রহিম স্টিল মিলে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ক্ষতিপূরণ ও বিচারের অপেক্ষায় স্বজনরা

তিন সংস্থার তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি আট বছরেও

Daily Inqilab সাঈদ আহমেদ

২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৫২ এএম

এক দশকে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয় রহিম স্টিল মিলসে। ২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে একটি অনুসন্ধান প্রকাশিত হয়। একটি জাতীয় দৈনিক ‘রহিম স্টিল মিলে মৃত্যুকূপ/১০ বছরে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু: অসুস্থ দুই শতাধিক’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ভুক্তভোগীদের কাছে ছুটে যায়। পরিবেশবাদীরাও সোচ্চার হন। শ্রমিক সংগঠনগুলো বিবৃতি দেয়। রাজধানীতে মিছিল ও মানববন্ধন করে। ‘কলকারখানা এবং প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর’ তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে তদন্ত চালায়। ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অতিরিক্ত জেলা জজ শরীফউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের উচ্চতর কমিটি গঠন করে তদন্ত করায়।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। পরিবেশ অধিদফতর রহিম স্টিল মিলের প্রাণঘাতী কোয়ার্টয উৎপাদনকারী ‘মৃত্যুকূপ’ বন্ধ করে দেয়। এ নিয়ে বেশ তোড়জোড় চললেও কিছু দিন যেতেই মিলিয়ে যায় সব তৎপরতা। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৮ বছর অতিক্রম হতে চললেও আলোর মুখ দেখেনি প্রতিবেদনগুলো।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘রহিম স্টিল মিলস লি:’র ক্রাশিং সেকশনে কাজ করে ১০ বছরে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ কিংবা মৃত্যুপথযাত্রী আরো দুই শতাধিক। প্রতিষ্ঠানটিতে শ্রমিক হিসেবে যিনি ২ মাস কাজ করেন, তার মৃত্যু অবধারিত। রুলিং মিল এবং পার্টিকেল বোর্ড তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ‘কোয়ার্টয পাউডার’। চুনা পাথর, বরিক পাউডার, পটাশিয়ামসহ কয়েক ধরনের কেমিক্যালের সংমিশ্রণে উৎপাদন করা হতো কোয়ার্টয পাউডার। এ পাউডার এক সময় ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হতো। পরবর্তীতে রহিম স্টিল মিলস কর্তৃপক্ষ নিজেরাই পাথর মেশিনে গুঁড়ো করে কোয়ার্টয পাউডার উৎপাদন শুরু করে। প্রয়োজনীয়টুকুন নিজেরা ব্যবহার করে বেশিরভাগ বিক্রি করা হয় অন্যান্য রি- রোলিং মিলস, সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও পার্টিকেল বোর্ড ফ্যাক্টরিতে।

যদিও রোলিং মিলে পাথর গুঁড়ো করার কোনো অনুমোদন ছিলো না। প্রতিবেদককে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োক্যামেস্ট্রির তৎকালীন প্রফেসর ডা: ইকবাল আর্সালান জানিয়েছিলেন, কোয়ার্টয’র ডাস্ট মানব দেহে প্রবেশ করলে ফুঁসফুঁসে রক্ত জমে যায়। চোখ শুকিয়ে যায়। ডার্মাটাইটিজ,আর্থাটাইটিজ হয়। লক্ষণ স্বরূপ আক্রান্ত শ্রমিকের শ্বাসকষ্ট, রক্তবমি, চর্মরোগ, চুলকানি, জ্বর ও শীর্ণকায় হয়ে যান। চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে মৃত্যু। কোনো ওষুধেই কাজ না হওয়ায় স্থানীয়দের কাছে এটি হয়ে গেছে এক ‘অচেনা রোগ’। অচেনা রোগে নারায়ণগঞ্জ, সোনার গাঁও উপজেলার বাঘরি দক্ষিণপাড়া গ্রামে এক পরিবারেই মৃত্যু হয় ৪ শ্রমিকের। উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়ন,সনমানদী, কাঁচপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে মারা যান ১২ জন। বাঘরি পশ্চিমপাড়া গ্রামের মারা যান তোতা মিয়া, আবুল কাসেম, গুলবাহার, নূরুল ইসলাম, জাহের আলী। বাঘরি উত্তর পাড়া, দক্ষিণপাড়া এবং পূর্ব পাড়ায় মারা গেছেন আরো অন্তত ১১ জন। নাজিরপুর বাংলাবাজার গ্রামে মারা গেছেন কয়েকজন। এসব নিরব মৃত্যু নিয়ে তখন রহিম স্টিল মিলসের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো জবাব মেলেনি।

