ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১

জাবি সংলগ্ন এলাকায় ছাত্রলীগ নেতার রাজত্ব

Daily Inqilab জাবি সংবাদদাতা

০৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাশ্ববর্তী এলাকায় জাহিদুল হক সময় সাবেক এক শিক্ষার্থীর ছত্রছায়ায় গড়ে তুলেছেন ত্রাসের রাজত্ব। ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁদাবাজি, মাদক, ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। ক্ষমতা ও দলীয় প্রভাবের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস না পেলেও ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে তার অপকর্মের ইতিহাস।

জাহিদুল হক সময় ঢাকা জেলা উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। তিনি আশুলিয়া থানাধীন বড়রাঙ্গামাটিয়ার সেনওয়ালিয়া এলাকার মৃত জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে। এছাড়া সময়ের বড়ভাই নাহিদুল হক জয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং জাবি শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও মওলানা ভাসানী হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের (৪১তম ব্যাচ) সাবেক শিক্ষার্থী আরমান খান যুবর নাম ভাঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী আমবাগান, পানধোয়া ও সেনওয়ালিয়াসহ আশেপাশের এলাকায় ডিশ, ইন্টারনেট ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন জাহিদুল হক সময় ও তার সহযোগী মো. তাসকিন খান। আরমান খান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ছোটভাই। এদিকে সময়ের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করারও অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ফেনসিডিলসহ পুলিশের কাছে কয়েকবার আটক হয়েছেন তাসকিন। এছাড়া তাসকিন ও সময়ের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একাধিক মামলা দায়ের করা হলেও তারা প্রকাশ্যে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, যুবর শেলটারে আশপাশের এলাকার সকল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন সময় ও তাসকিন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই মারধর করতেন, প্রাণনাশের হুমকিও দিতেন। ক্ষমতা ও দলীয় প্রভাবের ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতেন না। তবে সম্প্রতি আশেপাশের এলাকায় ‘ময়লা অপসারণ’ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে সময় ও তাসকিনের অপকর্ম সামনে আসছে।

জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক মো. মনসুর আলী পানধোয়া এলাকায় মাদক বেচাকেনা বন্ধ করতে আওয়াজ তুললে জাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা ও তাসকিন গ্যাং প্রকাশ্যে ওই শিক্ষকের উপর গুলি চালায়। এ ঘটনায় ২০২২ সালের ৬ আগস্ট আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন ওই শিক্ষক। মামলা নং-২২। এর আগে, গকুলনগরের সেনওয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও ইটবালু ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন চৌধুরীকে মারধর ও ৩ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করেন সময় ও তাসকিন। বেলাল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে থাকা এক লক্ষ ২০ টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে বাকী টাকা আদায়ের জন্য বেলালকে তুলে নিয়ে মারধর ও হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় ২০২২ সালের ৬ জুন ভুক্তভোগীর স্ত্রী আফরোজা চৌধুরী আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১০১।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আমবাগান এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করেন মো. তাসকিন খান। এর আগে, তিনি কয়েকবার ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। তার অন্যতম সহযোগী মুন্না নামে এক যুবক সম্প্রতি ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক হন। সে সংক্রান্ত কিছু তথ্য প্রমাণ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এছাড়া তাসকিনের শেলটারদাতাদের মধ্যে জাহিদুল হক সময় অন্যতম। এমনকি তাসকিন ও সময়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদক সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকার ‘ময়লা অপসারণ’ ব্যবসা পরিচালনা করতেন মো. বাবু আলী। গত তিনমাস আগে বাবুর কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন সময়। তবে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় ‘ময়লা অপসারণ’ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নেন সময় ও তাসকিন। পরে মাসুদ ও আশরাফ নামে দুই ব্যক্তিকে ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন তারা। তখন তাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন বাবু। এ ঘটনায় পরও ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা করছিলেন বাবু। তবে ময়লা অপসারণ করতে আসলেই বাবুর লোকজনকে মারধর ও হুমকি দিতেন সময় ও তাসকিনের অনুসারীরা। সর্বশেষ গত সোমবার (০৪ মার্চ) ময়লা অপসারণ করতে আসলে বাবুর স্ত্রী রেনু বেগম ও তার ছেলে হেলাল উদ্দিনের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় সময়, তাসকিন, মুন্না ও টুটুলসহ অজ্ঞাত কয়েকজন। এ ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন বাবু।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মো. বাবু আলী বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ময়লা অপসারণের ব্যবসা করছিলাম। তবে সময় ও তাসকিন আমার কাছে প্রতিমাসে এক লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। তাদের দাবি অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় অবৈধভাবে তারা মানিক ও আশরাফকে ময়লা অপসারণের অনুমতি দেয়। তবে সম্প্রতি তারা চলে গেলে আমি আবার ব্যবসা শুরু করি। তবে সময় ও তাসকিন আমার ছেলেকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিতো। সর্বশেষ গতকাল সোমবার তারা হামলা চালিয়ে আমার ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।’

