গুলশান ও বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে নিয়মিত ফুর্তি করতেন আনার
৩০ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম
ভারতের মাটিতে ঝিনাইদহের-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারের নৃশংসভাবে খুন হওয়ার রহস্য ও তার সম্পদ নিয়ে সর্বত্র চলছে জল্পনা-কল্পনা। আলোচনা চলছে তার রহস্যময় চরিত্র নিয়েও। দশ ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ আনার ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেপরোয়া। ছাত্রজীবনে চলতেন ২৩টি মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে। সে সময়েই জড়িয়ে পড়েন অন্ধকার জগতে।
মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য গড়ে তোলেন বিশাল সিন্ডিকেড। এই সিন্ডিকেডের গডফাদার বনে যান নিজেই। সা¤্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হাত মেলান মাফিয়া ডন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে। কোটচাঁদপুর এলাঙ্গীতে বন্ধু শাহিনের বিশাল বাগান বাড়িতে গভীর রাতে হতো চোরাচালানের লেনদেন। বাংলোটিকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে পাচার হতো সোনা ও হীরার চালান। ইতিমধ্যে বাগান বাড়ির বাংলোর চারপাশ ও ভেতরের অন্তত ১০টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। যেখানে একটি ফুটেজে শাহিনের সঙ্গে আনারকে দেখা যায় ওই বাংলোর দ্বিতীয় তলার লবিতে। তবে আনারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালান এবং হু-ির ৫০০ কোটি টাকার ভাগাভাগি নিয়েই দ্বন্দ্ব বাধে মাফিয়া ডন শাহীনের সঙ্গে। যে শাহিনের বাগান বাড়ি, ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে নিয়মিত ফূর্তি করতেন আনার। এমনকি শাহিনের একান্ত বান্ধবীর সঙ্গ পেতেই কলকাতায় যান। সবশেষ শাহীনের পাতা ফাঁদে পা দিয়েই আনার ভারতে যান। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেখানেই শেষ পরিনতি ঘটে আনারের। সর্বমহলে স্বীকৃত আনার হত্যাকা-ের নেপথ্যে রয়েছে তার উত্থান, স্বর্ণ চোরাচালান, খুনখারাবিসহ অন্ধকার জগতের নানা অপরাধ।
অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও চতুর প্রকৃতির সংসদ সদস্য আনার অবৈধভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হলেও সমালোচনা এবং আইনি ঝামেলা এড়াতে চলতেন একেবারেই সাদামাটা। স্থানীয়রা জানান, তিনি সম্পদ গড়েছেন তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও রাজনৈতিক অনুসারীদের নামে। কলকাতায়ও তিন তলা বাড়ি করেছেন সেখানের এক বন্ধুর নামে। সম্পদ গড়ার থেকে এমপি আনার নগদ টাকায় ব্যবসা (হু-ি) বাণিজ্যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। যদিও তার প্রকাশ্য ব্যবসার ধরন সম্পর্কে জানা নেই কারো।
আনার হত্যার পরে চাঞ্চল্যকর এ খুনের মাষ্টার মাইন্ড আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া শাহিনের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শাহীনের কোটচাঁদপুরের বাংলোতে এমন কোনো অপরাধ নেই যে হতো না। চারদিকে কাঁটাতারবেষ্টিত বাংলোটি ঝিনাইদহের গেদে সীমান্ত, জীবননগর, মহেশপুর জিন্নানগর, সামান্তা, মাটিলা, যাদবপুর, সামুন্দা বাগাডাঙ্গা, শ্যামকুড় সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের সাবস্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিছুদিন আগে আমরা বাংলো থেকে ১০টির মতো সিসি ফটেজ জব্দ করি। একটি ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ২টার দিকে ল্যান্ড ক্রুজারে করে দুই ব্যক্তি বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করছেন। তারা দ্বিতীয়তলার বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে ড্রিংকস করেন। ওই সময় আনার ও শাহীনকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। আমাদের ধারণা, বাংলোটি অপরাধের আখড়া। আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, নায়ক, নায়িকা, মডেল ও সাংসদ আনারের যাতায়ত ছিল নিয়মিত। ফুটেজেও তাদের আসা-যাওয়ার ছবি দেখা গেছে। তিনি বলেন, যারা ওইসব বাংলোতে আসা-যাওয়া করেছেন, তাদের তালিকা করা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, আনার এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করে গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৮৬ সালের দিকে তিনি মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন। ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক স¤্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯১ সালে আনার স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ২১টি মামলা ছিল। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে গ্রেফতার করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নেয়। গ্রেফতার এড়াতে দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। আনারকে গ্রেফতারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করলে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা থেকে অব্যাহতি পান। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
