরই মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার ২৫ শতাংশেরও বেশি অবচয়ন হয়েছে। ডলারে হলে সময়ে-সময়ে টাকার অবচয়নেও সমস্যা ছিল না। এভাবে আমাদের পাওনাটা কম পাচ্ছি। বন্দর সুবিধা ব্যবহার করে ভারতের যদি একশ’ ডলার বেঁচে যায়, আমাদের সেখানে পঞ্চাশ ডলার দেয়া হোক, ওরা পঞ্চাশ রাখুক। কিন্তু ভারত যদি ৮০ বা ৮৫ ডলারই নিয়ে যায়, আমাদেরকে ১৫ বা ২০ দেয়, সেটাকে আমি সমতা ও ন্যায্য মনে করিনা। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলামের অভিমত, ট্রানজিট ফি, চার্জ-মাশুল পুনর্মূল্যায়ণ করা প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশের বন্দর, নৌপথ, সড়ক মহাসড়ক, রেলপথ ব্যবহার হবে। এসব অবকাঠামোর অবচয় ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। এসব বিষয় বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আরো বেশি হওয়া উচিৎ বলেই আমি মনে করি।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বলছেন, বিষয়টি প্রাথমিক এখনো পর্যায়ে কমার্শিয়ালি দেখা হচ্ছে না। নিকট প্রতিবেশী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে দেখা হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে ফি-চার্জ হার পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
যেভাবে ভারতের বাম্পার লাভ : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের উপর দিয়ে মালামাল পরিবহনের টার্গেট, প্রত্যাশা, আবদার-অভিলাষ তাদের দীর্ঘদিনের। এ প্রশ্নে পর্যালোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক এবং অতীতে রাজনীতির মাঠ গরম হয়। ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত ভারতের ৭টি রাজ্য হচ্ছেÑ আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর। এর সংলগ্ন সিকিম এবং শিলিগুড়িসহ পশ্চিমবঙ্গের একাংশ। ভারতের বিরাট অংশ দেশটির মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, দুর্গম, বন্দর-সুবিধা বঞ্চিত ও ভূমি-পরিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড)। এককালে কোন কোন রাজ্য ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কবলিত। সেসব অঞ্চলের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান অনুন্নত। অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত। ভারতের টার্গেট, দেশটির মূল অংশের সাথে সহজ যোগাযোগ স্থাপন এবং ওইসব অঞ্চলে মালামাল আনা-নেয়া দ্রুতায়িত করা। এর পাশাপাশি লক্ষ্যটি হচ্ছে, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী কোন দেশকে রফতানি বাজারে প্রবেশাধিকার না দিয়েই, ভারতের পণ্যসামগ্রী ওইসব অঞ্চলে সুগম ও সহজলভ্য করা।

ভারতের মূল অংশের শহর-বন্দরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য বর্তমানে দীর্ঘ ঘুরপথে এক হাজার ৭শ’ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়। এতে ৫ থেকে ৮ দিন সময় লাগে। এ ছাড়াও আছে নানান বাধা-বিপত্তি। যেমনÑ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সাথে কলকাতা বন্দরের দূরত্ব এক হাজার ৬৮০ কি.মি। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কি.মি.। নতুন ট্রানজিট-করিডোরের প্রক্রিয়াধীন ফেনী নদীর সেতু সংলগ্ন রামগড় স্থলবন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রামগড় হয়ে সাবরুম দিয়ে ত্রিপুরার দূরত্ব হবে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ কি.মি.।

মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ১৫০ কি.মি. হলেও মাত্র ৫৭০ কি.মি. দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর। মিজোরামের রাজধানী আইজল ও চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫৫ কি.মি.। কিন্তু কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৫৫০ কি.মি.। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৮৮০ কি.মি. কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৪৫০ কি.মি.।

কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে তুলনায় গড়ে চার গুণেরও বেশি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৮টি রাজ্যে কলকাতা কিংবা চেন্নাই সমুদ্রবন্দর থেকে ফিডার জাহাজে পণ্য পাঠাতে হয়। এতে করে সময় ও অর্থ ব্যয় বেশিই হচ্ছে। আর, বাংলাদেশের উপর দিয়ে ৮টি রাজ্যে প্রত্যন্ত স্থানে পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা কাজে লাগিয়ে আগের তুলনায় ভারতের খরচ কমছে চারগুণ পর্যন্ত। খরচ নেমে আসবে মাত্র ১৫ থেকে ৩০ শতাংশে।

ট্রানজিট চুক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্য আনা-নেয়ার জন্য স্থলবন্দর ও করিডোর রুটগুলো দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৮টি রাজ্যে মালামাল এবং যাত্রী পরিবহনে তাদের ব্যয় ও সময় বেঁচে যাবে রুট বা করিডোর-ভেদে সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত। মোটের উপর ভারতের বাম্পার লাভের লাভ হবে চার গুণ। ইতিপূর্বে ট্যারিফ কমিশনের কোর কমিটি ট্রানজিটের জন্য ১৩টি সম্ভাব্য রুট বা করিডোর চিহ্নিত করে। এসব রুট দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য আনা-নেয়ায় ভারতের ব্যয় কমবে অর্ধেকেরও বেশি। কোর কমিটি ট্রানজিট-করিডোর ব্যবস্থায় কোন রুট দিয়ে ভারতের পণ্য আনা-নেয়ায় কত সাশ্রয় হবে এ ব্যাপারে ধারণা দিয়েছে। এতে বলা হয় তামাবিল-চট্টগ্রাম দিয়ে ১২ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ, আখাউড়া-বেনাপোলে ৪৮ শতাংশ, সুতারকান্দি-বেনাপোলে ৩৩ শতাংশ, সুতারকান্দি-চট্টগ্রামে ৫৩ শতাংশ, বাংলাবান্ধা-মোংলা ২৯ শতাংশ, বুড়িমারী-মোংলা ১২ শতাংশ, শাহবাজপুর-চট্টগ্রামে ৬৭ শতাংশ, আখাউড়া-দর্শনা ৭০ শতাংশ, রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জে ৫০ শতাংশ, শাহবাজপুর-দর্শনা রুটে ভারতের সাশ্রয় হবে ৫৭ শতাংশ খরচ।

ট্রানজিটে বৃহৎ রেল রুট আখাউড়া-আগরতলা : বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী আখাউড়া-আগরতলা একটি নতুন রেললাইন সম্প্রতি চালু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রেলপথে দুই দেশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হলো। আখাউড়া-আগরতলা ট্রানজিট-করিডোরের বৃহৎ রেল রুট হতে যাচ্ছে। এতে ভারতই বেশি লাভবান হবে। কেননা এর ফলে ভারতের মূল অংশের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঢাকা হয়ে আগরতলা-কলকাতার দূরত্ব কমবে ১১শ’ কিলোমিটার। সময় বাঁচবে ২৬ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সরাসরি ‘ভারত থেকে ভারতের মালামাল ভারতে’ পরিবহন হবে অনেক সহজ। গত ১ নভেম্বর’২৩ইং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভার্চুয়ালি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত আখাউড়া-আগরতলা নয়া রেলপথ ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। রেলপথের বাংলাদেশ অংশে পড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ কি.মি.। নতুন এই রেলপথ আখাউড়ার গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ মূলত ভারতের ঋণ-নির্ভর প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং সরকারি অর্থায়ন ৫৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। ২০১০ সালে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ নির্মাণে বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা চুক্তি হয়।

