তিস্তা-ধরলা পাড়ে বন্যা
২২ জুন ২০২৪, ১২:২২ এএম | আপডেট: ২২ জুন ২০২৪, ১২:২২ এএম
দেশের উত্তর জনপদের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে ক্রমাগত। একের পর এক তলিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী সংলগ্ন উত্তরের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল। তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার পাড়ের অনেক নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ভারত ঢল-বন্যার চাপ কমাতে বিনা নোটিশে তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে। গজলডোবা বাঁধের সেই ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উত্তর জনপদের বিশেষ করে চর ও নিম্নাঞ্চলসমূহ। আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের ৪টি জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম। রংপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
তাছাড়া উজানভাগে উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল, আসামে টানা অতিবৃষ্টির কারণে নেমে আসছে ঢল-বান এবং দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানি প্রতিদিনই বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। পৌঁছে যাচ্ছে সতর্কসীমার খুবই কাছাকাছি। এর ফলে প্লাবিত হচ্ছে সিরাজগঞ্জসহ যমুনাপাড়ের নিম্নাঞ্চল। অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনা জেলায় চলমান বন্যা পরিস্থিতি কোথাও কোথাও কোথাও পানি হ্রাস পেয়ে উন্নতি, আবার কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা ও সোমেশ^রীসহ দেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের ৫টি নদ-নদী ১০টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে নদ-নদী প্রবাহের প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত কয়েকদিন যাবত তিস্তা নদীর পানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তায় পানি কাউনিয়া পয়েন্টে আগের দিনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তায় পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৭ সে.মি. নিচে রয়েছে। উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধের গেইটগুলো খুলে পানি ছেড়ে দেয়ায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে তিস্তার পানি।
তাছাড়া ভারতের ঢলে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বাড়ছেই। গতকাল ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রামে বিপদসীমার মাত্র ২০ সে.মি. নিচে এবং দুধকুমার নদীর পানি পাটেশ^রীতে মাত্র ৮ সে.মি. নিচে পৌঁছে গেছে। এতে করে বন্যা কবলিত হয়েছে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলসমূহ।
দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের সবক’টি পয়েন্টে পানি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৌঁছে যাচ্ছে সতর্কসীমার কাছাকাছি ধাবিত হচ্ছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ নুনখাওয়া পয়েন্টে পানি আরো বেড়ে ৭২ সে.মি., হাতিয়ায় ৭৬ সে.মি., ৭৯ সে.মি. নিচে পৌঁছে গেছে। যমুনা নদের পানি বেড়ে সাঘাটায় ৪৭ সে.মি. নিচে রয়েছে। সিরাজগঞ্জে যমুনা নদের পানি বিপদসীমার ৮৭ সে.মি. নিচে থাকলেও নদ-সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলগুলো একে একে তলিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনাপাড় ও চর এলাকায় মানুষের মাঝে বিরাজ করছে বন্যা এবং নদীভাঙনের উদ্বেগ-আতঙ্ক।
গতকাল পানি উন্নয়ন রোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র দেশের নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস বুলেটিনে কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদে অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে সতর্কসীমায় পেঁছাতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনা জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ জেলায় চলমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
বৈশি^ক আবহাওয়া সংস্থাসূহের তথ্যানুযায়ী, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীসমূহের পানি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ সময়ে রংপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।
নদ-নদীর পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো জানায়, পর্যবেক্ষণাধীন ১১০টি স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৬৯টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পায়, ৩৯টিতে হ্রাস পায় এবং একটিতে অপরিবর্তিত ছিল। পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে পূর্বাভাসে জানা গেছে, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ক্রমাগত বৃদ্ধিতে চারটি জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম ক্রমেই বন্যা কবলিত হচ্ছে। রংপুর জেলায় বন্যার অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। গত ১২ জুন থেকে থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিকিম রাজ্যে এবং তিস্তার উজান সংলগ্ন হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হয়েছে।
