নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রংপুর অঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী
২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ এএম
ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে নাব্যতা হারিয়ে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রংপুর অঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী। পানির অভাব এবং অবৈধ দখলদারদের কারণে ইাতোমধ্যে অনেক নদ-নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেক নদী ইতোমধ্যে অস্তিত্ব হারিয়ে ফসলের ক্ষেতে পরিণত হয়েছে।
সীমান্তবর্তী দেশ ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মওসুমে একতরফা ভাবে পানি প্রত্যাহার করায় এ অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। অর্ধশতাব্দী আগেও এসব নদীতে ছিল যথেষ্ট পানির প্রবাহ, ছিল উত্তাল যৌবন। কিন্তু এখন সেই যৌবনে ভাটা পড়ায় হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে রংপুর অঞ্চলের শাতাধিক নদীর অস্তিত্ব। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশ, কৃষি এবং নিম্নআয়ের মানুষের সামাজিক জীবনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের উত্তর জনপদের প্রাচীনতম জনপদ রংপুর অঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলায় আছে অসংখ্য নদ-নদী। এরমধ্যে গাইবান্ধায় রয়েছে আলাই, ইছামতি, করতোয়া, কাটাখালি, কালপানি, গাংনাই/খিয়ারী, ঘাঘট, তিস্তা, নলেয়া, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, মরুয়াদহ, মাইলা মানাস, মাশানকুড়া, বাঙালি, লেঙগা, শাখা তিস্তা, হলহলি। কুড়িগ্রামে কালজানি, কালো, কুরসা, কোটেশ্বর, খলিশাকুড়ি/অর্জুনেরডারা, গঙ্গাধর, গদাধর, গিরাই, গোদ্ধার/বোয়ালমারী, ঘড়িয়াল ডাঙা, ঘাগুয়া, চন্ডিমারী, চাকিরপশা, চান্দাখোল, জালশিরা, জিঞ্জিরাম, তিস্তা, তোর্সা, দুধকুমার, দেউল, ধরণী, ধরলা, নওজল, নাগদহ, নীলকুমার, নাগেশ্বরী, পয়রাডাঙা, পাঁচগাছিরছরা, ফুলকুমার, ফুলসাগর, বামনী, বারোমাসি, বুড়িতিস্তা, বুড়া ধরলা, বোয়ালমারী, ব্রহ্মপুত্র, মহিশকুড়ি, রতনাই, শিয়ালদহ, সঙ্কোশ, সোনাভরি, হলহলিয়া, হাওরার বিল, হাড়িয়ার ডারা। নীলফামারীতে আউলিয়াখান, করতোয়া, কলমদার, কুমলাল, খড়খড়িয়া, খলিসাডিঙি, চারা, চারালকাঠা, চিকলি, চেকাডারা, তিস্তা, দেওনাই, ধাইজান, ধুম, নাউতারা, নেংটিছেঁড়া, বামনডাঙা, বুড়িখোড়া, বুড়িতিস্তা, বুলাই, যমুনেশ্বরী, শালকি, স্বরমঙলা। লালমনিরহাটে গিদারী, চতরা, ছড়াবিল, তিস্তা, ত্রিমোহনী, ধরলা, ভেটেশ্বর, মরাসতী, মালদাহা, রতনাই, সতী, সাকোয়া, সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, স্বর্ণামতী। রংপুরে আখিরা, আলাইকুড়ি, ইছামতি, করতোয়া, কাঠগড়ি, খাঁরুভাঁজ, খোকসাঘাঘট, ঘাঘট, ঘিরনই, টেপরীর বিল, তিস্তা, ধুম, নলশীসা, বুড়াইল, ভেলুয়া, মরা, মানাস, যমুনেশ্বরী, সোনামতি, শাখা চিকলি, শ্যামাসুন্দরী চিকলি, নলেয়া, খটখটিয়া, বাইশা ডারা, বুড়াইল, নেংটি ছেড়া, মাশানকুড়া। এসব নদীর অধিকাংশেই নাব্যতা না থাকায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উল্লেখিত নদীগুলোর মধ্যে ৩/৪টি বাদে প্রায় সবক’টি নদীই এখন মৃতপ্রায়। এসব নদীতে এখন নাব্যতা নেই। নাব্যতার অভাবে ইতোমধ্যে কোনো কোনটি নিজের অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এসব নদীতে জীবিকা নির্বাহকারী অসংখ্য জেলে পরিবার তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। এক সময় এসব নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা চলাচল করত। পারাপারেও ব্যবহার হত ডিঙ্গী নৌকাসহ বড় বড় নৌকা। জেলেরা মাছ ধরত দিন-রাত। পানির অভাবে এখন এসব নদীর অধিকাংশেই মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করছে। সর্বকালের সর্বনিম্ন পানি প্রবাহ এখন তিস্তায়। এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ এই নদী শুকিয়ে এখন মৃতপ্রায়। সামান্য বর্ষার ছোঁবলেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করা করতোয়া নদীও এখন পানির অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। কোথাও নেই আগের সেই পারাপারের ডিঙ্গি নৌকা কিংবা পালতোলা নৌকা। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার উপর দিয়ে এক সময় প্রবাহিত আলাইকুড়ি নদী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। কালের আবর্তনে মরে যাচ্ছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট নদী। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় নদীটির বুকে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। আর কয়েক বছর পর হয়তো স্মৃতির পাতা থেকেই হারিয়ে যাবে এই নদী।
নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন শত শত মৎসজীবী। অভিজ্ঞ লোকজনের ধারণা এসব নদী খনন করা হলে মৎস্য, চাষাবাদসহ আবাদি জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবে। জানা গেছে, নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার কুড়িপাড়া গ্রামে তিস্তার শাখা নদী হিসেবে ঘাঘট নদীর উৎপত্তি। ঘাঘট নদী গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে নোহালী, আলমবিদিতর ও বেতগাড়ি ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে রংপুর সদর হয়ে পীরগাছা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর আলাইকুড়ি নদীর সঙ্গে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, এক সময় এ নদীটির ওপর দিয়ে পাল তোলা নৌকা চলতো। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু সেগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। পানির অভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় দখলদারদের কবলে পড়ে এসব নদীতে এখন গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষ হচ্ছে। নদীর বুক চিরে চলছে গরু-ছাগল।
ইতিমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘মরা তিস্তা’ আর ‘ঘিরনই নদী’ খনন করে এ দুটি নদীর নতুন জীবন দিয়েছে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এ দুটি শাখা নদীর প্রায় ১৭ কিলোমিটার অংশ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এতে করে প্রায় দুইশ বছর পর জেগে উঠেছে মরা তিস্তা নদী। সেই সঙ্গে প্রাণ ফিরেছে ঘিরনই নদীরও। অথচ কিছু দিন আগেও এ নদী দুটি ছিল অস্তিত্বহীন। উদ্ধার হওয়া মরা তিস্তা নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকলী ও যমুনেশ্বরী নদীর মূলধারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিস্তার একটি শাখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার দক্ষিণাংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলা অতিক্রম করে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শেষভাগে করতোয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। রেনেল মানচিত্রে এ নদীকে তিস্তা নামেই উল্লেখ করা হয়েছে।
১৭৮৭ সালে ভূমিকম্প ও ভয়াবহ বন্যায় গতিপথ পরিবর্তন করে তিস্তা। এর ফলে উত্তরবঙ্গের নদীগুলো স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। এই শাখা নদীটি তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা নামটি বিলুপ্ত হয়ে এলাকাভিত্তিক চাড়ালকাটা, যমুনেশ্বরী ও দেওনাই নামে পরিচিতি পায়। ভারত তার উজানে বাঁধ দিয়ে এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় নাব্যতা হারিয়ে ফেলে তিস্তা নদী। বর্তমানে তিস্তা নদীর বুক চিরে গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে। নদীর বুকে বিভিন্ন সবজি ও ফসলের চাষ হচ্ছে। নদীটি না থাকায় অনেক মৎস্যজীবী পেশা হারিয়েছে। এদের অনেকেই এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ পূর্বের পেশাকেই আকড়ে ধরে মানবেতর জীবন-যাপন করে চলেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, নদীগুলো খনন করা হলে এই অঞ্চলের মানুষের অনেক সুবিধা হবে। শাখা নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে বড় পরিবর্তন আসবে এলাকার কৃষিকাজে। বদলে যাবে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি।
তাই বরেন্দ্র অঞ্চলে খরার প্রভাব দূর করতে হারিয়ে যাওয়া ছোট নদীগুলোর প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরী বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। অন্যদিকে নদী গবেষকদের দাবি, নদী তীরবর্তী কৃষি, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী উদ্ধার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।হারিয়ে যাওয়া নদী উদ্ধারে মরা তিস্তা অনুকরণীয় হতে পারে বলে মনে করেন নদী গবেষকগণ।
এ প্রসঙ্গে রিভারাইন পিপল বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেছেন, নদীগুলো এ অঞ্চলের কৃষি, জীব বৈচিত্র এবং পরিবেশের একটি অভাবনীয় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। দেশের প্রত্যেক এলাকার নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদীকে ঘিরে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
নোয়াখালীতে জামায়াতের কর্মী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ‘জুলুম-নির্যাতন করে আস্তাকুঁড়ে চলে গেছেন কাদের মির্জা’
পুলিশের সামনে হামলা বিএনপি ও যুবদল নেতা আহত
গাজীপুরে ছুটির দিনেও ২৫ শতাংশ কারখানা খোলা ছিল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন প্রধান উপদেষ্টা
তিন জেলাসহ সাত বিভাগের ওপর দিয়ে বইছে তাপপ্রবাহ
তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি নিয়ে আইএসপিআর এর বিবৃতি
দুই দিনেই পরাজয়ের ধ্বনি শুনছে বাংলাদেশ
ছাত্রআন্দোলনে শহীদ ছাত্রদলনেতা ওয়াসিমের কবর জিয়ারতে কেন্দ্রীয় নেতারা
অনেক সচিবসহ কর্মকর্তারা নাশকতা করার চেষ্টা করছে:রিজভী
রাজধানীতে ঢাকা দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ মিছিল
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ফিরে আসছে: উপদেষ্টা নাহিদ
কমলা হ্যারিস জিতলে বিনিয়োগ তুলে নেয়ার হুমকি প্রস্তুতি নিচ্ছেন ওয়ারেন বাফেটও: ইলন মাস্ক
বান্দরবানের রুমায় অস্ত্র গোলাবারুদ জ্যামার উদ্ধার
প্রথমবারের মতো ছুটির দিনেও চলছে মেট্রো
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ ও বিচারের দাবীতে খুলনায় মানববন্ধন
শেখ হাসিনার দলবলকে আগলে রেখেছে বর্তমান প্রশাসন: সেলিমা রহমান
রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ
মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ জনে
অনতিবিলম্বে ভিসি নিয়োগ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী ইবি শিক্ষার্থীদের
৩শ' আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত: অধ্যাপক মুজিবুর রহমান