আখাউড়া-আগরতলা নয়া রেলপথের সুবাদে ভারতের ট্রানজিট-করিডোর অভিলাষ পূরণ আরেক ধাপ অগ্রগতি হলো। রেলপথটি বাংলাদেশকে আখাউড়ার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) দিয়ে আগরতলা হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করেছে। দীর্ঘ ঘুরপথে আগরতলা-কলকাতার দূরত্ব ১৬শ’ ৫০ কিলোমিটার। আখাউড়া-আগরতলা প্রায় ১২ কি.মি. নতুন রেলপথে সেই দূরত্ব এখন মাত্র ৫৫০ কি.মি.। দূরত্ব কমেছে ১১শ’ কি.মি.। সময় বাঁচবে ২৬ ঘণ্টা। চট্টগ্রাম বন্দর এবং ঢাকার কমলাপুর আইসডি থেকে কন্টেইনারসহ বিভিন্ন ধরনের ট্রানজিট মালামাল দ্রুত পরিবহন সম্ভব হবে। সংক্ষিপ্ত দূরত্বে ভ্রমণে সময় যাবে ৩৬ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ১০ ঘণ্টা। বাঁচবে প্রচুর কর্মঘণ্টা, সময় এবং অর্থ। আখাউড়া-আগরতলা নয়া রেলপথ নির্মাণের সুবাদে বদলে যেতে চলেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভাগ্য। আখাউড়ার অপর প্রান্তে আগরতলার কাছে নিশ্চিন্তপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন এবং ইমিগ্রেশন কেন্দ্র। বন্দর সুবিধাবিহীন ও ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হচ্ছে প্রথম আন্তঃদেশীয় স্থলবন্দর। ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহনের পাশাপাশি ‘ভারতের যাত্রী ভারতে’ পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে সহজ এবং সাশ্রয়ী।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম স্থলবন্দর ও ট্রানজিটের নয়া রুট
প্রাচীন মহকুমা শহর সীমান্তবর্তী ভূ-কৌশলগত অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ফেনী নদী তীরের জনপদ রামগড়। রামগড়ে স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন কেন্দ্র চালুর পথে পুরোদমে প্রস্তুত। যা দেশের ১৫তম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম স্থলবন্দর। একই সঙ্গে ভারতের সাথে ট্রানজিটের নয়া রুট হতে যাচ্ছে। গত ১৪ নভেম্বর’২৩ইং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দরে আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল উদ্বোধন করেন। তবে উদ্বোধন হলেও যাত্রী পারাপার এখনও শুরু হয়নি। ভারতের ত্রিপুরা প্রান্তে প্রস্তুতি শেষ হলে ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শুরু হবে। রামগড় স্থলবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম চালুর লক্ষ্যে টার্মিনাল শেড, ব্যাংক, কাস্টমস, বিজিবি ও পুলিশের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মূলত ফেনী নদীর উপর নির্মিত সেতুর মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহর দিয়ে কানেকটিভিটি বা ট্রানজিট-করিডোর স্থাপন হতে যাচ্ছে।

২০১৫ সালের ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ফেনী নদীর উপর ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু-১-এর ভিত্তি স্থাপন এবং ২০২১ সালের ৯ মার্চ ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি উদ্বোধন করেন। রামগড়ে মহামুনি এলাকায় ৪১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৪. ৮০ মিটার প্রস্থ সেতুটি দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মৈত্রী সেতু। চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রানজিট সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কি.মি. দূরত্বের রামগড় স্থলবন্দর ব্যবহার করে মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যেই ট্রানজিট-করিডোর রুটে পণ্য যেতে পারবে ভারতে। ইতোমধ্যে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধার উপযোগী করে চট্টগ্রাম-রামগড় সড়ক এবং চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের মীরসরাইয়ের করেরহাট-রামগড় সড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে।