তিনবারের এই সংসদ সদস্যের সম্পদের পরিমান নিয়ে তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সর্বশেষ হলফনামা থেকে এমপি আনারের ‘নগদ টাকার’ পরিমাণ ১ কোটি ৩৯ লাখ ৩২ হাজার ৮১৮ টাকা।
অন্যদিকে যশোরের লোকজন বলছেন ভিন্ন কথা, বাস্তবে আনারের সম্পদ দৃশ্যমান নয়। না ছিলো বিলাসবহুল বাড়ি বা গাড়ি। দামি পোশাকে কখনোই দেখা যায়নি। তিনি চলাফেরা করতেন অতি সাধারণভাবে।
তবে আনার তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও রাজনৈতিক অনুসারীদের নামে সম্পদ গড়েছেন বলে আলোচনা রয়েছে। কালীগঞ্জের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় এমপি আনারের ও আত্মীয়স্বজনের নামে প্রায় ২০০ বিঘা জমি রয়েছে। এখানে একটি নতুন বন্দর চালু হতে পারে, সে কারণে তিনি জমি কিনেছেন। প্রায় ২০ বছর আগে তার নামে এই এলাকায় কিছু জমি কেনা ছিল। গত ৫-৭ বছরে আরও জমি কেনা হয়েছে। কালীগঞ্জের বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রীলক্ষ্মী সিনেমা হলসহ প্রায় ১২ কোটি টাকার ১ বিঘা জমি কেনা আছে। যেখানে বর্তমানে ১০ তলা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। আয়েশা তেল পাম্পের পাশে ২ কোটি টাকার ১০ শতক জমি রয়েছে তার। এ ছাড়া মাহাতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ রোড, কালীগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডের কোটচাঁদপুর রোডে ও কালীগঞ্জ বাজারের মুরগিহাটার পাশে প্রায় ৭ কোটি টাকার জমি রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। তবে এসব সম্পদ তার স্ত্রী-কন্যাদের নামে নেই। আছে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও রাজনৈতিক আস্থাভাজন অনুসারীদের নামে। এর মধ্যে তার ভাগ্নে, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন জনপ্রতিনিধির নামে সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারাও গত ৫-৭ বছরের মধ্যে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন
গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২
আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান
জাবির সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় রায়হানের দোষ স্বীকার
গণহত্যাকারী কোন রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার অধিকার থাকে না: আসাদুজ্জামান রিপন
ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা জন্য আমাদের লড়াই চলছে : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
ইনসি ইকো প্লাস সিমেন্ট নিয়ে এলো বাংলাদেশের সমূদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের উপযোগী করে দীর্ঘস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের সমাধান
হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় --- আবু বাকের
দৈনিক রাজবাড়ী কন্ঠে" প্রকাশকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ফরিদপুর সাংবাদিক জোটের প্রতিবাদ সভা
ডাটা সেন্টারের সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার
শ্রীলঙ্কার চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে কি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ?
ফুটবলের মাঠে চমক দেখাতে চান তাবিথ আউয়াল
এবার ফাঁস হলো রাবি শিবির সভাপতির পরিচয়
নদী দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে - পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম কারাগারে
স্বৈরাচারের পতন হলেও দোসররা এখনো রয়ে গেছে : তারেক রহমান
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক গ্রেফতার
‘অধ্যাপক’ হিসেবে পদোন্নতি পেলেন শিক্ষা ক্যাডারের ৯২২ জন
ঢাবিতে মতবিনিময় সভায় যৌন নিপীড়ক শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
সেনাবাহিনীর নারী সদস্যরা হিজাব পরতে পারবেন