ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১
বিজিবি-বিএসএফয়ের ডিজি পর্যায়ের সম্মেলনের সাত দিনের মাথায় কুলাউড়া সীমান্তে বাংলাদেশী কিশোরকে গুলি করে হত্যা

সীমান্তে এখনো বেপরোয়া বিএসএফ

Daily Inqilab সাখাওয়াত হোসেন

২০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম

বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ-ভারতের উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও তা কাজে আসছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও। ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ ডিজি পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলনের সাত দিনের মধ্যে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে বাংলাদেশী কিশোর সাদ্দাম হোসেন (১৫)কে। অথচ ঢাকায় গত ৫-৯ মার্চ বিজিবি-বিএসএফ ডিজি পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিএসএফয়ের ডিজি নিতিন আগারওয়াল বলেছিলেন, সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয় না। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত ১৭ মার্চ কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সাদ্দাম হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় একই গ্রামের মৃত সাদাই মিয়ার ছেলে ছিদ্দিকুর রহমানও (৩৪) আহত হন। এর আগে বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিী।
বাংলাদেশের ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ সীমান্তের কাটাতারে ঝুলে থাকার ছবি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। সীমান্ত হত্যা নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৪৫ জন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটলেও একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি। এই বিচারহীনতাই সীমান্ত হত্যাকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মানবাধিকারকর্মী ও পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সীমান্তে নাগরিকদের মৃত্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে যতটা জোরালো প্রতিবাদ জানানোর রেওয়াজ ছিল, এখন সেটা ততটা জোরালো নয়। অনেকে হয়রানির ভয়ে বিএসএফের নির্যাতনের কথা স্বীকার করছেন না। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনসহ নানা সময়ে সীমান্ত-হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ। এ ছাড়া সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারেরও সিদ্ধান্ত হয় দফায় দফায়। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই কাজে আসছে না। সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৯০ শতাংশই সংঘটিত হয় গুলিতে। পিটিয়ে বা নির্যাতন করে এবং পানিতে ডুবিয়ে মারার ঘটনাও ঘটছে সীমান্তে। অথচ হত্যাকাণ্ড বন্ধে বিজিবির পক্ষ থেকে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। এ ধরনের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতি দেন। এরপরও থামেনি সীমান্ত হত্যা। নিরপরাধ লোকদের লক্ষ্য করেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা গুলি ছুড়ে থাকেন। এমনকি অপহরণের ঘটনাও ঘটে কখনো কখনো। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, কোনো মানুষকে হত্যা বা গুলি করে হত্যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সীমান্তে কোনো মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে না। প্রতিবারই আমরা আশার বাণি শুনি, পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তৎপর হতে হবে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে সংশ্লিষ্ট এই দপ্তরগুলোতে তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে। দুই দেশেই আইন আছে, তবুও সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন।

মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান লিটন বলেন, বিগত দিনে সীমান্ত হত্যা নিয়ে শুধু বিএসএফ-বিজিবির ঊর্ধ্বতনদের মধ্যেই বৈঠক হয়নি, দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হতে দেখেছি। তখনও শুনেছি সীমান্ত-হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে, সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু তারপরও দেখছি আগের মতোই হত্যাকাণ্ড-নির্যাতন চলছেই।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সীমান্ত-হত্যা নির্যাতন ইস্যুটির সমাধান হচ্ছে না। তাই আমি মনে করি, বিষয়টি জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক দরবারে আনতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের যেসব নাগরিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাদের কেউ সশস্ত্র ছিলÑ এমন আলামত দেখাতে পারবে না। প্রতিনিয়ত আমাদের সীমান্তে বিএসএফ যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা থাকার পরও কিন্তু সেখানে এমন ঘটনা ঘটে না।

সীমান্ত এলাকার স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই চোরাকারবারীরা সকলকে গোপনে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। তবে মাঝে-মধ্যে যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ থাকে তখন কাউকে দেখা মাত্রই গুলি ছোড়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। অনেক সময় গুলি করে মানুষ হত্যা করে লাশও নিয়ে যায় তারা। তবে প্রতিটি সীমান্ত এলাকাতেই রয়েছে কিছু দালালচক্র। তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চলে সকল অপকর্ম। ২০১১ সালে সীমান্তে ফেলানি হত্যার নির্মম ঘটনা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে। এর বছর ছয়েক পরে ২০১৮ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। তবে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে তেমন রূপ নেয়নি বললেই চলে। ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে বিএসএফ সীমান্তে মৃত্যুর ঘটনাকে বলছে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট

একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট

আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই

আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই

যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই

যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই

সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন

সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন

ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে  ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র‌্যালি

ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র‌্যালি

ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত

ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী

ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী

ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১

ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১

যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ

যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক আওয়ামী লীগ তা কখনও চায়নি : শিমুল বিশ্বাস

দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক আওয়ামী লীগ তা কখনও চায়নি : শিমুল বিশ্বাস