এর ফলে বেড়েছে উজানে তিস্তা নদীর পানি। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ তিস্তা নদীর অববাহিকার উজানের অংশে ভারী বর্ষণ হলে তার প্রভাব সরাসরি তিস্তায় পড়ে। তিস্তার তলদেশ অনেকাংশে পলি-বালি ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে তিস্তা নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। তিস্তায় পানি অস্বাভাবিক বেড়ে চলেছে। এর ফলে উত্তর জনপদের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে।
পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্বাভাসে জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ মাসের শেষ সপ্তাহে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের পানি সবকটি পয়েন্টে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পানি আরো বেড়ে গিয়ে কয়েকটি পয়েন্টে সতর্কসীমায় ধাবিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদপাড়ের জনসাধারণের মাঝে বন্যা ও ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
সিলেট ব্যুরো জানায়, টানা বৃষ্টির পর সিলেটে দেখা মিলেছে সূর্যের, সাথে স্বস্তি ফিরে এসেছে পানিবন্দী মানুষের মনে। তবে ধীর গতিতে কমছে বন্যার পানি। এখনও অসংখ্য ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে রয়েছে হাঁটু পানি। এতে দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছেন পানিবন্দী বাসিন্দারা। লোকালয় থেকে পানি নামলেও সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি ছয়টি পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে বন্যায় ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ এখন পানিবন্দী। গত রাতে ২৮ হাজার ৯২৫ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় ছিলো। তবে পানি নামতে শুরু করায় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ৩ হাজার ৬৫০ জন বাড়িতে ফিরে গেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢল না হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, গতকাল দুপুর থেকে সূর্য উঠেছে ও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের পৌর এলাকায় ও উজানে বন্যার পানি কমলেও ভাটিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। জেলার ছাতক ও দোয়ারাবাজর উপজেলায় বন্যার পানি কমছে। তবে শান্তিগঞ্জ উপজেলা, দিরাই, শাল্লা ও জামালগঞ্জ ধর্ম পাশা, মধ্যনগর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে জেলার ভাটি অঞ্চলের ৬ টি উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে, বন্যারপানিতে সুনামগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়ক, বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর ও ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক সহ জেলার চারটি আঞ্চলিক সড়ক থেকে বন্যার পানি নামছে। এতে গত কাল শুক্রবার সকালে থেকে এ সব সড়কে যান চলাচল শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার বার বিকেল ৩টায় সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ ষোলঘর পয়েন্টে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে জেলার ছাতক উপজেলা সদরে সুরমার পানি বিপদসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টি পাত রেকর্ড করা হয়নি যেহেতু কোনো বৃষ্টি হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় কয়েক লাখ লোক পানিবন্দী মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধ, রাস্তা ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্র নিয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটের কারণে দেখা দিেেয় জ্বর, সর্দি ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগ ব্যাধি। দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা ও বাঁধের ওপর আশ্রিত বানভাসীদের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আশ্রয় শিবিরে যারা আছেন তারা সামান্য ত্রাণ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জ ও ভারতের মেঘালয় বৃষ্টি -পাত কম হওয়ায় জেলার অনেক জায়গার পানি কমতে শুরু করছে। এবং ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে সেই রকম বৃষ্টি-পাত না হলে বন্যার পরিস্থিতি উন্নতি হবে। তিনি আরো জানান পানিবন্দী মানুষের খাবারের কোন কষ্ট হবে না, সরকারের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা জানান, উজানে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নতুন করে কোন ভাঙন না দিলে পুরানো ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকা থেকে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাড়ছে ভিড়। বন্যায় দুর্ভোগে সবচেয়ে বেশি পরেছেন কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখার মানুষ। জেলার ৭ উপজেলার ৪৭ ইউনিয়নের ৪৭৪ টি গ্রামের প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। বন্যা কবলিত এলাকার অধিকাংশ বাড়ি ঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তলিয়ে গেছে। বন্যা কবলিত মানুষ উঁচু স্থানে গবাদিপশু সহ আশ্রয় নিয়েছেন। অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে গেছে। আঞ্চলিক মহা সড়কের অনেক স্থানে পানি উঠেছে। বন্যার পানির তোরে ভেসে গিয়ে এ পর্যন্ত ২ জন মারা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার এর নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানান, জেলার কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মনু, ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানে ভারত অংশে বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমতে শুরু করেছে। ঝুকিপূর্ণ স্থান গুলোতে বালি বস্তা দেয়া হচ্ছে যাতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে না পারে। জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম জানান, বন্যায় জেলার ৭ উপজেলার ৪৭ ইউনিয়নের ৪৭৪ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইতোমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র বাড়িয়ে ২০৫টি করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন সাড়ে ৬ হাজার বন্যার্ত মানুষ। গবাদিপশুর সংখ্যা ২০০টি। মেডিকেল টিম রয়েছে ৭০টি। শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে ৪৬৫ প্যাকেট, রান্না করা খাবার ১২০০ প্যাকেট, জিআর চাল ৪২২ টন, জিআর ক্যাশ ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ৬৫ হাজার পিস। বিশুদ্ধ পানি ২৪০টি ১০ লিটারের বোতল।
রাজনগর (মৌলভীবাজার) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, অতি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের ফলে মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। গৃহপালিত পশু, হাস-মুরগী, আসবাবপত্র ও গোলার বোরো ধান নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বানভাসি লোকজন। ঘরবাড়ি ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ, গরু ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ওয়াপদার বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
বন্যার জলে ভেসে গেছে ছোটবড় প্রায় চার শতাধিক পুকুর ও খামারের কোটি কোটি টাকার মাছ। এতে মুনাফা লাভ করা তো দূরের কথা, বিভিন্ন ব্যাংক, মহাজনদের ঋণ পরিশোধের অনিশ্চয়তায় হতাশায় ভুগছেন খামারিরা। বিনষ্ট হয়েছে সদ্য বপণকৃত শতাধিক হেক্টর আমনের বীজতলা ও উৎপাদিত শাক সবজির মাঠ। কুশিয়ারা তীরবর্তী কাউয়াদিঘী হাওর রক্ষার বাঁধ (ওয়াপদার বাঁধ) নিয়েও রয়েছে সংসয়, যে কোন সময় অতিতের মতো বাঁধ ভেঙে হাওর পাড়ের মানুষকে ফেলতে পারে বিপর্যয়ের মুখে, এ নিয়ে আতংকে দিন রাত কাটাচ্ছেন কাউয়া দিঘী হাওর পাড়ের মানুষ। এমতাবস্তায় শীঘ্রই রাজনগর উপজেলাকে দূর্গত এলাকা ঘোষণা করে, খাবার,পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পানিবাহিত রোগের ওষুধপত্রসহ পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন বানভাসি লোকজন। রাজনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুপ্রভাত চাকমা ইনকিলাবকে জানান, আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে বানভাসি মানুষদেরকে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দিচ্ছি এবং আরো বেশি করে সহযোগীতা করার চেষ্টা করছি
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে তিস্তা, দুধকুমার, ব্র্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীসহ ১৬ নদীর পানি প্রতিদিনই বেড়েই চলছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। শুক্রবার তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ফুলবাড়ির শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচেছ। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
শুক্রবার কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাফসান জানি জানান, বিকেল ৩টায় দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে পানি সামান্য কমে এখন বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি ২৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ধরলা নদীর পানি ফুলবাড়ি উপজেলার শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে অন্যান্য সবগুলো নদ-নদীর পানিও বিপদসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে নদীর পানি বাড়ার কারণে তিস্তা ও ধরলা নদীসহ অন্যান্য নদনদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন কাঁচা সড়ক। অনেকেই কলার গাছের ভেলা দিয়ে বাড়িতে যাতায়াত করছে। ডুবে গেছে বাদাম, পাটখেত, ভুট্টা, মরিচ ও শাক সবজি খেতসহ বিভিন্ন উঠতি ফসল। এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, দুর্যোগ কবলিত মানুষের সংখ্যা ৪ হাজার। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্হানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে ১৪৪ মেট্রিক টন জিআর চাল এবং নগদ ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ত্রাণ হিসাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তা বিতরণের প্রস্তুতি চলছে। নতুন করে ঢাকা থেকে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা, ৯ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এবং ৫০০ মেট্রিক টন চাল।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে গত ছয় দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। চরাঞ্চলের সাড়ে ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। এদিকে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে পানিবন্দী মানুষজন। উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, কঞ্চিবাড়ী, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর ইউনিয়নের ২০ টি চরের মানুষ দীর্ঘ মেয়াদী বন্যার আতঙ্কে রয়েছেন। এসব এলাকার পাট, বাদাম ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসলাদি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানিবন্দী মানুষরা গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল বলেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার্থে সকল ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চরাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার ৫৮৪ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী লোকজনের জন্য দুইটি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদী ভাঙন ও বন্যা কবলিত লোকজনের জন্য ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এছাড়া বন্যা কবলিত লোকজনের জানমাল রক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
