মলিন জিয়া জাদুঘর!
৩০ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম
অবহেলায় মলিন হয়ে পড়েছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর। বিগত দেড় দশকে বিমানবন্দরসহ দেশের অনেক স্থাপনা থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত এ জাদুঘরটিতেই এখনো স্বমহিমায় ভাস্বর সাবেক এ প্রেসিডেন্ট। এর মধ্যে সরকারি দলের মন্ত্রী, নেতাদের তরফে একাধিকবার জাদুঘরটির নাম পাল্টে ফেলার হুঁশিয়ারি এসেছে। কয়েকবার জাদুঘরের নামফলকও মুছে দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও জাদুঘরে কমছে না দর্শনার্থীর ভিড়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে জানতে হাজারো মানুষ ভিড় করছে সরকারি এ জাদুঘরটিতে।
গেল অর্থবছরে ৮৪ হাজার ৮২৬ জন দর্শনার্থী টিকিট কেটে জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। আর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৭৬ হাজার। টিকিট কেটে জাদুঘর পরিদর্শনের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ক্লাবের সদস্যরা দলবেঁধে এসে জাদুঘরটি পরিদর্শন করছেন। প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগ করে দিচ্ছেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে নানা আয়োজনের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সিটিজেন, শিক্ষার্থীসহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে জাদুঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থাও রয়েছে। জাদুঘরের কর্মকর্তারা জানান, গত নয় মাসে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছে। এ হিসেবে, জাদুঘরে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। গতকাল নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন এসএসসিতে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে নিয়ে জাদুঘরটি পরিদর্শন করেন বলে জানিয়েছেন জাদুঘরের কর্মীরা।
দিনে দিনে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়লেও জাদুঘরটির সংস্কার আর উন্নয়নে নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। নিয়মিত কিছু রক্ষণাবেক্ষণের কাজের মধ্যেই সীমিত রয়েছে জাদুঘরের উন্নয়ন। আর তাতে ১১১ বছরের পুরাতন অনন্য স্থাপত্যশৈলীর দৃষ্টিনন্দন ভবনটি এখন মলিন হয়ে পড়েছে। অথচ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও দেশগঠনে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা, সেই সাথে ঐতিহাসিক এ ভবনটি সংরক্ষণ করা। কিন্তু যথাযথ সংস্কারের অভাবে জাদুঘরটি যেমন জৌলুস হারাচ্ছে তেমনি ইতিহাসের অংশ ভবনটিও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। জাদুঘরে লোকবল সঙ্কট। এ কারণে অযতেœর ছাপ জাদুঘর জুড়ে। গতকাল বুধবার জাদুঘরটি ঘুরে দেখা যায়, কোথাও জমেছে ধুলো-ময়লা। দেওয়ালের কোণায় মাকড়সার জাল, দরজা-জানালায় ধুলো-বালুর আস্তরণ। কক্ষের দেওয়াল হয়ে গেছে ফ্যাকাসে। খসে পড়ছে পলেস্তোরা। কোন কক্ষে লাইটিং ব্যবস্থা বিকল। যদিও জাদুঘরের কর্মকর্তারা বলছেন, কোন অবহেলা নেই। লোকবল সঙ্কটের মধ্যেও জাদুঘরটি পরম যতেœ আগলে রেখেছেন তারা।
ব্রিটিশ আমলে ১৯১৩ সালে ছোট্ট পাহাড়ের উপর নির্মিত পুরাতন সার্কিট হাউজ ভবনটি এখন জিয়া জাদুঘর। ১৯৮১ সালের আজকের এই দিনে (৩০ মে) কালো রাতে এ ভবনে শাহাদাতবরণ করেন জিয়াউর রহমান। ওই বছর জুন মাসে তৎকালীন সরকার এ ভবনটিতে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৭টি গ্যালারী নিয়ে ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাদুঘরটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুন্দর স্থাপত্যশৈলী বিশিষ্ট এ ভবনটিতে জিয়াউর রহমানের স্মৃতি এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। জাদুঘরটিতে রয়েছে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক এবং দুর্লভ অনেক ছবি ও দর্শনীয় বস্তু। সৈনিক-রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, সার্কের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা স্থান পেয়েছে এ জাদুঘরে। একজন পরিপূর্ণ জিয়াকে জানতে এবং বুঝতে এই জাদুঘরে আসছেন দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ। অনেকে আসেন দৃষ্টিনন্দন ভবনটি দেখতে। তবে ভবনের ভেতরে থাকা মানুষটির বর্ণাঢ্য জীবনগাথা তাদেরও নাড়া দেয়। ১৯৯৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং জিয়াউর রহমানের পতœী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এই জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ভবনটিতে জিয়াউর রহমানের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন বই নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি পাঠাগারও। সেখানে রয়েছে অভিজাত একটি সেমিনার হল।
জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের ১৭ গ্যালারীতে প্রায় একক হাজারের বেশি বস্তুগত নিদর্শন রয়েছে। এক নম্বর গ্যালারীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময়ে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা। দ্বিতীয় গ্যালারীতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা নিদর্শন। কালুরঘাটের বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণার স্মৃতি বিজড়িত বেতারযন্ত্রসহ নানান সামগ্রী সেখানে স্থান পেয়েছে। তৃতীয় গ্যালারী সেক্টর ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের নানা কর্মকা- ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার এবং বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্তদের প্রোট্রেট। চতুর্থ গ্যালারীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সংঘটিত ঐতিহাসিক যুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত রণপ্রস্তুতির ঘটনা ডিউরমার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
