৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ‘কার্যকর প্রতিযোগিতা’ ছিল না
১৮ মার্চ ২০২৪, ১২:২৩ এএম | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৪, ১২:২৩ এএম
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ৭ জানুয়ারির বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশের কয়েক দিন পর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। প্রতিবেদনে বলা হয়,বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের গুণগত মান বেশ কিছু কারণে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর মধ্যে আছে- রাষ্ট্র, শাসক দল এবং বিরোধীদের সহিংসতা, নির্বাচনের আগে জিরোসাম রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সহিংসতার মনোভাব, নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচন, বাক স্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতার অবনতি। গত শনিবার নির্বাচন নিয়ে এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় নিজস্ব ওয়েবসাইটে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত রিপোর্টে ‘মান সম্পন্ন নির্বাচন হয়নি’ বলেছে এনডিআই এবং আইআরআই আরো বলেছে, নির্বাচনে কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি ছিল। ক্ষমতাসীন দলকে সুবিধা দিতে অসম বিধি প্রয়োগ করা হয়েছে। বিরোধীদের দমন কর হয়েছে, যা ন্যায়সঙ্গত ছিল না। আইন প্রয়োগকারীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আছে। ভোট নিয়ে নারী ও দুর্বল গোষ্ঠী উচ্ছেদ আতঙ্কে ছিলেন। আর প্রতিশোধের ভয়ে মিডিয়া স্বেচ্ছা সেন্সরশিপ করেছে। এ বিষয়ে তাদের টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট মিশন (টিএএম) চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছে, মিশন সদস্যরা দেখতে পেয়েছেন- ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময়ে, প্রচারণার সময়ে, নির্বাচনের দিনসহ অন্য সময়ে আগের নির্বাচনের তুলনায় শারীরিক ও অনলাইন সহিংসতা হয়েছে কম। দেশজুড়ে কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি ছিল। দ্বিতীয়ত বিরোধী দল দমন ও নিরাপত্তায় সরকারের বাড়তি নজর ছিল।
চূড়ান্ত রিপোর্টে এনডিআইয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক মনপ্রীত সিং আনন্দ বলেছেন, এই প্রতিবেদন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আরো শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের একটি মূল্যবান রোডম্যাপ হিসেবে অবদান রাখবে। অহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল, সরকার এবং নাগরিক সমাজসহ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নেতাদের নির্বাচনী রাজনীতির নিয়ম, অনুশীলন ও আইন সংস্কার করার প্রয়োজন আছে।
এতে বলা হয়, এনডিআই এবং আইআরআই সারাবিশ্বে নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলোকে নিরীক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষক ও কারিগরি বিশ্লেষক দল নিয়োগ করে। আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপারিশ করে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পিইএম- নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রী ও অন্য সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক মহলের দলগুলোর নেতারা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নাগরিক নির্বাচক পর্যবেক্ষক দলের নেতাসহ, সংসদের নারী সদস্য, যুব, প্রতিবন্ধী, ব্যক্তি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি, মিডিয়া প্রতিনিধি, আইনি সম্প্রদায়ের সদস্য এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি এবং কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। মিশন শেষে পিইএএম পাঁচটি সম্পাদনাযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী অংশীজনদের জন্য সুপারিশগুলো শান্তিপূর্ণ পথে একটি রোডম্যাপ হিসেবে অনুসরণ করার জন্য স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন রয়েছে।
এর মধ্যে আছে এক. মধ্যপন্থী রাজনৈতিক বক্তৃতা, দুই. মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা, তিন. অহিংসতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, চার. নির্বাচনে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা এবং পাঁচ. একটি অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
