ঢাকায় কমছে গাছ বাড়ছে গরম
০৮ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০১ এএম
মরুর তাপমাত্রা এখন ঢাকায়। গত কয়েক বছর ধরেই রাজধানীর গরম বেশি বেড়েছে। এবার বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠলেও গরম অনুভূত হয়েছে আরও ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রাজধানী শহরে গাছ অনেক কমে যাওয়া তীব্র গরম অনুভ’ত হওয়ার অন্যতম কারণ। অবকাঠামো তৈরি, উন্নয়ন কাজ, উন্নয়ন প্রকল্প কিংবা কারণে-অকারণে এ শহরে গাছ কাটা চলছেই, এটা কখনো থামেনি।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে নগরে যে তাপপ্রবাহ শুরু হয় তা জুনে এসে কিছুটা কমলেও দূর হয়নি। কদিন আগেও যারা সড়কে বের হয়েছেন, তপ্ত রোদ থেকে বাঁচার জন্য খুঁজেছেন গাছের ছায়া। কিন্তু তা তো এখন অনেকটাই অমবশ্যার চাঁদের মত। নাগরিকদের অভিযোগ, অবকাঠামো উন্নয়নের নামে গাছপালা কেটে নগরে মরুভূমির পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এর দায় নগর কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। নগরীতে এখন গাছ কমতে কমতে প্রায় নেই হওয়ার পথে, তবু আমরা সচেতন হচ্ছি না। পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নগর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় গত ২৮ বছরে ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এখন নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়ছে মারাত্মক হারে। বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব। ফলে ঢাকা তার বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে। তীব্র তাপপ্রবাহে খেসারত দিচ্ছেন নাগরিকরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব ইনকিলাবকে বলেন, গাছ কেটে এই রাজধানী শহরকে একটি উষ্ণ শহরে পরিণত করা হয়েছে। এ শহরে এখন মরুর তাপমাত্রা অনুভূত হয়। সিটি করপোরেশন আইনে গাছ রক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নগর কতৃপক্ষ এ বিষয়ে উদাসীন বলেই মনে হয়। তবে এই রাজধানীকে বসবাসের যোগ্য রাখতে হলে একে সবুজায়ন করতে হবে। এই শহরে প্রচুর বৃক্ষরোপন করতে হবে। তা না হলে অদূরভবিষ্যতে ঢাকা পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, ঠিক তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে। এর সঙ্গে বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব। এ প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালে করা গবেষণা অনুসারে, কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ১৯৯৯ সালে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ২০০৯ সালে বেড়ে হয় ৭৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, আর ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশে। গত বছর বিআইপির প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন বলা হয়, গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা।
গত বছর এপ্রিলে হঠাৎ একদিন রাতে ধানমন্ডির সাতমজিদ রোডের সড়ক বিভাজকের গাছ কাটা শুরু করে ডিএসসিসি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ধানমন্ডির বাসিন্দারা। টানা কয়েক দিন গাছ কাটার প্রতিবাদে মানববন্ধন, ডিএসসিসি মেয়রকে স্মারকলিপি দেন তারা। কিন্তু তারপরও সিটি করপোরেশন সব গাছ কেটে ফেলে। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভে ফেটে পড়লেও কোন কাজ হয়নি।
ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোডের বাসিন্দা শওকত আলী বলেন, আগে সাতমসজিদ রোডে চলার পথে সড়ক বিভাজকের ওপর থাকা গাছগুলো ছায়া দিতো। গায়ে রোদের তেমন তাপ লাগতো না। গাছের দিকে তাকালে চোখেও প্রশান্তি কাজ করতো। এখন সড়কটিতে চলতে গেলে মরুর মতো মনে হয়।
সাতমসজিদ রোডে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সবার উচিত উন্নয়ন দর্শন বদলানো। নগরে যেমন দালান, রাস্তা দরকার, নগরে তেমন সবুজ দরকার। সিটি করপোরেশন এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে গাছ লাগাতে বা ছাদবাগানের কথা বলতে পারে। যাতে গরম কমে, বায়ুদূষণও কমে। এভাবে ঢাকা শহরকে সবুজায়ন করতে হবে। গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশে আলাদা করে আইন আছে। আমাদের দেশে সেই আইন এবং তার প্রয়োগটা জরুরি। অন্যথায় গাছ কেটে বাসযোগ্য ঢাকা গড়া যাবে না।
