ময়মনসিংহে নগরীর পঁচাপুকুর পাড় এলাকার রেলক্রসিংয়ে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে যাত্রীবাহী অটোরিকশা ট্রেনের ধাক্কায় মো. আবদুর রহমান ও শেফালি আক্তার নামে চাচা ও ভাতিজি নিহত হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে এ ঘটনার গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তদন্ত কমিটির প্রধান ও ঢাকা-২ কমলাপুরের সহকারি পরিবহন কর্মকর্তা মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সরেজমিনে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের সুপার মো. নাজমুল হক জানান, ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি ঘটনস্থাল পরিদর্শন করেছেন। এবিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ঘটনার বিস্তারিত জানা যাবে। ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারি নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকরাম আলী বলেন, আজ এনিয়ে আরো একটি বৈঠক হবে। এর পরই দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

সূত্র জানায়, ভাগ্নের বিয়ের কেনাকাটা করতে ভাজিতি শেফালি আক্তারকে নিয়ে শহরে এসেছিলেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বাড়েরা এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান। বাজার নিয়ে গেলে রাতেই বিয়ের কথা ছিল ভাগ্নে খোকার। কিন্তু বিয়ের বাজার নিয়ে তাদের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। নগরীর পঁচাপুকুর পাড় এলাকার রেলক্রসিংয়ে অটোরিকশা যোগে আসতেই ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে তাদের মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর পঁচাপুকুর পাড় এলাকার রেলক্রসিংয়ে এলাকায় অটোরিকশাটি রেললাইনে উঠে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এদিকে ঘটনাস্থলটি রেলওয়ে জামালপুর থানা এলাকা হওয়ায় দুইজন নিহতের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহের জিআরপি ওসি মো. জাহাঙ্গীর আলম।

দুইজনের মৃত্যুর পর ময়মনসিংহে মেরামত হল রেলক্রসিংয়ের গেট ব্যারিয়ার : মঙ্গলবার রাতে ময়মনসিংহ নগরীর পঁচাপুকুর পাড় এলাকার রেলক্রসিংয়ে দেওয়ানগঞ্জগামী ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় দুই অটোরিকশার যাত্রী নিহত হয়। এ ঘটনার একদিন পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হুশ ফিরে আসায় গতকাল বুধবার সকালে মেরামত করা হয় ওই ক্রসিংয়ের গেট ব্যারিয়ার। দুপুরে নগরীর পঁচাপুকুর পাড় এলাকার রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যান মো. আলম বাদশা বলেন, গতরাতে দুর্ঘটনার সময় গেট ব্যারিয়ারের একপাশের ব্যারিয়ার নষ্ট ছিল। তবে দুপুরে নষ্ট ব্যারিয়ার মেরামত করা হয়েছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা থেকে দেওয়ানগঞ্জগামী ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ জংশন অতিক্রম করে জামালপুরের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় জংশনের কাছাকাছি এলাকায় মিন্টু কলেজ ও নতুন বাজার রেলক্রসিংয়ের মাঝে পঁচাপুকুরপাড় এলাকায় অপর একটি ক্রসিংয়ে ট্রেনটি যাত্রীবাহী একটি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। এতে যাত্রীরা রেললাইনে ছিটকে পড়লে তারা ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। তারা আরো জানায়, ট্রেন আসার সময় ক্রসিংয়ে ব্যারিয়ার না ফেলার কারণে অটোরিকশাটি রেললাইনের উপরে উঠে যায়। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে দুর্ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে ফেলা হয় ব্যারিয়ার।

নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, যথা সময়ে ক্রসিং ব্যারিয়ার ফেলা হলে আটোরিকশাটি রেললাইনের উপরে উঠতে পারত না, এই দুর্ঘটনা ঘটতো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার সময় এই ক্রসিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন গেটম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তার উপস্থিতিতেই ঘটেছে দুর্ঘটনা। তবে ঘটনার বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও গেটম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্য জানা যায়নি।

ময়মনসিংহ রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা কবলিত ক্রসিংয়ে গেটম্যান ছিল। তবে ঘটনার সময় একপাশে ব্যারিয়ার পড়লেও আরেক পাশের ব্যারিয়ার পড়েনি। ওই সময় ব্যারিয়ার না পড়া পাশ দিয়ে যাত্রীবাহী অটোরিকশাটি ঢুকে যায়। এ কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে জানতে পেরেছি। তবে এ ঘটনায় প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। বিস্তারিত প্রতিবেদনে জানা যাবে।
সূত্রমতে, গত কয়েক বছর ধরে ময়মনসিংহের ২০৫টি রেলক্রসিং মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। অরক্ষিত এসব ক্রসিংয়ের অনেক স্থানে নেই গেটম্যান ও গেট ব্যেরিয়ার। আবার অনেকস্থানে গেটম্যান থাকলেও গেট ব্যেরিয়ার অকেজো বা ভেঙে পড়া অবস্থা। সেই সঙ্গে দায়িত্বে থাকা বেশির ভাগ গেটম্যানের বিরুদ্ধে রয়েছে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ। এমনকি এই কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত একজনের স্থলে কাজ করছেন অন্য লোক। ফলে অহরহ হচ্ছে দুর্ঘটনা।

রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ-ঢাকা, ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহ-জামালপুর রুটের বিদ্যাগঞ্জ ও ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথের মোট ২০২ কিলোমিটার ময়মনসিংহ রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের অন্তভূক্ত। এসব রুটে রেলের মোট লেভেল ক্রসিং সংখ্যা ২০৫টি। এর মধ্যে অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং মাত্র ৬৫টি। এতে গেটম্যান ও গেট ব্যেরিয়ার আছে মাত্র ৪৮টিতে। এর বাইরে অননুমোদিত ক্রসিং ১৪০টি। ফলে অনুমোদিত এবং অননুমোদিত ১৫৭ টিতে ক্রসিংয়ে নেই গেটম্যান ও ব্যেরিয়ার। তারা জানান, অননুমোদিত লেবেল ক্রসিংগুলো এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি করেছে।

সূত্র জানায়, কোন রেল লাইন স্থাপনের ১০ বছরের মধ্যে কোথাও কোন লেবেল ক্রসিং নির্মাণের দরকার হলে তা রেলের নিজস্ব অর্থায়নে করে দেয়া হয়। এ সময়সীমা পেরিয়ে যাবার পর সরকারের অন্য কোনো বিভাগের সড়ক নির্মাণের কারণে লেবেল ক্রসিংয়ের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিজ খরচে তা নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু রেল লাইনের ওপর দিয়ে সরকারের অন্য বিভিন্ন বিভাগ থেকে রাস্তা করা হলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি তাদের তরফ থেকে করে দেওয়া হয়নি কোনো ওয়ার্নিং বোর্ডও।

ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারি নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকরাম আলী বলেন, এখন ময়মনসিংহে মোট রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তবে আনুমানিক এর সংখ্যা দুই শতাধিক। এর মধ্যে বড় ক্রসিংগুলোতে ৬ জন এবং ছোটগুলোতে ৩ জন করে গেটম্যান থাকার নিয়ম। তবে নানান কারণে অনেকস্থানে গেটম্যান কম রয়েছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।