ফলাফল এবং সুুপারিশের সার-সংক্ষেপ : রিপোর্টে বলা হয়েছে, অংশীজন প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করে যে- ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময়কাল, প্রচারের সময়কাল, নির্বাচনের দিনসহ অন্যান্য সময়ে, পূর্ববর্তী নির্বাচনের তুলনায় শারীরিক এবং অনলাইন সহিংসতা কম হয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছুু পদক্ষেপ নিয়েছে, নির্বাচনী নিরাপত্তার জন্য বাজেট বাড়ানো, দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিপুুলসংখ্যক নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য অ্যাডহক সমন্বয় ইউনিট গঠন। তারপরও অনেক অংশীজন অভিযোগ করেছেন যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুুবিধা দিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষেবা এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বারবার অসমভাবে নির্বাচনী বিধি প্রয়োগ করেছে। বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেফতার এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত বা ব্যাহত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা সন্তোষজনক ছিল না, ন্যায়সঙ্গত ছিল না এবং এর ফলে নির্বাচনকালীন সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ধারণা তৈরি হয়েছিল।
বিরাষ্ট্রীয় ব্যক্তিদের দ্বারা নির্বাচনী সহিংসতা প্রথমত দুই ভাবে ঘটেছে। যার প্রথম রূপটি ছিল প্রার্থী এবং সমর্থকদের প্রতিযোগিতার মধ্যে। নির্বাচনী এলাকায় প্রচারাভিযান কেন্দ্রিক নির্বাচনী সহিংসতা যা সাধারণত আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ছিল, যদিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সাবেক প্রার্থীদেরও টার্গেট করা হয়েছে। যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখ্য ছিল সমর্থকদের গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, প্রচার মিছিলে হামলা, প্রচার কার্যালয় ধ্বংস বা অগ্নিসংযোগ, মৌখিক হুমকি, এবং ভাংচুুর বা সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ।
সহিংসতার দ্বিতীয় রূপটি চালিত হয়েছিল বিরোধীদের বয়কট প্রচেষ্টার দ্বারা, যদিও বিরোধী দল ধারাবাহিকভাবে অহিংসার আহ্বান করেছে, নির্বাচন ঠেকাতে এর সমাবেশ, অবরোধ এবং ধর্মঘটের কৌশলের কথা বলেছে। তারপরেও অগ্নিসংযোগ, শারীরিক হামলা, ভাংচুুর, ভীতি প্রদর্শন সহ সহিংসতা মাঝে মাঝে ঘটেছে এবং একজন পুুলিশ অফিসারের মৃত্যুও ঘটেছে। প্রান্তিক গোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী এবং হিন্দুুরাও নির্বাচনী সহিংসতার সম্মুুখীন হয়েছে। প্রতিবেদন এবং অংশীজনদের প্রতিক্রিয়ায় পাওয়া যায় যে, নারীদের লক্ষ্য করে নির্বাচনী সহিংসতা অতীতের তুলনায় কম ছিল। টিএএম দেখেছে যে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পূূর্ণভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। এতে প্রতীয়মান হয় যে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে এবং তাদের সক্ষমতা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এই নির্বাচনে মহিলা প্রার্থীরা টিএএমকে বলেছেন যে, তারা অপমানিত হয়েছেন এবং জনসমক্ষে এবং অনলাইনে হুমকি, বিশেষ করে পুুরুষ প্রতিপক্ষ এবং তাদের অনুুগামীদের কাছ থেকে, এবং বলেছেন যে রাষ্ট্র কর্মকর্তারা তাদের অভিযোগের জবাব দেননি। অংশীজনরা আরও উল্লেখ করেছেন যে নারী ভোটার ও অন্য দুর্বল গোষ্ঠীর ভোটাররা ভোট দেয়ার জন্য অর্থনৈতিক চাপের সম্মুুখীন হয়েছিল, যার মধ্যে উচ্ছেদ বা রাষ্ট্রের কল্যাণমুুখী সুুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার হুমকি অন্তর্ভুুক্ত ছিল।
বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুুরাও উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী সহিংসতার সম্মুুখীন হয়েছে। উপলব্ধ থাকাকালীন প্রতিবেদন এবং স্টেকহোল্ডারদের প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করে যে বিগত নির্বাচনের তুলনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুুদের লক্ষ্য করে নির্বাচনী সহিংসতা কম ছিল, হিন্দুু জনগোষ্ঠী এবারও উল্লেখযোগ্যভাবে ভীতি ও সহিংসতার সম্মুুখীন হয়েছে বিশেষভাবে প্রচারণার সময়ে।
সবশেষে, তথ্য প্রবাহে ভিন্ন প্রবণতা দেখা গেছে। বিশিষ্ট সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোতে এবং ক্ষমতাসীন দল এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কের সমালোচনামূলক বিবৃতি ও প্রতিবেদনের জন্য কিছুু জায়গা অন্তর্ভুুক্ত ছিল। যাই হোক, অংশীজনরা আরো উল্লেখ করেছেন যে সরকারের প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ের ফলে মিডিয়া স্ব-সেন্সরশিপ করে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আগে ৮ থেকে ১১ অক্টোবর আইআরআই এবং এনডিআই একটি প্রাক নির্বাচন মূল্যায়ন (পিইএএম) সম্পন্ন করেছে। এই দলের সদস্য ছিলেন আইআরআইয়ের কো চেয়ার বনি গ্লিক, এনডিআই কো-চেয়ার সাবেক ডেপুটি ইউএসএআইডি প্রশাসক; কার্ল এফ ইন্টারফারথ, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মারিয়া চিন আবদুল্লাহ, মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক সদস্য; জামিল জাফর, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাবেক সহযোগী কাউন্সেল; জোহানা কাও, আইআরআই সিনিয়র ডিরেক্টর, এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগ; এবং মনপ্রীত সিং আনন্দ- এনডিআইয়ের আঞ্চলিক পরিচালক, এশিয়া প্যাসিফিক।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