ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১

কয়রায় ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে উপকূলবাসী

Daily Inqilab মোস্তফা শফিক, কয়রা (খুলনা) থেকে

২৫ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম

নদী ও সুন্দরবন বেষ্টিত বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে খুলনার কয়রায় একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে দীর্ঘদিন ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে রয়েছে ৩ লক্ষাধিক উপকূলবাসি। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় আসলে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে কাটে তাদের জীবন। নতুন করে আবার শক্তি সঞ্চার করে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। বিভিন্ন ঝড়ে উপকূলবাসি নিজেদের রক্ষা করতে পারলেও প্রতিবার তাদের বসত ঘর, ফসলি জমি, গবাদি পশু, মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। খুলনার উপকূলীয় লাখো মানুষ রয়েছে শঙ্কায় কখন আঘাত হানবে ঝড়।
সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল, রোয়ানু, নার্গিস, কোমেন, ফণী, আম্ফান, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের নতুন আতঙ্ক অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। অতি প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে উপকূলের বাসিন্দারা মনে করছেন, এখন ভরা পূর্ণিমা প্রায় ৩০ বছর পর ভরা পূর্ণিমার জোয়ারের সময়ে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে।
ইতোমধ্যে কয়রার শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১০ কিলোমিটার বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন উপকূলের তিন লক্ষাধিক বাসিন্দা। উপকূলীয় এলাকা এবং নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে সর্তক থাকা ও পূর্ব পস্তুতি নিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, কয়রা উপকূলের কপোতাক্ষ নদী ও শাকবাড়িয়া নদী এলাকায় প্রায় তিন লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করে আসছে। ঝড় এলেই তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হন তারা। ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির তুলনামূলক কম হলেও সর্বনাশ ডেকে আনে জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। তাই আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল ’ নিয়ে ভয়ের মধ্যে রয়েছে। উপকূল জুড়ে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে হরহামেশা কোনো না কোনো বিপর্যয়ের শঙ্কা থাকেই দক্ষিণাঞ্চলে। প্রতিবারই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে কয়রা উপকূল মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে নীচু জায়গায় উঁচু বাঁধের ও নদী ভাঙন প্রতিরোধের দাবি জানিয়েছেন উপকূলবাসি।
কয়রার বাসিন্দা দিনমজুর গোলাম রব্বানী জানান, গতবছরের ঝড়ে আমার বাড়ির সব ভেঙে গিয়েছিল। কোন মতে ঠিক কারে থাকি। শুনলাম আবার নাকি ঝড় আসছে। ঝড় হলে স্কুলে গিয়ে উঠবো। ঝড়তো এখন আমাদের সঙ্গী মনে হয়। প্রতিবছর ঝড় আসে, বাঁধ ভাঙে। সবাই মিলে বাঁধ দিই। তবে এবার ভয় পাচ্ছি পূর্ণিমার সময় বলে।
উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলেন, ঝড়ের সময় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি। ভয় হয় জলোচ্ছ্বাসের। জলোচ্ছ্বাসের কারণে এবারো ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। আমরা চাই বাঁধগুলো যেন আরো মানসম্মত উঁচু হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের শেষের দিকে কয়রা উপজেলায় ১১শ’ ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান। ২০২৩ সালের শেষের দিকে জায়কার অর্থায়নে ১০০ কোটি ব্যয়ে দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে কয়রা উপজেলার ২১টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়া স্থানগুলো মেরামত করা হয়। উপজেলায় ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালি এলাকায় ১ কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়ায় ২ কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় ৩ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকায় পানি প্রবেশ করার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতে পানি সরবরাহের ৮টি সুøইসগেট অকেজো পড়ে আছে। ৪ মাস আগে ঝুঁকিপূর্ণ ১৩টি সুøইসগেট মেরামত করা হয়ে। তবে বালু দিয়ে বাঁধ দেওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন কপোতাক্ষ পাড়ের বাসিন্দারা।
কয়রা সবুজ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে। বেড়িবাঁধের উচ্চতা না বাড়ালে উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। বাঁধগুলোর উচ্চতা আরো অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো উচিত। তিনি আরো বলেন, স্বেচ্ছাসেবকসহ ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ পস্তুতি সভায় দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাইক্লোন শেল্টারসমূহ তত্ত্বাবধান, আশ্রয়কেন্দ্রে সুপেয় পানি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহে একাধিক কমিটি গঠন করা হয় কয়রা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় উপজেলায় খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ভবনগুলোও প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি, রাখা হয়েছে ১১৬টি আশ্র১য়কেন্দ্র। কেন্দ্রগুলিতে ৩২ হাজার ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। মজুদ রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার। গঠন করা হয়েছে ৭ ইউনিয়নের জন্য ৭টি মেডিকেল টিম। ২ হাজারের বেশি সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ বিভিন্ন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভলেন্টিয়ারদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ১জন করে দফতর প্রধানকে তদারকির জন্য ট্যাগ অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি জানান, প্রতিবছর বাঁধে কাজ হয়। কিন্তু দায় সারা কাজ করায় বছর না ঘুরতেই সেই ভাঙন দেখা দেয়। বর্তমানে যে কয়েক জায়গায় বাঁধ ধসে গেছে, নদীতে জোয়ার বাড়লে বাঁধ ভাঙলে গোটা ইউনিয়ন নদীতে তলিয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে।
পাউবোর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম জানান, কয়রা বেড়িবাঁধের অনেক কাজ ইতোমধ্যে হয়েছে, চলমানও আছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করা হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে, এটি শেষ হলে বেড়িবাঁধের ঝুঁকি একেবারেই কমে যাবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক উজ-জামান জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে উপকূলের বাসিন্দাদের জন্য সব ধরনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রাথমিকভাবে আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তায় প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ বাহিনী ও চিকিৎসা সেবায় মেডিকেল টিম। সতর্কতা সঙ্কেত বাড়ানো হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মজিব সভাপতি, সাইফুল সম্পাদক নাঙ্গলকোট প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন

মজিব সভাপতি, সাইফুল সম্পাদক নাঙ্গলকোট প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন

রাজধানীতে ট্রাফিক আইনে একদিনে ৮৭০ মামলা, জরিমানা ৩৫ লাখ ৮০ হাজার

রাজধানীতে ট্রাফিক আইনে একদিনে ৮৭০ মামলা, জরিমানা ৩৫ লাখ ৮০ হাজার

তারাকান্দায় বিদ্যুৎপৃষ্টে কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

তারাকান্দায় বিদ্যুৎপৃষ্টে কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

দর্শনায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল মহাসড়ক অবরোধ

দর্শনায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল মহাসড়ক অবরোধ

কেপিএম নতুন এমডি মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ যোগদন

কেপিএম নতুন এমডি মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ যোগদন

কালীগঞ্জে রাস্তার পাশে পড়ে ছিল অজ্ঞাত লাশ

কালীগঞ্জে রাস্তার পাশে পড়ে ছিল অজ্ঞাত লাশ

চীনের মধ্যাঞ্চলের সেতুতে দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত, আহত ৭

চীনের মধ্যাঞ্চলের সেতুতে দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত, আহত ৭

শপথ নিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে

শপথ নিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে

নতুন সৃষ্ট পদের এক-তৃতীয়াংশ ক্যাডার বহির্ভূতদের জন্য সংরক্ষণ পরীক্ষায় কমিটি

নতুন সৃষ্ট পদের এক-তৃতীয়াংশ ক্যাডার বহির্ভূতদের জন্য সংরক্ষণ পরীক্ষায় কমিটি

সিলেটের সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলার আসামি সাবেক ওসি মঈন গ্রেপ্তার

সিলেটের সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলার আসামি সাবেক ওসি মঈন গ্রেপ্তার

‘নতুন বাংলাদেশকে’ জাতিসংঘে উপস্থাপন করবেন ড. ইউনূস

‘নতুন বাংলাদেশকে’ জাতিসংঘে উপস্থাপন করবেন ড. ইউনূস

দেশের অর্থনীতির জন্য পায়রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-উপদেষ্টা বি:.জে:.(অব:) ড.এম সাখাওয়াত হোসেন

দেশের অর্থনীতির জন্য পায়রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-উপদেষ্টা বি:.জে:.(অব:) ড.এম সাখাওয়াত হোসেন

শ্রীনগরে ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আটক, হত্যা মালা দায়ের।

শ্রীনগরে ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আটক, হত্যা মালা দায়ের।

কারখানা ভাঙচুর চেষ্টার অভিযোগে গাজীপুরে ৬ জন আটক

কারখানা ভাঙচুর চেষ্টার অভিযোগে গাজীপুরে ৬ জন আটক

কিশোরগঞ্জে তীব্র তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা

কিশোরগঞ্জে তীব্র তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আ.লীগ

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আ.লীগ

শ্যামল দত্তকে, কারাগারে প্রেরণ

শ্যামল দত্তকে, কারাগারে প্রেরণ

আরও দুই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শাহরিয়ার কবির

আরও দুই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শাহরিয়ার কবির

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন: জেলেনস্কি

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন: জেলেনস্কি

মোংলায় গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক

মোংলায় গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার, স্বামী পলাতক