ভারতকে ট্রানজিট-করিডোর রুট সুবিধাদান প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ বলেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, নৌপথ, সড়ক ও রেলপথ সবকিছু মিলিয়ে মাল্টিমোডাল পরিবহন সুবিধায় ট্রানজিট-করিডোর পেয়েছে তারা। বিনিময়ে আমাদের নামেমাত্র ফি-চার্জ দিচ্ছে। ভারত এখানে মৃগয়া ক্ষেত্র বানিয়েছে। বাংলাদেশ হারাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট সম্ভাবনা। ভারতে বাংলাদেশের গুণগত ভালোমানের অনেক পণ্যসামগ্রীর উচ্চ চাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্রবেশাধিকার আটকে রেখেছে। ভারতের অনেক পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পুনঃরফতানির যে অবারিত সুযোগ, সেখানেও আমরা বঞ্চিত। কাজেই লাভ তাদেরই। ট্রানজিটের পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে রাস্তাঘাট সড়ক, রেলপথ, নৌপথ আমাদের মেরামত করতে হচ্ছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সবমিলিয়ে ভারতেরই লাভ। আর ক্ষতিটা আমাদের।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শহীদ আসাদ মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন : প্রধান উপদেষ্টা
শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেলেন যারা
যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া জরুরি: আমান
মেডিকেলের ফল পুনঃপ্রকাশের দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের
ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ নিঃশ্বাসে ঢুকছে বিষ
আরও

আরও পড়ুন

শহীদ আসাদ মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন : প্রধান উপদেষ্টা

শহীদ আসাদ মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন : প্রধান উপদেষ্টা

ফুলপুরে তারুণ্যের উৎসব উদযাপনে ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

ফুলপুরে তারুণ্যের উৎসব উদযাপনে ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

গাজায় ইসরায়েলের অভিযান ‘অত্যন্ত সফল’ : বিদায় অনুষ্ঠানে বাইডেন

গাজায় ইসরায়েলের অভিযান ‘অত্যন্ত সফল’ : বিদায় অনুষ্ঠানে বাইডেন

শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেলেন যারা

শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেলেন যারা

চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় জেডি ভ্যান্সের বৈঠক

চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় জেডি ভ্যান্সের বৈঠক

চকরিয়ায় সেনা কর্মকর্তা লেঃ তানজিম হত্যায় ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র

চকরিয়ায় সেনা কর্মকর্তা লেঃ তানজিম হত্যায় ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র

তনির বিয়ে নিয়ে যা বললেন নেটিজেনরা

তনির বিয়ে নিয়ে যা বললেন নেটিজেনরা

ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতিতে টিকটক সেবা আবার চালু

ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতিতে টিকটক সেবা আবার চালু

বিশেষ ক্ষমতা আইন ও শহীদ সবুজ হত্যা মামলায় নকলায় দুই সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেফতার

বিশেষ ক্ষমতা আইন ও শহীদ সবুজ হত্যা মামলায় নকলায় দুই সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেফতার

যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া জরুরি: আমান

যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া জরুরি: আমান

আজ শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

আজ শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিলুপ্তির পথে দেশের সিনেমা হল

বিলুপ্তির পথে দেশের সিনেমা হল

যেভাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

যেভাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

গাজায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং ,সতর্কবার্তা  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার

গাজায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং ,সতর্কবার্তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার

পঞ্চগড় হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত রোগী

পঞ্চগড় হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত রোগী

মেডিকেলের ফল পুনঃপ্রকাশের দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের

মেডিকেলের ফল পুনঃপ্রকাশের দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের

প্রথম দিনেই একগুচ্ছ নির্বাহী আদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প

প্রথম দিনেই একগুচ্ছ নির্বাহী আদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প

ড. ইউনূস সরকারের সমালোচনা করা রিপোর্ট প্রত্যাহার ব্রিটিশ এমপিদের

ড. ইউনূস সরকারের সমালোচনা করা রিপোর্ট প্রত্যাহার ব্রিটিশ এমপিদের

প্যারিসে জুলাই জার্নাল অব ডিক্টেটরশিপ প্রদর্শনী, যা সবার আয়োজন করা উচিত

প্যারিসে জুলাই জার্নাল অব ডিক্টেটরশিপ প্রদর্শনী, যা সবার আয়োজন করা উচিত

বিরতির প্রথম দিন :  গাজায় ঢুকলো সাড়ে ৫ শতাধিক ত্রাণবাহী  ট্রাক

বিরতির প্রথম দিন : গাজায় ঢুকলো সাড়ে ৫ শতাধিক ত্রাণবাহী ট্রাক