দেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় নেই কোনো দিক-নির্দেশনা
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম
বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ ক্যান্সার। দেশে প্রতি বছর দেড় লাখের বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন এবং এক লাখ ১০ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়। দেশের ক্যান্সার চিকিৎসায় নেই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। কারণ স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো ক্যান্সারের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে হয়নি জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন। একই সঙ্গে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। আট বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজে পৃথক পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের জুলাই থেকে। অথচ এখনও চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আসুন ক্যান্সার সেবায় বৈষম্য দূর করি’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন দেশের ক্যান্সার রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সঠিক তথ্য-উপাত্ত। যা রোগ নির্ণয়ে, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক। এর জন্য জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধনের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসা, রোগ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রস্তুতি, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন জরুরি। ইতিপূর্বে এই কাজটি না হলেও আমরা কাজটি শুরু করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সহযোগিতায় বিএসএমএমইউ পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের একটি দল। ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ৮৫ হাজার মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় এনেছি। এই উপজেলার আড়াই লাখ মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী অন্য একটি উপজেলা এ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা হবে। নিবন্ধনের কাজ শেষ না হওয়ায় তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে প্রাথমিক তথ্যে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় সমান বলে জানান তিনি। এ ছাড়া শিশুদের আক্রান্তের হার প্রায় ৭ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখ ক্যান্সারের রোগী রয়েছে। প্রতিবছর আনুমানিক দুই লাখ মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং দেড় লাখ রোগী প্রাণ হারায়। সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্যান্সার রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মূল কারণ।
এদিকে গ্লোবকন-২০২০ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশের মৃত্যু ক্যান্সারে। যা অসংক্রামক রোগ-সম্পর্কিত মৃত্যুর ষষ্ঠ প্রধান কারণ। গ্লোবকনের পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে এক লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। একই সময়ে এক লাখ ৮ হাজার ৯৯০ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারে মৃত্যু হয় ১১ দশমিক ১ শতাংশ। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মেডিকেল অনকোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সাধারণত গ্লোবকনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে থাকি। কারণ আমরা জানি না আমাদের দেশের ক্যান্সারের প্রকৃত অবস্থা। ফলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আক্রান্তদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর হিসেব অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে ২ কোটি নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ৯৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ধূমপানকে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংস্থাটির মতে, তামাক ব্যবহার পরিহারসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ক্যান্সারে মৃত্যু ঝুঁকি ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আইএআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ক্যান্সারে এক লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে, ২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় ৮১ লাখ মানুষ। গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয় আড়াই কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণারত ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যান্সার সংক্রান্ত সব তথ্যের জন্য আমরা অন্যদের ওপর নির্ভরশীল। এসব তথ্য মূলতঃ পরিসংখ্যান নির্ভর। আমাদের নিজেদের গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক উপাত্তের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। তাই ক্যান্সার নিবন্ধন করতে পারলে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
এদিকে যেহেতু ক্যান্সার কোনো একক রোগ নয়, তাই এর লক্ষণও ক্যান্সারভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সামষ্টিকভাবে কিছু লক্ষণকে ক্যান্সারের সাধারণ বিপদসংকেত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেগুলো হলোÑ কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই হঠাৎ শরীরের ওজন কমতে শুরু করা, রক্তস্বল্পতা ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এবং অস্বাভাবিক দুর্বলতা। মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন হওয়া। যেমনÑকিছুদিন ডায়রিয়া, আবার কিছুদিন কোষ্ঠকাঠিন্য। শরীরের কোথাও কোনো পিণ্ড বা চাকার উপস্থিতি। ভাঙা কণ্ঠস্বর, যা কোনো চিকিৎসায় ঠিক হচ্ছে না। শরীরের একাধিক স্থানে তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন। শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। উল্লিখিত লক্ষণগুলো দেখলে সতর্ক হয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এছাড়া ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু অভ্যাস রপ্ত করে নিতে হবে। এর মধ্যে নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রম ও পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ অত্যাবশ্যক। নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত যৌন অভ্যাস নিশ্চিত করতে হবে। শাক-সবজি, ফলমূল ও বিভিন্ন ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। অধিক ক্যালরি, ফ্যাটযুক্ত খাবার, ধূমপান, তামাক ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মানুষের বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন স্ক্রিনিং পরীক্ষা ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে এই পরীক্ষাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিয়ম অনুযায়ী ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের পাশাপাশি হেপাটাইটিস, এইচপিভির মতো ভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন নিতে হবে। এর মাধ্যমে বেশ কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিপদসংকেত দেখামাত্র দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
কর্মসূচি
ক্যান্সার দিবস উপলক্ষ্যে আজ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী-সামাজিক সংগঠন নানাবিধ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সকাল ৯টায় গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের উদ্যোগে ধানমন্ডি ৬ নম্বর সড়কে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের সামনে প্রতীকী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও আগামী মঙ্গলবার সকাল ১১টায় একই হাসপাতালের ৬ তলায় দেশের প্রথম ক্যান্সার প্রতিরোধ (প্রিভেন্টিভ অনকোলজি) বিভাগের উদ্বোধন করা হবে। এছাড়া এভারকেয়ার হাসপাতাল জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা এবং ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার সোসাইটি বাংলাদেশ ক্যান্সার সচেতনতায় দিনভর লিফলেট ও শোভাযাত্রার অয়োজন করেছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
আগামী সংসদে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের দাবি চরমোনাই পীরের
কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও অনুপ্রবেশকারীর দলে জায়গা হবে না-কেন্দ্রীয় যুব দলের সাধারণ সম্পাদক নুরল ইসলাম নয়ন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাবিতে সমাবেশ
বিগত ৫৩ বছরের জঞ্জাল দূর করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি
তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক ছয়জনের পাঁচজনই ছাত্রলীগের
রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে নিহত ১, থমথমে পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা জারি, ৭২ ঘন্টার অবরোধের ডাক
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনো বিপদমুক্ত নয় : তারেক রহমান
নিরাপদ ও নির্ভয়ে উদযাপন হবে শারদীয় দূর্গোদসব এবং দূর্গাপূজা- এসএমপি কমিশনার রেজাউল করিম
মব কিলিং সরকার সমর্থন করে না: উপদেষ্টা নাহিদ
চট্টগ্রামে রাতের আঁধারে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর
বলিউডে কারিনা কাপুরের ২৫ বছর
মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ
রাজশাহীতে ট্রেনে বরযাত্রীদের ওপর হামলা
চিহ্নিত গোষ্ঠী আবার দখলদারি ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে : সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম চরমোনাই
গায়িকা রুকসানার রহস্যজনক মৃত্যু!
যে কোনো মূল্যে লাহোর কর্মসূচি সফল করুন: ইমরান খান
চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় সিএনজি চালকসহ নিহত ২
যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ভবনে বিচারককে গুলি করে হত্যা
ডিবির সাবেক ডিসি ৭ দিনের রিমান্ডে দলীয় বিবেচনায় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান মশিউর
খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘর্ষ: তিন জেলার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান সরকারের