গ্যালারি পাঁচে রয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে একটি পোস্ট অফিস স্থাপনের নিদর্শন। গ্যালারি ছয়-এ জিয়াউর রহমানের সংগ্রামী সৈনিক জীবনের নানা চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে স্থান পেয়েছে জিয়াউর রহমানের সামরিক পোশাক, ব্যাগ, টুপি, ছড়িসহ নানা সামগ্রী। সাত নম্বর গ্যালারিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে জিয়াউর রহমানর হাতে লিখা বিএনপির আদর্শ, উদ্দেশ্য সম্বলিত মেন্যুফেস্ট স্থান পেয়েছে। আট নম্বর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে জিয়াউর রহমানের বেশকিছু বিরল ছবি। নয় নম্বর গ্যালারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গভবনে অফিসকরাকালীন দৃশ্য। জিয়াউর রহমান নিজেই খাল কাটায় অংশ নেয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এগার নম্বর গ্যালারিতে সার্কের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে রয়েছে সার্কভুক্ত ৭টি দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রোট্রেটসহ একটি ডিউরমা।
বার নম্বর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়াউর রহমানের বিদেশ সফরের বেশকিছু দুর্লভ ছবি। এর পাশাপাশি সেখানে রাখা হয়েছে জিয়ার নির্মম হত্যাকা-ের পর বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের কাটিং। গ্যালারি তেরোতে শোভা পাচ্ছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিদেশ সফরকালে বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের দেয়া উপহার সামগ্রী। গ্যালারী চৌদ্দ এবং পনেরোতেও বিভিন্ন উপহার সামগ্রীর পাশাপাশি বিদেশ সফর এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বিদেশী সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের দুর্লভ অনেক ছবি। ষোল নম্বর গ্যালারিতে আসলেই দর্শকদের চোখ আটকে যাবে সেখানে রাখা একটি খাট তারপাশে রাখা ছোট্ট টেবিল এবং তার উপর দুইটি সাধারণ মানের জগ, একটি গ্লাসের দিকে। প্রেসিডেন্ট হয়েও তিনি এই সাধারণ গ্লাসে পানি পান করেছেন।
শাহাদাতের পূর্বমূহুর্তে এ কক্ষেই রাত্রি যাপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। খাটের পাশে মেঝেতে রাখা কার্পেট এবং কক্ষ থেকে বের হওয়ার পথে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ এবং বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যাওয়ার দৃশ্য জ্বলজ্বল করছে এখনো। ওই কক্ষেই ঘাতকের তপ্ত বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যায় জিয়াউর রহমানের শরীর। শাহাদাত গ্যালারি হিসেবে পরিচিত এ গ্যালারি থেকে বের হলেই গ্যালারি নম্বর সতের। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নির্মমভাবে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের লাশ গোপনে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার জিয়ানগরে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দাফন করা হয় লাশ। পরে সেখান থেকে লাশ তুলে নিয়ে ঢাকায় তাকে দাফন করা হয়। রাঙ্গুনিয়ার প্রথম মাজার এবং ঢাকার মাজারের চিত্র ডিউরমার মাধ্যমে এ গ্যালারিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম জিয়া স্মৃতি জাদুঘর। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে কয়টি জাদুঘর রয়েছে তার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য এ জাদুঘর। জিয়াউর রহমানের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন এ ভবনটি দেখতেও দর্শনার্থীরা আসছেন। আসছেন দেশি-বিদেশী পর্যটকেরাও। বিগত দেড় দশকে চট্টগ্রাম নগরীতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। জিয়া জাদুঘরের পাশেই গড়ে উঠেছে তারকা হোটেল রেডিসন ব্লু। এর পাশে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ। সুরম্য ওই দুটি ভবনের মাঝখানে মলিন জিয়া জাদুঘর বড়ই বেমানান। ওই সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে সাধারণের দৃষ্টিতেও পড়ে এমন বৈষম্য।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন
গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২
আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান
জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার
গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন
ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান
হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের
দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা
ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার
শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?
ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল
এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়
নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে
স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার
‘অধ্যাপক’ হিসেবে পদোন্নতি পেলেন শিক্ষা ক্যাডারের ৯২২ জন
ঢাবিতে মতবিনিময় সভায় যৌন নিপীড়ক শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
সেনাবাহিনীর নারী সদস্যরা হিজাব পরতে পারবেন