জানাযায়, প্রতিবেদন প্রকাশ ও তদন্ত কমিটিগুলোর তৎপরতার পর কয়েক মাস বন্ধ ছিলো রহিম স্টিল মিলের ক্রাশিং সেকশন। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে ‘ম্যানেজ’ করে পরে সেটি পুনরায় চালু করে। প্রকাশিত প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে প্রতিবেদকের কথা হয় রহিম স্টিল মিলসের শ্রমিক বাঘরি গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে মোস্তফা, আব্দুল জলিলের ছেলে শহীদ মিয়া, শাহজাহান মিয়ার ছেলে মোক্তার হোসেন, সাদীপুর ইউনিয়নের হাকিম আলীর ছেলে দিলু, চেঙ্গাকান্দি গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে আব্দুল মোতালেব, বনজী পাড়া গ্রামের হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। প্রতিবেদন প্রকাশের পরবর্তী বছরগুলোতে তারাও একই উপসর্গে মারা যান।

ঢাকা-চট্টগ্রাম যেতে কাঁচপুর ব্রিজ পাড় হলেই হাইওয়ের পূর্বপাশে নয়াবাড়ির বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত রহিম স্টিল মিলস লি:। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজমেন্ট এতোদিনে প্রথম প্রজন্ম, দ্বিতীয় প্রজন্ম হয়ে এখন তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি আরো বড় হয়েছে। উৎপাদন ও ব্যবসার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করে গত দুই দশকে যে শত শত শ্রমিক নিরবে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের কোনো দায়-দায়িত্বই স্বীকার করছে না শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে পরিবার পরিজনগুলো কতটা মানবেতর জীবন যাপন করছে- সেই খবরও রাখে না প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। যে শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন তিনি আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরা এখন কেমন আছেন ? তারা কখনো কি পাবেন স্বজন হারানোর ক্ষতিপূরণ?

রহিম স্টিল মিলসের শ্রমিক ছিলেন বাঘরি পশ্চিমপাড়া গ্রামের মো: নূরুজ্জামান। ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। স্ত্রী হালিমা গতকাল শনিবার জানান, তার স্বামী মারা যান ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নূরুজ্জামানের স্ত্রী হালিমা খাতুনের সঙ্গে। কান্না বিজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, লোকটা (নূরুজ্জামান) আমাদের অথৈ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলে চলে গেলো! বাচ্চা দুটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমি কি করে বাঁচি? ফুসফুসে যখন রোগ ধরা পড়ে তখন ধারকর্জ করে চিকিৎসা করেছি। পরে বিক্রি করেছি জায়গা-জমি। কোম্পানি (রহিম স্টিল মিল) কোনো খবরও নেয়নি। এইরকম ঘটনার একটা বিচার হইলো না ! কোম্পানিতো মারা যাওয়া শ্রমিকদের নিজেদের শ্রমিক বলেই স্বীকার করে না। হালিমা বলেন, আমরা অসহায়। কার কাছে বিচার চাইবো ? কে করবে বিচার ? আমার মতন বহু বিধবা আশায় বুক বেঁধে আছেন এই নিরব হত্যাকান্ডের একদিন বিচার হবে! তদন্তের ৮ বছরেও প্রতিবেদন কেন প্রকাশ করা হয়নি-জানতে চাওয়া হয় ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’র পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) জেলা ও দায়রা জজ মো: আশরাফুল আলমের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে পরে খোঁজ-খবর নিয়ে হয়তো জানাতে পারবো। এর পর কয়েক দফা ফোনে যোগাযোগ করা হয়। সর্বশেষ গতকাল বুধবার তিনি এসএমএস করে জানান, বর্তমানে তিনি ঢাকার বাইরে আছেন। কোনো আপডেট থাকলে পরে জানাবেন।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বালিশে বুক ঢেকে হোটেল থেকে বের হলেন ব্রিটনি, কী ঘটেছে মাঝরাতে?

