দেশের চিনিকলগুলো বন্ধ-বিক্রি করে দেয়ার খেসারত

বাংলাদেশে চিনির দাম ভারতের তিনগুণ

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম

দেশে কয়েক বছরে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি ট্যানেল, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও প্রায় সব পাটকল, টিনিকল কোনোটা বিক্রি কোনোটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে চিনিতে এখন বাংলাদেশ বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়েছে। ভারতে যখন চিনির কেজি ৪৩ রুপি তখন বাংলাদেশে চিনির কেজি ১৩৫ থেকে ১৫০ টাকা। চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের মানুষকে ভারতের দিনগুন বেশি দামে চিনি কিনে খেতে হচ্ছে। দেশে মাত্র ৬টি কোম্পানী চিনি আমদানি করায় তারা নিজেদের মতো করে চিনির দাম নির্ধাণর করে থাকেন। ফলে ভোক্তাদের পাশের দেশ ভারতের চেয়ে তিনগুন বেশি দামে চিনি খেতে হচ্ছে। তবে আমদানি কারকদের দাবি প্রতিকেজি চিনি আমদানিতে সরকারকে ৪০ থেকে ৪২ টাকা শুলক্ দিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতের বাজারে এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৩ রুপিতে। বাংলাদেশি টাকায় প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৫৭ টাকা। সেখানে বাংলাদেশের বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। ভারতের প্রায় আড়াই গুণ দামে চিনি কিনেক্ষুব্ধ ভোক্তারা। বাড়তি দামের জন্য সরকারের অতিরিক্ত করকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। পার্শ্ববর্তী দুই দেশের চিনির দামে এত বড় ফারাক নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। তবে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বড় পার্থক্য বাংলাদেশ আমদানিকারক আর ভারত চিনির রপ্তানিকারক দেশ। তবে মাঝে মধ্যে নিজেদের উৎপাদন কম হলে ভারতও চিনি আমদানি করে। ভারত থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেও পরিশোধন করছে বাংলাদেশের মিলগুলো। আবার বাংলাদেশের মতো ভারতের ব্যবসায়ীরা শুল্ক-কর পরিশোধ করে বাজারে সেই চিনি তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করছেন ভারতের বাজারে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মধ্যে এ দামের বড় ফারাক আসলে কতটুকু প্রাসঙ্গিক। চিনির দাম এতো বেশি হওয়ায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। গতকাল শনির আখড়া বাজারে চিনি কিনতে এসে ইয়াসির হোসেন বলেন, সব সময় দেখবেন চিনি নিয়ে খামখেয়ালি হয়। সরকার একদম নির্ধারণ করে দেয় কিন্তু বাজারে গেলে সে দামে চিনি পাওয়া যায় না। তারা (কোম্পানিগুলো) কিছু মানতে চায় না। কোম্পানিগুল আমাদের জিম্মি করে টাকা আদায় করে। সরকারও তাদের কিছুই বলে না। প্রায় ছয় মাস ধরে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় চিনি কিনছি।
ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী আবু হোসেন বলেন, চিনি কোম্পানিগুলো সব সময় তাদের মনমতো চিনির দাম নির্ধারণ করে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও তারা কমাতে চায় না, কিন্তু বেড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তারা দাম বাড়িয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে প্রতি কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট কর আরোপিত হয় ৬০ শতাংশের ওপর, টাকার অঙ্কে যা ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি চিনিতে সরকারকে দিতে হচ্ছে এত টাকা। এটা ভারতে নেই। চিনি ভারতের নিজস্ব পণ্য। তারা বিশ্ববাজারে চিনি রপ্তানি করে। উল্টো ভারত সরকার চিনিতে প্রণোদনা দিতে পারে। কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর আরেক অস্ত্র ‘কৃত্রিম চিনির সংকট’ তৈরি করা। যখন খুশি মিল থেকে সরবরাহ বন্ধ করে ব্যবসায়ীদের থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে। দাম বাড়লে কম দামে বিক্রি করা ডিও›র চিনি দিতে চায় না। তখন বাজারে এমনিতেই সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হয়ে চিনির দাম বেড়ে যায়।
দেশের চিনিকলের মালিকরা বলছেন, অবৈধভাবে চিনি আসার কারণে বৈধপথে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। পাশাপাশি অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে দেশের চিনিকলগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে বৈধপথে চিনি আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন অনেক আমদানিকারক। চোরাচালান বন্ধে সরকারের কাছে সহযোগিতা চান তারা।
দেশে দেশবন্ধু, আবদুল মোনেম, এস আলম, মেঘনা, সিটি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রধান চিনি সরবরাহকারী। বাংলাদেশের চিনির বাজার এখন মূলত এই পাঁচটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। কারখানাগুলো হলো- মেঘনা সুগার রিফাইনারি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রি, এস আলম রিফাইন্ড সুগার রিফাইনারি, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি ও দেশবন্ধু সুগার রিফাইনারি। এসব কারখানা অপরিশোধিত চিনি এনে পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে।
বেসরকারি এ পাঁচটি চিনিকলের দৈনিক পরিশোধনের সক্ষমতা ১৫ হাজার টনের বেশি। সারাদেশে চিনির দৈনিক চাহিদা সাড়ে ৬ হাজার টন। অর্থাৎ, চাহিদার তুলনায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে বছরে ৩০ হাজার টনের মতো চিনি উৎপাদন হচ্ছে। সব মিলে দেশে চিনির জোগানের কোনো ঘাটতি নেই।
পাশের দেশ ভারতের তুলনায় চিনির দামে কেন এত ফারাক- এ প্রশ্নে দেশের অন্যতম চিনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, সব মিলিয়ে প্রতি কেজি চিনি ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত মোট কর আরোপিত হয় ৬০ শতাংশের ওপর, টাকার অঙ্কে যা ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি চিনিতে সরকারকে দিতে হচ্ছে এত টাকা। এটা ভারতে নেই। চিনি ভারতের নিজস্ব পণ্য। তারা বিশ্ববাজারে চিনি রপ্তানি করে। উল্টো ভারত সরকার চিনিতে প্রণোদনা দিতে পারে।
ভারত নিজেরা উৎপাদন করে, এটা তাদের দেশে চিনির দাম কম থাকার কারণ হতে পারে। তবে দামের পার্থক্য এত হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা মুনাফা বেশি করেন, সেই অভিযোগও আছে।- বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ
এদিকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এ চিনির প্রায় পুরোটা বিদেশ থেকে আমদানি করে পরিশোধন করা হয়।
এসব বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত নিজেরা উৎপাদন করে, এটা তাদের দেশে চিনির দাম কম থাকার কারণ হতে পারে। তবে দামের পার্থক্য এত হওয়ার কথা নয়। আমাদের ব্যবসায়ীরা মুনাফা বেশি করেন, সেই অভিযোগও আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে মোট চিনি আমদানি হয়েছিল তিন লাখ ৮৮ হাজার টন। সেখানে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৩৬ হাজার টন। সেই হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে দেড় লাখ টনের বেশি চিনি কম আমদানি হয়েছে। চিনি চোরাচালান হতে পারে এর কারণ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা
ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!
আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং
আরও
X
  