বালাগঞ্জ (সিলেট) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে সূর্য্যরে দেখা মিললেও পানি বাড়ছে। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে পানি কমছে। ক্রমেই বেড়ে চলেছে মানুষের দূর্ভোগ। উপজেলার প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, ৮টি ইউনিয়নের ২৮০টি গ্রামের প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, অতিবৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে ওসমানীনগরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে এলাকার ঘরবাড়ি-রাস্তাাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যমতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নের ২ লাখের বেশি পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রাকৃতিক এই দূর্যোগে দরিদ্র জনগোষ্টির জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্ধ না থাকায় অনাহার অর্ধাহারে দিনরাত কাটাচ্ছে শতশত পরিবার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে পানিবন্দী মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার্থ মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৩৫০টি শুকনো খাবারের প্যাকেট দেয়া হয়েছে। চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬৭ মেট্রিক টন। নগদ বরাদ্দ দেয়া হেয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিরতরণ করা হচ্ছে। সচেতন মহল মনে করছেন এ বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।
বন্যার পানিতে তলিয়ে থাকায় কাচা ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়তে শরু করেছে। আঞ্চলিক সড়ক গুলো পানির নিচে থাকায় এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের কয়েকেটি পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, বন্যা কবলিত হয়ে দূর্ভোগে থাকলেও তাদের ভাগ্যে জুটছেনা কোন ত্রাণ সাহায্য। ত্রাণ সাহায্য না পেয়ে চরম ক্ষুব্ধ রয়েছেন দরিদ্র লোকজন। জায়ফরপুর গ্রামের হান্নান মিয়া বলেন, আমরা ধনী লোক তাই কোন কিছু পাই না। বন্যা কবলিত হয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি। কিন্তু আমার ভাগ্যে কোন সাহায্য জুটেনি। বর্তমানে এলাকায় ব্যাপক হারে পানিবাহিত রোগ ও ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ভিড় জমাচ্ছেন। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাক্তার ময়নুল ইসলাম বলেন, ওসমানীনগরের ৮টি ইউনিয়নে ৮টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক সেবা প্রদান করছেন। চিকিৎসকরা জানান, পানিবাহিত রোগ আক্রান্ত এবং ভাইরাস জ¦রে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশু রোগীর সংখ্যা বেশি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা যানবাহন বিজয় সরণি মোড় হয়ে ডানে যেতে পারবে না
জেনিনে ইসরাইলি হামলায় বেসামরিক নাগরিক নিহত: কাতারের তীব্র নিন্দা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিশ্বব্যাংকের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের হুমকির জবাব দিল রাশিয়া
যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে ট্রাম্পের আদেশে সাময়িক স্থগিতাদেশ
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীকে সহযোগীতার দায়ে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
গাজায় যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরাইলি হামলায় নিহত ২ ফিলিস্তিনি, পশ্চিম তীরে নতুন অভিযান
ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি সার্ভিস বন্ধ
চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ কোর্ট চত্বরে সাবেক পিপি বেলাল হোসেন হামলার শিকার, আইনজীবী সমিতির নিন্দা
ফেনীতে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত
ডেনমার্ক সরকারের আইএফইউ কর্তৃক একেএস খান ফার্মাসিউটিক্যালসে ১২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ
রাশিয়ার জনগণকে ভালোবাসেন ট্রাম্প!
বিমানবন্দরে রাতভর তল্লাশিতে মেলেনি কিছুই : শাহজালালে ফের বোমা হামলার হুমকি বার্তা
বিপুল কর্মী ছাঁটাই করতে যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলো
ইএফডি মেশিনের আগে সব ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতায় আনুন
বিএনপিতে চাঁদাবাজ অত্যাচারী ও দখলবাজের কোনো জায়গা নেই : আমান উল্লাহ আমান
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলাম-ই কার্যকর পন্থা শীর্ষক জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত
বিশ্বনাথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুইট গ্রেফতার
সোনারগাঁওয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান কার্যালয় উদ্বোধন
রূপগঞ্জে শীতার্তদের ঘরে ঘরে কম্বল পৌঁছে দিলেন এসিল্যান্ড