লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধের এখন সময়
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম
মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে রাজধানীর চিত্রপট পাল্টে দিয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন উঠলে কয়েক মিনিটেই ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া যায়। কর্মজীবী মানুষের কাছে মেট্রোরেল ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করছেন। পেশাজীবী ও কর্মজীবী মানুষ এবং সাধারণ যাত্রীরা যাতায়াতে মেট্রোরেলমুখী হয়ে উঠায় উত্তরা-মতিঝিল, মিরপুর-গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতে যাত্রী কমেছে। কেউ কেউ বলছেন যে পথে মেট্রোরেল গেছে সেই রুটগুলোতে পরিবহন ব্যবসায় ধস নামার উপক্রম হয়েছে। তারপরও সড়কে চলাচল করছে ফিটনেসবিহীন, রংচটা বাস। যাত্রী কমে যাওয়ায় এখনই সময় ফিটনেসবিহীন, লক্কড়ঝক্কড়, রংচটা বাসগুলো সড়ক-মহাসড়ক থেকে উঠিয়ে নেয়া। পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। দেশের গণপরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সড়ক, মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু লক্কড়ঝক্কড় বাস বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। সড়কে ওই সব যানবাহন চলাচলের কথা নয়। নতুন আইন অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি। দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। তাদের লোকবলও আছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেন কীভাবে এসব গাড়ি সড়কে নামছে। আমরা তো অভিযান চালাচ্ছিই।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান জানান, সাধারণত একটা যানবাহনের ফিটনেসের সময়কাল ১০ বছর। কিন্তু ঢাকা শহরে ১০ বছর পেরিয়ে যাওয়া অসংখ্য বাস চলছে। কয়েক বছর আগে ২০ বছরের বেশি বয়সী যানবাহন সড়কে চলাচল করতে পারবে না এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের ওপর পরিবহন মালিকদের প্রভাব থাকায় তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ড. হাদিউজ্জামান বলেন, এখন যেহেতু মেট্রোরেলের কারণে অনেক রুটে বাসযাত্রী কমে গেছে; তাই ফিটনেসবিহীন বাস বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
রাজধানীতে পথের কাঁটা এখন ফিটনেসবিহীন যানবাহন। সবক্ষেত্রে দিনদিন উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলেও রাজপথ যেন চলছে সেই মান্ধাতার আমলের যানবাহন দিয়ে। রাজধানীর এমন কোনো রুট নেই যে রুট দিয়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে না। সব রুটেই দাপটের সাথে চলছে এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হওয়ার পর থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যানজট কমানো ও সড়ক যোগাযোগ সহজ করার জন্য চালু হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এতোকিছুর পরও এখনো ঢাকার রাজপথে চলছে ফিটনেসহীন যানবাহন। মেট্রারেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ রাজধানীর সব রুট থেকে এখন সকল ধরনের ফিটনেসবিহীন যানবাহন উঠিয়ে নেয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। এসব যানবাহনের মধ্যে ৭০ শতাংশ রাস্তায় চলাচল করছে, যা দেশের পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তায় বড় সঙ্কট তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ৫ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৩০ শতাংশ রাস্তায় চলাচল করে না। বাকি ৭০ শতাংশ দেশের পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তায় বড় সঙ্কট তৈরি করছে। তারা ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় পেলে জব্দ করে ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছেন।
প্রতিদিন দেশে ১২ থেকে ১৫ জন সড়কে মারা যাচ্ছেন জানিয়ে নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, এমনকি আমরাও নিরাপদ নই। আমাদের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তা করতে হলে আমাদের সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। পরিবহন মালিক থেকে শ্রমিক ও সড়ক ব্যবহারকারী সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। তা না হলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। শুধু ঢাকায় সড়ক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হলে ১০০ ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন। তবে তাদের অধীনে আছেন মাত্র পাঁচ-ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট। তাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়িগুলো আর রাস্তায় চলবে না। সেই ক্ষেত্রে গাড়ি রাস্তায় চললে ধরা পরলে আমরা সেগুলো আমরা ডাম্পিং করে ফেলবো। এর পরে এই ডাম্পিং গাড়িগুলো আমরা স্রে‹প করে ফেলবো। এটাতো মানসিকতার বিষয়। একটা গাড়ি সুন্দর ফিটফাট হলে যাত্রীরা গাড়িতে উঠবে। চলাচল করেও শান্তি পাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নোটিস আর চিঠিতেই সীমাবদ্ধ বিআরটিএ’র কার্যক্রম। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও নেই মনিটরিং। বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় সড়কে বের হয় না এসব ফিটনেসবিহীন বাস। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় তারা আগেভাগেই জেনে যায়। সে সময় সড়কে গাড়ি কমে যায়। আবার মোবাইল কোর্ট উঠে গেলেই সড়কে দাপিয়ে বেড়ায় এসব বাস। এসব যানবাহন সড়কে চলছে ১৫ থেকে ২০ বছরের অধিক সময় ধরে। নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরেও সড়কে চলাচল করা গাড়ির মধ্যে একটি বড় অংশই ফিটনেসবিহীন ও চলাচলের অনুপযোগী। অনিবন্ধিত এই যানবাহনের সংখ্যা কত, সেই তথ্য বিআরটিএর কাছে নেই। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির পরিমাণ কত সে তথ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক হিসাব বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী। আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনার জন্য ১১ হাজার ৯২৯টি যানবাহন দায়ী। এরমধ্যে ফিট গাড়ির সংখ্যা ৮ হাজার ১৮টি, আনফিট গাড়ি ২ হাজার ৪৪৫টি এবং অন্যান্য ১ হাজার ৪৬৬টি।
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০২২ সালে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫১টি গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে এ সংখ্যাটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৬১টিতে। অর্থাৎ এক বছরে দেশে ২ লাখ ১৭ হাজার ২৯০টি যানবাহনের নিবন্ধন কমেছে। রাজধানীতে চলাচলরত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে (বিআরটিএ) নেই। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বাস ও ট্রাক চলাচলের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার পর সংস্থাটি একটি তালিকা করেছে। এতে দেখা গেছে, ২০ বছরের সীমা নির্ধারণ করা হলে ৩৩ হাজার ১৭৪টি বাস-মিনিবাস রাস্তা থেকে উঠে যাবে। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। বাসের ভাড়া নির্ধারণ করার সময় ধরে নেয়া হয় একটি বাস সর্বোচ্চ ১০ বছর চলাচল করবে। এ সময়সীমার মধ্যেই ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর পর বাস আর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না ধরে নিয়েই যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
স্বপন নামের এক যাত্রী বলেন, বাধ্য হয়েই ফিটনেসবিহীন গাড়িতে চড়তে হচ্ছে। এমন লক্কড়ঝক্কড় বাস রাস্তায় যাতে চলতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব তো পুলিশের। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনক কারণে কিছু বলে না, তাই এরা আমাদের কাছে থেকে ভাড়া ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু সেবা দিচ্ছে না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সারাদেশে এখন ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে গণপরিবহনকে স্মার্ট হতে হবে। স্মার্ট গণপরিবহনের বিকল্প নেই। গণপরিহনের মান উন্নত করতে হবে। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করার জন্য কিন্তু মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেই ঢাকার রাস্তার গণপরিবহনের চেহারা পাল্টে যাবে। এখানে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সরকার চাইলেই সবকিছু সম্ভব। তেমনি সরকার চাইলেই সড়কে ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন বন্ধ করা সম্ভব।
উত্তরা ট্রাফিক বিভাগের ডিসি (অতিরিক্ত ডিআইজি) নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, আমরা ফিটনেস বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা কারছি। রাস্তায় আগের চেয়ে এখন ফিটনেসবিহীন গাড়ি কমে এসেছে। অনেক সময় দেখা যায় গাড়ি দেখতে লক্কড়ঝক্কড় হলেও এসব গাড়ির ফিটনেস কাগজপত্র ঠিক আছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
স্কুলে মাধ্যমিকে যুক্ত হচ্ছে আরবি, নেটিজেনদের উচ্ছ্বাস
মহেশপুর সীমন্ত থেকে নারী ও শিশুসহ ৩৬ জন আটক
জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে হত্যা মামলা
বিশ্ববাজারে নতুন প্রযুক্তির গাড়ি উদ্ভাবনে ভক্সওয়াগন ও রিভিয়ানের চুক্তি
মণিপুরের জ্বলছে, নারী ও শিশুসহ নিখোঁজ ৬
গাজীপুরে আবারও ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ
ড.মুহাম্মদ ইউনুস জলবায়ু সম্মেলনে আজ দুপুরে ভাষণ দেবেন
আগামী ১৪ ই ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেতে চলেছে 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা: ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড'
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রোজি কবিরের ইন্তেকাল
ঢাকা মহানগরীর ৫ থানায় নতুন ওসি
টেকনাফের হ্নীলা থেকে বিজিবির অভিযানে ১ লাখ পিস ইয়াবা, ১টি এলজি ও ১ রাউন্ড গুলিসহ এক রোহিঙ্গা যুবক আটক
‘উই আর নাহিদ’ হ্যাশট্যাগে নেটিজেনদের সমর্থন
জলবায়ু সম্মেলনে সাশ্রয়ী উপায়ে বিমানের ধোঁয়া কমানোর প্রস্তাব বিজ্ঞানীদের
এনআইবির মহাপরিচালক নিয়োগে সুপারিশ নিয়ে যা বললেন নাহিদ
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঢাকায় আসছে
এবার হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরাইলি দুই ব্যক্তি নিহত
তৃতীয়বার কমলো স্বর্ণের দাম
আবারও পুলিশের ঊর্ধ্বতন ২৮ কর্মকর্তাকে বদলি
আবারও ইসরাইলি হামলায় গাজা-লেবাননে নিহত ৯১
প্রথম এয়ার ট্যাক্সি স্টেশন নির্মিত হচ্ছে দুবাইয়ে