অন্যদিকে সময়ের বিরুদ্ধে ইসলামনগর এলাকার রহিম নামে এক ব্যক্তির সম্পত্তি জোরপূর্বক অন্যদের লিখে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, নানা বিষয়ে রহিমের সঙ্গে তার স্ত্রী ও মেয়ের জামাইয়ের দ্বন্দ্ব চলছিলো। ফলে জোরপূর্বক সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য সময়কে ১৫ লাখ টাকা দেয় রহিমের স্ত্রী ও মেয়ের জামাই। পরে সময় ও তার সহযোগীরা মিলে দলিলে জোরপূর্বক রহিমের স্বাক্ষর নেয়। এছাড়া রহিমের কাছ থেকেও এক লাখ টাকা আদায় করে।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী রহিম বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও মেয়ের জামাই মিলে আমার নামে ষড়যন্ত্র করে। তারা আমার সম্পত্তি লিখে নেওয়ার জন্য জাহিদুল হক সময়কে ১৫ লাখ টাকা দেয়। সময় ও তার সহযোগীরা পিস্তলের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক আমার স্বাক্ষর নেয়। এছাড়া ৪ লাখ টাকা দাবি করে। পরে আমি এক লাখ টাকা দেই। বাকি টাকা না দেওয়ায় আমাকে মারধর করে।’
এছাড়া সময় ও তাসকিনের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি ও মারধর এবং মাদক ব্যবসা পরিচালনাসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় একাধিকবার সময় ও তাসকিনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা। সেসব অভিযোগের কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

অভিযোগের বিষয়ে জাহিদুল হক সময় বলেন, ‘যেদিন বাবুর ছেলে হেলালকে চাপাতি দিয়ে কোপ দেওয়া হয়, সেদিন ভোরেই আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গেছিলাম। সেসব প্রমাণ ও সরকারি কাগজপত্র আমার কাছে আছে। যতদুর শুনেছি, ময়লা অপসারণকারীদের দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়েছে। আমি রাজনীতি করি বলেই তারা ষড়যন্ত্র করে আমার নাম দিয়েছে। আমি তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব।’

ইসলামনগর এলাকায় রহিমের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রহিমের পারিবারিক সমস্যা ছিল, তা নিয়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষকরা বিচার করে দেয়। যার ডকুমেন্টস আমার কাছে আছে। এখানে টাকা নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।’

তার সহযোগী তাসকিনের সাথে মাদক ব্যবসায়ে জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সিগারেট পর্যন্ত খাই না, মাদক তো দূরের কথা। আমার বিরুদ্ধে বিগত সময়ে মাদকের কোনো নিউজ নাই। তাহলে আমি কিভাবে মাদকের ব্যবসা করব?’

এসব বিষয়ে জানতে আশুলিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফএম সায়েদকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ওসমানী হাসপাতালের দুই কর্মচারীকে বরখাস্ত

ওসমানী হাসপাতালের দুই কর্মচারীকে বরখাস্ত

রোমাঞ্চকর মিলান ডার্বিতে ইন্টারের হার

রোমাঞ্চকর মিলান ডার্বিতে ইন্টারের হার

ইন্টারনেটের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় চীন

ইন্টারনেটের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় চীন

মধ্যরাতে রাজধানীর সড়কে সড়কে সেনা চেকপোস্ট

মধ্যরাতে রাজধানীর সড়কে সড়কে সেনা চেকপোস্ট

বিপন্ন মেরু ভালুককে গুলি করে হত্যা, তোপের মুখে আইসল্যান্ডের পুলিশ

বিপন্ন মেরু ভালুককে গুলি করে হত্যা, তোপের মুখে আইসল্যান্ডের পুলিশ

বাড়িতে ঢুকে আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা

বাড়িতে ঢুকে আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা

নদীতে মেহেদী রাঙা হাতে ‘আই লাভ ইউ’ লেখা যুবতীর লাশ উদ্ধার

নদীতে মেহেদী রাঙা হাতে ‘আই লাভ ইউ’ লেখা যুবতীর লাশ উদ্ধার

গান গেয়ে উল্লাস করে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, সমালোচনার ঝড়

গান গেয়ে উল্লাস করে যুবককে পিটিয়ে হত্যা, সমালোচনার ঝড়

বড় জয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়াল দ. আফ্রিকা

বড় জয়ে হোয়াইটওয়াশ এড়াল দ. আফ্রিকা

গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়

গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়

রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড

রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড

ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ

ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে