উপজেলা নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের ৭৩ জন নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। বহিষ্কৃতরা মনে করেন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়া জরুরি। তবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন ভিন্ন কথা।

বহিস্কৃত ৭৩ জনের বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদও থাকবে না। গত বৃহস্পতিবার যাদের কাছে বহিষ্কারের চিঠি পাঠানো হয় তাদের মধ্যে ২৮ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, ২৪ জন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং ২১ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘তারা নিজেদের স্বার্থে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে প্রার্থী হয়েছেনভ তারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন।’ ওই ৭৩ জনের মধ্যে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের নেতাও রয়েছেন। তাদের বহিস্কারের আগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। সেই নোটিশের জবাব দেননি অনেকে। আবার কেউ কেউ নোটিশ পেয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারও করেছেন। নোটিশ দেয়ার পর তৃণমূলের এই নেতাদের সঙ্গে রুহুল কবির রিজভী এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা কথাও বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৭৩ জন প্রার্থী হিসেবে থেকে গেছেন।

রহুল কবির রিজভীর সই করা বহিষ্কারের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে আপনাকে নির্দেশক্রমে বহিষ্কার করা হলো।’ এর আগে শোকজের টিঠিতে তারা দলের সঙ্গে ‘বেঈমানি’ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় বলে নোটিশপ্রাপ্তরা ডয়চে ভেলেকে জানান।

৮ মে প্রথম ধাপে ১৫০ টি উপজেলায় নির্বাচন হবে। এবার নির্বাচনে কোনো দলীয় প্রতীক থাকছে না।
যা বলছেন বহিষ্কৃতরা : কিশোরগগঞ্জ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নজমুল আলম দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছেন। শোকজের পর মৌখিকভাবেও বারণ করা হয়েছে তাকে, তারপরও তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের কারণ দর্শানো নোটিশে বলা হয়েছে, ‘দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিএনপি জালিয়াতির নির্বাচনে অংশ নেবে না। আপনি সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দলের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন।’ এর জবাবে নাজমুল আলম বলেন, ‘আমি দলের সঙ্গে কোনো বেঈমানি করিনি। আমি তো সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করি। তাই তাদের জন্য নির্বাচন করছি। তারা যদি আমাকে গ্রহণ করে, তাহলেও তাদের সঙ্গে থাকবো। না করলেও তাদের সঙ্গে থাকবো।’ ‘আমি তো জাতীয় পর্যায়ের নেতা না, তৃণমূলের নেতা। তাই আমাকে তৃণমূলে থাকতে হবে। আমি যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকি, তাহলেই আমি নেতা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকলে তো আর দলের সঙ্গে বেঈমানি করা হয় না’ বলেন তিনি।

ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি শামসুর রশীদ মজনু ওই উপজেলার চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সদস্যও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানকার বিএনপি নেতাদের অবহেলার শিকার। আমি বটতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম মোট ১৪ বছর। কিন্তু আর আগে উপজেলা বা সংসদ নির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। বিএনপির বড় কোনো পদও আমাকে দেয়া হয়নি। কিন্তু এলাকার সাধারণ মানুষ আমাকে ভালোবাসে। তারা আমাকে চায়। তাই আমি প্রার্থী হয়েছি।’ তার কথা, ‘আমরা নির্বাচন না করলে দলের ক্ষতি হবে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা আছে। আরো হবে। আমরা যদি জনপ্রতিনিধি হই তাহলে সেইসব মামলা ফেস করা সহজ হবে। আর নির্বাচন না করলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা সব আওয়ামী লীগে চলে যাবে। গত সংসদ নির্বাচনে অনেকেই আওয়ামী লীগে চলে গেছে। তৃণমূলে দলকে ধরে রাখতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা উচিত।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতি ওমরাও খান উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তিনি এর আগে ২৪ বছর কুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার কথা, ‘আমি নির্বাচন করায় বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত নয়, উল্টো লাভবান হবে। কারণ, আমি তো কাজ করছি মানুষের জন্য। তাদের নিয়েই আমার রাজনীতি। এখন নির্বাচনে আমার এলাকার মানুষ আমাকে চায়। তাদের তো আমরা মূল্যায়ন করতে হবে। এর ফলে আমার এলাকায় বিএনপি আরো শক্তিশালী হবে। আর নির্বাচন তো দলীয়ভাবে হচ্ছে না। আমি না দাঁড়ালে ভোটাররা মন্দের ভালোকে ভোট দিতেন। এখন সর্বোত্তম প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন।’

রুহুল কবির রিজভীর বিশ্লেষণ : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘তারা যে যুক্তিই দেখাক না কেন আসলে তারা নিজেদের স্বার্থে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হয়েছেন। তারা দেশ, মানুষ বা দলের কথা চিন্তা করেননি। তারা শেখ হাসিনার মতো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে, নির্বাচনে না থাকলে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। ডিক্টেটররা এই ধরনের কথা বলে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। তারপর তারা তাদের ছক অনুযায়ী কাজ করে। যেহেতু নির্বাচন কমিশন তাদের আজ্ঞাবাহী।’ তার কথা, ‘এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪-এ আমরা সেটা দেখেছি। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমরা বর্জন করেছি। সাধারণ মানুষও বর্জন করেছে। তারা ভোট দিতে যাননি। দেশের মানুষ এই সরকারের অধীনে ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারপরও কিছু অতি উৎসাহী দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নির্বাচনে যায়। তাদের আমরা বহিস্কার করেছি।’