২০১৬ সালে পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতর গাছ কেটে পাবলিক টয়লেট, এসটিএস নির্মাণ করেছিল ডিএসসিসি। এখন সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের জন্য আরও গাছ কাটা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবকাঠামো উন্নয়নে গত পাঁচ বছরে আরও অর্ধশত গাছ কাটা পড়েছে। একইভাবে আজিমপুর উত্তরাঞ্চল, মধ্যঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল কলোনিতে বহুল ভবন তৈরির জন্য শতাধিক বড় গাছ কাটা হয়েছে। ২০২২ সালে গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোড, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মোহাম্মদপুর থেকে বছিলা ও ২০২৩ সালে মহাখালী উড়ালসড়ক থেকে গুলশান-১ গোল চত্বর পর্যন্ত সড়ক বিভাজক পুননির্মাণ করে ডিএনসিসি। এতে গাছের শিকড় কাটা পড়ে হেলে পড়েছিল অর্ধশত গাছ। এর মধ্যে মহাখালী অংশে বড় বড় গাছ কাটা পড়েছিল বেশি। ২০১৬ সালের ২৬ জুন মতিঝিল থেকে মিরপুর-১৪ নম্বর হয়ে উত্তরা উত্তর পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর মধ্যে মতিঝিল, সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১, পল্লবী পর্যন্ত সড়ক বিভাজকের ওপর মেট্রোরেলের খুঁটি বসানো হয়েছে। ফলে আগে এ সড়ক বিভাজকে যেসব গাছ ছিল, তার সব কাটা পড়েছে। এখন মেট্রোরেলের পুরো পথে নিচে কোনো গাছ নেই। নিচে শুধু বাগান বিলাসসহ বিভিন্ন ধরনের পাতাবাহার গাছ লাগানো হয়েছে। কিন্তু দুই পাশের ফুটপাতে কোনো কাছ লাগায়নি ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। এদিকে মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফার্মগেটের আনোয়ারা পার্কের। এই পার্কের সব কাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে এখনো মেট্রোরেলের সরঞ্জাম স্তূপ করে রাখা। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই আগে এখানে বড় একটি ছায়াভরা মায়াময় পার্ক ছিল।
তীব্র গরমের পাশাপাশি ঢাকা শহরের বর্তমান সময়ের অরেকটি প্রধান সমস্যা বায়ুদূষণ। এই বায়ুদূষণ রোধের জন্য সবুজায়ন বৃদ্ধি করা জরুরি। পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, রাজধানীকে বসবাসের যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতে হলে এ শহরের আবাসন প্রকল্পে ২৫ শতাংশ সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি বছর এক জন সুস্থ ব্যক্তির নিঃশ্বাস নিতে ৭৮৬ গ্রাম অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এ জন্য প্রতি কাঠায় সাত থেকে আটটি গাছের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঢাকা শহরে এখন তা কল্পনা করা দুরূহ। তাই ঢাকা মহানগরে সবুজায়ন বৃদ্ধি করার জন্য আবাসন প্রকল্পকে ২৫ শতাংশ বনায়ন নিশ্চিত করতে বাধ্য করতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় চিরশায়িত সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট নির্জন
বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর ইন্তেকাল
বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী আর নেই, ইনকিলাব সম্পাদকের শোক
মতলবে ৯ বাল্কহেড, ১টি লোড ড্রেজারসহ আটক ২৮
জাভেদ পরিবারের ভেল্কি
দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী চক্রান্ত রুখে দিতে হবে -ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
মরিচ্যা চেকপোষ্টে ৩০ লাখ টাকার ইয়াবা উদ্ধার করল বিজিবি, আটক -১
জো বাইডেন অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন
জাস্টিন ট্রুডোকে ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ উপহার দিলেন ইউনূস
শেরপুরে আদালতের হাজতখানা থেকে আসামির পলায়ন- ৩ পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার
গফরগাঁওয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে যুবক নিখোঁজ লাশ উদ্ধার
বিভাগীয় কমিশনার, এডিসি ও ইউএনও পরিবর্তন হবে
হিন্দুরা আমাদের নাগরিক, আমরা তাদের দেখভাল করছি: নিউইয়র্কে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস
তীব্র দাবদাহে পুড়ছে রংপুরসহ উত্তর জনপদ : বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন
জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ
সিংগাইরের সড়ক দূর্ঘটনায় ১ নারীর মৃত্যু
ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অপতৎপরতায় লিপ্ত : তারেক রহমান
টেলিটকের আনলিমিটেড ডাটা প্যাকেজ জেন-জি
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দৃষ্টি হারানোদের পাশে নগর সভাপতি'র নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