আরও পড়ুন

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ

আমিরাতের উন্নয়নে বাংলাদেশিদের অবদানের প্রশংসা এবং সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা

কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা

ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!

ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ঘটনায় ভারতের উদ্বেগ!

আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে

আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে না: প্রেস উইং

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে পতিত সরকারের করা চুক্তি স্থগিত করুন

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে পতিত সরকারের করা চুক্তি স্থগিত করুন

কমলো উড়োজাহাজের তেলের দাম

কমলো উড়োজাহাজের তেলের দাম

লিবিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাসিন্দাদের ঘরে থাকার নির্দেশ

লিবিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষ, বাসিন্দাদের ঘরে থাকার নির্দেশ

আমরা কি নতুন কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি? প্রশ্ন মেজর হাফিজের

আমরা কি নতুন কোনও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি? প্রশ্ন মেজর হাফিজের

মঙ্গলের মাটির তলায় তরল পানির সন্ধান

মঙ্গলের মাটির তলায় তরল পানির সন্ধান

পুঁজিবাজারে আবারো বড় দরপতন

পুঁজিবাজারে আবারো বড় দরপতন

পুঁজিবাজারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ চান বিএমবিএ

পুঁজিবাজারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ চান বিএমবিএ

ক্রিলিক একটি পরিপূর্ণ জ্ঞান ভান্ডারে পরিণত হবে -এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী

ক্রিলিক একটি পরিপূর্ণ জ্ঞান ভান্ডারে পরিণত হবে -এলজিইডি’র প্রধান প্রকৌশলী

হাইকোর্টের আদেশ চেম্বারে স্থগিত নগদে প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ

হাইকোর্টের আদেশ চেম্বারে স্থগিত নগদে প্রশাসক নিয়োগ অবৈধ

পুলিশ কোনো কিলার ফোর্স হতে পারে না : আইজিপি

পুলিশ কোনো কিলার ফোর্স হতে পারে না : আইজিপি

হাসিনার ভয়ে যারা গর্তে লুকিয়ে ছিল তারা এখন সংস্কারের তালিম দিচ্ছে : আমীর খসরু

হাসিনার ভয়ে যারা গর্তে লুকিয়ে ছিল তারা এখন সংস্কারের তালিম দিচ্ছে : আমীর খসরু

সিএজি কার্যালয়ে বিশেষ সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন

সিএজি কার্যালয়ে বিশেষ সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন

পদ্মা সেতু দিয়ে কি নদীর ক্ষতি করছেন না, প্রশ্ন মৎস্য উপদেষ্টার

পদ্মা সেতু দিয়ে কি নদীর ক্ষতি করছেন না, প্রশ্ন মৎস্য উপদেষ্টার

অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে তিতাসের সাঁড়াশি অভিযান

অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে তিতাসের সাঁড়াশি অভিযান