বিলাসবহুল টেপাখোলা রিসোর্ট নির্মাণে কাটা হচ্ছে ৩১টি প্রাচীন গাছ

Daily Inqilab আনোয়ার জাহিদ, ফরিদপুর থেকে

০৭ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৭ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম

ফরিদপুরের সোহরাওয়ার্দী সরোবর তথা টেপাখোলা লেকপাড়ে ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ফরিদপুর টেপাখোলা রিসোর্ট’ নামে ব্যয়বহুল এক বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলা পরিষদের জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর তথা এলজিইডি। আর এ কাজে কেটে ফেলা হবে সেখানকার দীর্ঘদিনের পুরনো ৩১টি (ছায়া বৃক্ষ) গাছ।

ইতোমধ্যে গাছগুলো কেটে ফেলার টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে সেগুলোর গায়ে খোদাই করে চিহ্ন দিয়ে দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসীর মুখে চাউর আছে ৭০ বছর আগের ৩১টি ছায়া বৃক্ষের মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। এতে ক্ষোভ ফেটে পড়ছে গোটা শহরের গাছ পাগল ও বৃক্ষ প্রেমী মানুষগুলো।
আর এ নিয়ে শহরবাসীর মাঝে উঠেছে নানা গুঞ্জন। বিশাল বাজেটের আয়েশী এ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত সরকারের গলায় শ্বেতহস্তীর মতো আটকে পূর্ণাঙ্গ রুপ না পেলে লেকপাড়ের বর্তমানের নিসর্গ পরিবেশটুকুও হারাতে হবে বলে মনে করছেন অনেকে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একনেক বৈঠকে ২১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ফরিদপুর টেপাখোলা রিসোর্ট’ নামে একনেক বৈঠকে এই প্রকল্পটি পাশ করা হয়। তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের একান্ত প্রচেষ্টায় মূলত এ প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে যায়। নকশা অনুযায়ী এই টেপাখোলা রিসোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, টেপাখোলা রিসোর্ট স্কুল ব্লক, জিমনেসিয়াম, মসজিদ, রিসোর্ট সেন্টার, ভিকটোরি মিউজিয়াম, ভিকটোরি কমপ্লেক্স, ওয়ান্ডার হুইল, ফুড কোড, সিনিয়র সিটিজেন কর্নার, আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট সেন্টার, চিল্ড্রেন ওয়াটার গেইম, চিল্ড্রেন সুইমিংপুল, টেপা ক্যাফে ও হল, অ্যাম্পিথিয়েটার, বোর্ট ল্যান্ডিং ক্যাফে ও বঙ্গবন্ধু ইনডেক্স ফিঙ্গার টাওয়ার তৈরির কথা। তবে পরে বঙ্গবন্ধু ইনডেক্স ফিঙ্গার টাওয়ারটি বাদ দিয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ ১৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে আজাদ আগামী একমাসের মধ্যে এই রিসোর্টের কাজ উদ্বোধন করবেন বলে এলজিইডি ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহিদুজ্জামান খান জানিয়েছেন।

ফরিদপুর জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, টেপাখোলা লেকটি ১৪ একর জমির উপর অবস্থিত। এ লেকসহ আশেপাশে সবমিলিয়ে ১৮ একর জমির উপর লেকের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের প্রকল্প নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০২৬ সালেন ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন প্রকল্প পরিচালক। আর একাজে প্রথম পর্যায়ে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
এদিকে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সেখানকার দীর্ঘদিনের পুরনো ৩১টি গাছ বিক্রির জন্য গত ২৮ মার্চ ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় নিলাম করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টেপাখোলা লেকের পূর্ব পাড়ে এবং দক্ষিণ পাড়ের সড়কের পাশে অবস্থিত গাছগুলোর বেশিরভাগই মেহগনি গাছ। এর পাশাপাশি, আম, কাঁঠাল, নারকেল গাছও রয়েছে। গাছগুলোর বয়স আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ বছর। এরইমধ্যে সেগুলোর শক্ত বাকল কেটে লাল রঙ দিয়ে সংখ্যা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। যেকোনো সময় সেগুলো কেটে ফেলার কাজ শুরু হবে। এছাড়া গত মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে লেকের পানি তুলে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।

তবে এ গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্তে স্থানীয় বাসিন্দাসহ শহরবাসীর মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নগরায়নের যুগে শহরবাসীর প্রাতভ্রমন, বৈকালিক হাঁটা এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার একটি বড় স্থান এই লেকপাড়। বর্তমানে প্রচন্ড দাবদাহে প্রতিদিন বিকেলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সেখানে ছুটে যান। পাশাপাশি সারাবছরই শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে সর্বস্তরের লোকজন ছুটে আসে এই লেকপাড়ে অলস ও অবসর সময় কাটাতে।

টেপাখোলা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাংবাদিক তিতু মিয়া (৪৮) বলেন, শৈশব থেকেই এই গাছগুলি দেখে আসছি। এখানকার লেকের স্বচ্ছতার সাথে গাছগুলোর ছায়াময় পরিবেশ এক দারুণ নিসর্গের অনুভূতি তৈরি করেছে। একারণে প্রাকৃতিকভাবেই এটি একটি সুন্দর বিনোদন স্পট হিসেবে দাড়িয়ে গেছে। এখন এই গাছগুলো কেটে ফেললে এই পরিবেশটাই বদলে যাবে।

সিনিয়র পত্রিকা এজেন্ট মো. আব্দুর রাজ্জাক (৭৮) নামে এক বৃদ্ধ বলেন, এই গাছগুলোর ছায়ায় আমাদের শৈশব কেটেছে। প্রচন্ড গরমে একটু স্বস্তির আশায় শুধু আমরাই নই, শহরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ একটু স্বস্তির আশায় ছুটে আসেন। এখন শুনছি এখানে বড় প্রকল্প হবে, বড় বড় ভবন হবে। এজন্য গাছগুলি কেটে ফেলা হবে। এ খবর শোনার পরে মনে স্বস্তি পাচ্ছিনা।

টেপাখোলা লেকপাড়ের বাসিন্দা এস এম মনিরুজ্জামান মনির নামে স্থানীয় একজন সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী বলেন, তীব্র গরমে শহরের মানুষ সকালে, দুপুরে এবং সন্ধ্যার পরে এই গাছের তলায় একটু বিশ্রাম নিয়ে থাকে। আমার জানামতে লেকের উন্নয়নে যে নকশা ও ব্যয় বরাদ্দ হওয়ার কথা ছিলো তা সংকুচিত করা হয়েছে। আর যেহেতু মূল নকশা অনুযায়ী আর কাজটি হচ্ছেনা তাই গাছগুলো রেখেই নতুন করে নকশা করা উচিত। আমরা চাই পরিবেশ রক্ষায় গাছগুলো রক্ষা করা হোক।

সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাগর আহমেদ বলেন, গাছগুলো আমাদের ফরিদপুর শহরের স্মৃতিবিজড়িত। স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আগে এগুলো লাগানো হয়েছে। এমন একটি গাছ কেটে ফেললে সেটি পুনরায় এ অবস্থায় আনতে আবার আমাদের অর্ধশতাব্দীকাল অপেক্ষা করতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী যেখানে এসব ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়নে নিরুৎসাহিত করছেন, সেখানে এই গাছগুলো কেটে ফেলার পরে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়েও আমরা শংকিত। তখন এর দায়ভার নেবে কে? যাই করা হোক না কেন এ গাছগুলি রক্ষা করে করতে হবে।

ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গাছগুলি রাস্তার পাশে এবং লেকের পাড়ে অবস্থিত। আমি নিজে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা উন্নয়নের বিরোধী নই। তবে আমার মনে হয়েছে গাছগুলি রক্ষা করে এ প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব। গাছগুলি কেটে ফেলার উদ্যোগের কোন যুক্তিসংগত কারণ দেখছি না।

ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মাহফুজুল আলম মিলন বলেন, কোন যুক্তিতেই ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সী এ গাছগুলো কেটে ফেলা আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। গাছগুলো রক্ষা অবশ্যই করতে হবে। বড় বড় এ গাছগুলো কেটে ফেললে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এ উদ্যোগ আমরা নাগরিক সমাজ মেনে নিতে পারি না।

ফরিদপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বাকাহীদ হোসেন বলেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন ও বড় বড় ওই গাছগুলো রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এগুলো রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আমাদের জানানো হয়।

তিনি বলেন, ওই ৩১টি গাছ কাটা হলেও পাশাপাশি এক হাজার ৭৬২টি গাছ রোপন করা হবে। এটি সরকারি উদ্যোগে একটি দৃষ্টি নন্দন কাজ হবে। এ কাজের স্বার্থে আপাতত এ ক্ষতি আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অসুস্থ সউদী বাদশাহ, নেয়া হয়েছে হাসপাতালে

অসুস্থ সউদী বাদশাহ, নেয়া হয়েছে হাসপাতালে

জুজুৎসু সম্পাদক নিউটনসহ ২ জন রিমান্ডে

জুজুৎসু সম্পাদক নিউটনসহ ২ জন রিমান্ডে

কিরগিজস্তানে কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর মেলেনি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

কিরগিজস্তানে কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর মেলেনি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ইশরাক হোসেনের জামিন আবেদন বাতিল, কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ

ইশরাক হোসেনের জামিন আবেদন বাতিল, কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ

টেকনাফে র‌্যাবের অভিযানে কোটি টাকার আইসসহ আটক-১

টেকনাফে র‌্যাবের অভিযানে কোটি টাকার আইসসহ আটক-১

অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে চালকরা

অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে চালকরা

রামপালে ভুল চিকিৎসায় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে প্রসূতি

রামপালে ভুল চিকিৎসায় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে প্রসূতি

হামাসের হাতে বন্দিদের মুক্তির জন্য বিশেষ বৈঠকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ

হামাসের হাতে বন্দিদের মুক্তির জন্য বিশেষ বৈঠকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ

নিজ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে ইউরোপ: রাশিয়া

নিজ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে ইউরোপ: রাশিয়া

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে সশস্ত্র বিক্ষোভের আশঙ্কা

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে সশস্ত্র বিক্ষোভের আশঙ্কা

মাগুরার শ্রীপুরে নবী করিম সা. সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে জনগনের বিক্ষোভ অভিযোগকারী আটক

মাগুরার শ্রীপুরে নবী করিম সা. সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদে জনগনের বিক্ষোভ অভিযোগকারী আটক

মেট্রোরেলে ভ্যাট এনবিআরের ভুল সিদ্ধান্ত: ওবায়দুল কাদের

মেট্রোরেলে ভ্যাট এনবিআরের ভুল সিদ্ধান্ত: ওবায়দুল কাদের

পুঠিয়া উপজেলা নির্বাচনে ৭৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ

পুঠিয়া উপজেলা নির্বাচনে ৭৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ

আবারো পেছালো রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন

আবারো পেছালো রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন

নেত্রকোণায় নো হেলমেট, নো ফুয়েল কার্যক্রম শুরু

নেত্রকোণায় নো হেলমেট, নো ফুয়েল কার্যক্রম শুরু

সিঙ্গাপুরে মাথাচাড়া করোনার! আক্রান্ত প্রায় ২৬ হাজার

সিঙ্গাপুরে মাথাচাড়া করোনার! আক্রান্ত প্রায় ২৬ হাজার

তিন জিম্মির পর গাজায় আরো এক জিম্মির লাশ উদ্ধার

তিন জিম্মির পর গাজায় আরো এক জিম্মির লাশ উদ্ধার

ফের মাউন্ট ইবু থেকে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত, খালি করা হল সাতটি গ্রাম

ফের মাউন্ট ইবু থেকে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত, খালি করা হল সাতটি গ্রাম

কেন চীনকে ‘সোনার তরী’ ভাবছে রাশিয়া?

কেন চীনকে ‘সোনার তরী’ ভাবছে রাশিয়া?

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা তিন গুণ : টিআইবি

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা তিন গুণ : টিআইবি