বালিশে বুক ঢেকে হোটেল থেকে বের হলেন ব্রিটনি, কী ঘটেছে মাঝরাতে?

কানাডায় নিজ্জর হত্যার ঘটনায় তিন ভারতীয় আটক

কানাডায় নিজ্জর হত্যার ঘটনায় তিন ভারতীয় আটক

শাক্‌সগাম আমাদের, চীনা নির্মাণের উপগ্রহচিত্র প্রকাশ্যে আসার পর দাবি ভারতের

শাক্‌সগাম আমাদের, চীনা নির্মাণের উপগ্রহচিত্র প্রকাশ্যে আসার পর দাবি ভারতের

ধর্মান্তরিত হওয়ার একদিন পরই নিজ ধর্মে ফিরলেন অভিনেত্রী

ধর্মান্তরিত হওয়ার একদিন পরই নিজ ধর্মে ফিরলেন অভিনেত্রী

সরকার পতনের লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলো একাত্ম: ড. মঈন খান

সরকার পতনের লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলো একাত্ম: ড. মঈন খান

জনপ্রিয়তায় ব্র্যাড পিটকে হার মানালেন শাহরুখ!

জনপ্রিয়তায় ব্র্যাড পিটকে হার মানালেন শাহরুখ!

জনপ্রিয় কমেডিয়ান ভারতী সিং হাসপাতালে ভর্তি

জনপ্রিয় কমেডিয়ান ভারতী সিং হাসপাতালে ভর্তি

মাওলানা মামুনুল হকের মুক্তিতে উচ্ছ্বসিত নেটিজেনরা

মাওলানা মামুনুল হকের মুক্তিতে উচ্ছ্বসিত নেটিজেনরা

ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলো দুটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়

ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলো দুটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়

সালথা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ওয়াহিদুজ্জামান

সালথা উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ওয়াহিদুজ্জামান

ইউরোয় গ্রুপ পর্ব পার হওয়া ফ্রান্সের জন্য কঠিন হবে: দেশ্যম

ইউরোয় গ্রুপ পর্ব পার হওয়া ফ্রান্সের জন্য কঠিন হবে: দেশ্যম

জায়েদ খানের ফোন পানিতে ছুড়ে ফেললেন সাকিব, যা বলছেন নেটিজেনরা

জায়েদ খানের ফোন পানিতে ছুড়ে ফেললেন সাকিব, যা বলছেন নেটিজেনরা

বনানীতে পোশাক শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজট

বনানীতে পোশাক শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজট

গণমাধ্যমকে নানা কারণে আত্মসমর্পন করতে হয় : বাংলাদেশ ন্যাপ

গণমাধ্যমকে নানা কারণে আত্মসমর্পন করতে হয় : বাংলাদেশ ন্যাপ

পান্ডিয়া হবে বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়: আগারকার

পান্ডিয়া হবে বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়: আগারকার

গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা, ২৪ ঘণ্টাও শেষ হয়নি উদ্ধার অভিযান

গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা, ২৪ ঘণ্টাও শেষ হয়নি উদ্ধার অভিযান

দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ থমাস

দুর্নীতির দায়ে নিষিদ্ধ থমাস

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে আশাবাদী বাংলাদেশ ও গাম্বিয়া

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে আশাবাদী বাংলাদেশ ও গাম্বিয়া

ছেলের কবরে বেড়া দিতে গিয়ে মারা গেলেন বাবাও

ছেলের কবরে বেড়া দিতে গিয়ে মারা গেলেন বাবাও

১৪ মে চট্টগ্রাম থেকে হজযাত্রা শুরু

১৪ মে চট্টগ্রাম থেকে হজযাত্রা শুরু