আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে উদ্দেশ্য করে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের প্রশ্ন রেখেছেন, আমরা কি মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি? দেশকে কি মধ্যযুগে নিয়ে যাচ্ছেন? গতকাল শনিবার বনানী কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আইনমন্ত্রীর কাছে এ প্রশ্ন রাখেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাগর-রুনির হত্যার ঘটনায় সঠিকভাবে দোষী নির্ণয়ে তদন্তের জন্য প্রয়োজনে ৫০ বছর সময় দিতে হবে।’ সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর ১২ বছর চলে গেছে। এ সময়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার ব্যাপারে প্রায় ১০৭ বার সময় নেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জের ধরে জিএম কাদের বলেন, আমাদের কিছু কাজ-কর্মে সরকারি কিছু মন্ত্রীদের বক্তব্য-বিবৃতিতে; উনাদের আমি শ্রদ্ধা করি, অনেককেই শিক্ষিত মানুষ। হঠাৎ করে আমাদের মনে হয়, আমরা মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার দিকে চলে যাচ্ছি কি না? আইনমন্ত্রী হঠাৎ সেদিন একটা কথা বললেন যে, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রায় ১০৭ বার সময় নেওয়া হয়েছে, ১২ বছর চলে গেছে। তারপরও উনি বলছেন, আরো ৫০ বছর লাগলে দিতে হবে। উনার যুক্তি লাগলে দিতে হবে, সঠিক তদন্ত করতে হবে। এই কথাটাকে আমি এভাবে দেখেছি যে, মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় ভালো-মন্দ নির্ধারিত পেশীশক্তির মাধ্যমে। মানে জোর যার, মুল্লুক তার। আইনমন্ত্রীর কথাটা আমার কাছে অনেকটা ওই রকম মনে হয়েছে। কেননা, মধ্যযুগীয় সমাজ থেকে বর্তমান সমাজে পরিবর্তন হচ্ছে পেশীশক্তি ভালো-মন্দ নির্ধারণ করবে না। জোর যার, মুল্লুক তার নয়। জ্ঞান ও যুক্তি; তর্ক হবে, যে যুক্তি দিতে পারবে, জ্ঞানের কথা বলতে পারবে, আমরা সেটা গ্রহণ করব।

জি এম কাদের বলেন, বলা আছে জাস্টিস ডিলেইড ইন জাস্টিস ডিনাইড। কাজেই আরও ৫০ বছর যদি বিলম্বিত হয়, তাহলে তো এটা বিচারহীনতা হলো। সমাজকে কি আমরা বিচারহীনতা উপহার দিতে চাচ্ছি। দায়-দায়িত্ব কার প্রশ্ন রেখে জি এম কাদের বলেন, আমরা তো ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি সমাজ গঠন করার জন্য এই দেশ গঠন করেছি। দায়-দায়িত্ব তো সরকারের ছিল। সাগর-রুনির সন্তান, আত্মীয়, সমাজের দাবি আছে আমি এটার বিচার চাই এবং আমার বিচার চাওয়ার দাবিটা সঠিক দাবি। আপনি দেবেন জন্য আপনি সরকারে আছেন। যদি না দিতে পারেন, আপনি সরকার থেকে চলে যান। আরেকজন যে দিতে পারবে তারাই ক্ষমতায় আসবে। সেখানে জবাবদিহিতা; আপনার ব্যর্থতা, আপনি কী করছেন? গায়ের জোরে, আমি পাওয়ারে আছি, আমি যা বলবো তাই মানতে হবে, তাই লিখতে হবে, আমি বলে দিলাম আরও ৫০ বছর লাগলে দিতে হবে। তাহলে জবাবদিহিতা কোথায় আপনার?

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি তাদের ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হয়। ওই ঘটনার সময় তাদের সঙ্গে শিশু পুত্র মেঘও ওই বাসায় ছিল । মামলায় এ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে তিনবার। আদালতের নির্দেশে এখন মামলাটি তদন্ত করছে র‌্যাব। তারা ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তদন্তের দায়িত্ব পায়।গত এক যুগে র‌্যাব এই মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি। এ পর্যন্ত তারা ১০৭ বার সময় নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘সাগর-রুনির হত্যার ঘটনায় সঠিকভাবে দোষী নির্ণয়ে তদন্তের জন্য প্রয়োজনে ৫০ বছর সময় দিতে হবে।

আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ইস্যু করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়সে ভেলে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে আইনমন্ত্রীর কথার প্রতিক্রিয়ায় রুনির ভাই নওশের রোমান বলেন, ‘আইনন্ত্রীর কথায় আমাদের লজ্জা আর ঘৃণা আসে। এখন আর হতাশা বোধ করি না। আমরা আগেও বলেছি আর এখন আইনমন্ত্রীর কথায় এটা স্পষ্ট যে, সরকার এই মামলার তদন্ত চায় না। হয় সরকারের কেউ অথবা অন্য এমন কেউ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যাদের সরকার আড়াল করতে চায়।’ সাগরের মা সালেহা মুনির বলেন, ‘ওরা তো নিজেরাই এখন জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রাম দেশে কথা আাছে- মাচার তলে কেরে? আমি কলা খাই না। এটা কোন ধরনের কথা? ৫০ বছর পর তো আমরা, হত্যাকারীরা কেউই বেঁচে থাকবো না। তখন এই বিচার কার হবে? কার জন্য হবে? কে দেখবে? এক যুগ তদন্ত করেও তারা কিছু বের করতে পারছে না। আমাদের কিছু জানাচ্ছে না। আর আইনমন্ত্রী হাস্যকর কথা বলছেন।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রতিনিধি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘আমি আর কী বলবো! র‌্যাব শতাধিকবার সময় নিয়েছে। কিন্তু তদন্তের কোনো ফলাফল জানায়নি। তারা না পেলে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিক। এভাবে তো মামলা ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না।’