ঢাকা   মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ৭ মাঘ ১৪৩১
কোটা বাতিলের দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ

শিক্ষার্থীদের পক্ষে রায় না এলে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা

Daily Inqilab বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার, জাবি সংবাদদাতা, জবি সংবাদাতা

০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০১ এএম

সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিলের দাবিতে এখনো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। দাবি আদায়ে লাগাতার বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, অবস্থানসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার ধারাবাহিক আন্দোলনের তৃতীয় দিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ ও শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। একই কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকায় বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে রেলপথ অবরুদ্ধ করে রাখে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে অবস্থান এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

এদিকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় বহাল থাকবে কি না সে বিষয়ে আপিল বিভাগের শুনানি আজ। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত শুনানিতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে রায় না আসলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

গতকাল বুধবার বেলা আড়াইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল থেকে স্বতন্ত্র ব্যানার পেস্টুন নিয়ে দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে দোয়েল চত্বর হয়ে হাইকোর্টের পাশ ঘেঁষে মংস্য ভবন হয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ক্ষণে ক্ষণে গাণ আর স্লোগানে মুখরিত হয় শাহবাগ চত্বর। এসময় আশপাশের সড়কে যানচলাচল বন্ধ ছিল। বিকাল পৌনে চারটা থেকে ৫টা ১০ মিনিট পর্যন্ত চলে শিক্ষার্থীদের এ অবরোধ কর্মসূচি।

অবরোধ কর্মসূচি থেকে ৪ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সারজিস আলম এসব দাবি পাঠ করে শোনান। দাবিগুলো হলো- ১. ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে। ২. ১৮› এর পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ৩. সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। ৪. দূর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

এসময় সারজিস আরো বলেন, তাদের জন্য চাকরির বয়স ৩২ করা থেকে নানান সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তখন তো আমরা কিছু বলিনি। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান রেখে বলি তাদের জন্য আরো গাড়ি দেন, বাড়ি দেন, ভাতা বাড়ান কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবেন না। মুক্তিযোদ্ধারা কখনো এই বৈষম্যমূলক সমাজ চায়নি। তারা একটা সাম্য ও সমানাধিকারের রাষ্ট্র চেয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান ঢাবির গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফারাবী রহমান শ্রাবণ বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা কোনো বৈষম্য চায়নি। তারা চেয়েছিল সবার অধিকার নিশ্চিত করতে। তারা চেয়েছিল সাম্য, সুযোগের সমতা।কিন্তু সরকারি চাকরিতে এই ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা কখনোই সবার অধিকার নিশ্চিত করে না। আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি- আপনারা দয়া করে শিক্ষার্থীদের এই ন্যায্য দাবির পাশে দাঁড়ান।

আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাবি শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, আমরা আগামীকালের আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষা করছি। আমাদের পক্ষে রায় আসলে আমরা ক্লাসে ফিরে যাব। যদি ছাত্র সমাজের রায়কে উপেক্ষা করে আদালত একই রায় বহাল রাখে তবে আমরা আরো বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করব।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তফা আকিল ইনকিলাবকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে সংশয় তো আছেই, উপরন্তু এই কোটা বাংলাদেশের সংবিধান যে বৈষম্যহীন সমাজের নিশ্চয়তা দেয়, সে সাম্যবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার খেলাপ।

ঢাবির এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, এই আন্দোলন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অসহায় নাগরিকদের অন্তিম আর্তনাদ। যে রাষ্ট্র ঠকে ঠকে টিকে যাওয়া একটা রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্র তার চালকদের আসনে কীভাবে মেধার উপরে অন্যকিছুকে প্রাধাণ্য দিতে চায় আমি বুঝি না। একবিংশ শতাব্দীর জাতি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যেখানে নিয়মিত আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় সংগ্রাম করতেছে, সেখানে মেধা ব্যতিরেকে অন্য কিছুর প্রাধান্যকে অন্যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্যান্সার হিসেবেই দেখেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, পাকিস্তানি বেনিয়া শাসকদের জুলুমের বিরোধিতায় রাষ্ট্রের ভীত, সে রাষ্ট্র এত বড় জুলুম কীভাবে করবে তার সন্তানদের উপর!

আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান সাকিব বলেন, বর্তমানে প্রতিবন্ধী ও উপজাতি কোটা ব্যতীত কোনো কোটাই থাকা উচিত না। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা তো একেবারেই অযৌক্তিক। যখন কিনা মুক্তিযোদ্ধাদের পর একটা প্রজন্ম পার হয়ে অন্য একটা প্রজন্ম চলে এসেছে। এসময়ে এসেও যদি তাদের নাতিপুতিরা এই কোটার সুবিধা পায় তবে তা কোনোভাবেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে হতে পারে না। এই নীতি একটা বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোর দিকে জাতিকে ধাবিত করে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ জাবি শিক্ষার্থীদের: ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখাসহ চার দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কের উভয় লেনে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া আজ ৪ জুলাই আপিল বিভাগের রায় সন্তোষজনক না হলে পুরো দেশ অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক (ডেইরি গেইট) সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গিয়ে অবরোধ করেন তারা।

সমাবেশে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজুল ইসলাম মেঘ বলেন, আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও দেখছি সরকারি চাকুরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা বিদ্যমান। এই বৈষম্যের জন্যই কি মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিলেন? আমরা ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহালসহ চার দফা দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছি। অতিদ্রুত কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।

বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌহিদ সিয়াম বলেন, ৪ জুলাই কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানি হবে। সেখানে যদি সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রাখা হয়, তাহলে আমাদের আন্দোলন আরো জোরালো হবে।

ইংরজি বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক বান্না বলেন, বাংলাদেশের মেধাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কখনোই এই বৈষম্য মেনে নিবো না।

এদিকে অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ প্রক্টরিয়াল বডির অন্য সদস্যরা। তারা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, তবে শিক্ষার্থীরা পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যান। পরে বিকাল পাঁচটায় অবরোধ কর্মসূচি তুলে নেন তারা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ আলমগীর কবির বলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ করেছি, যাতে তারা সাধারণ মানুষের ভোগান্তির বিষয়টি খেয়াল রাখে। তবে যেহেতু এটা জাতীয় ইস্যু, সেহেতু শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।’

বৃষ্টি উপেক্ষা জবি শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ: টানা তৃতীয় দিনে কোটা বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সড়কে অবস্থানরত অবস্থায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যায়। প্রায় এক ঘন্টা তারা এখানে অবস্থান করেন। গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট থেকে রায় সাহেব বাজার প্রদক্ষিণ করে সদরঘাট, বাবুবাজার ও গুলিস্তানগামী তাঁতিবাজার মোড় অবরোধ করে ছাত্রসমাবেশ করে। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা- ‹লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে›, ‘চাকরিতে কোটা, মানি না, মানবো না’, শেখ হাসিনার বাংলায়/শেখ মুজিবের বাংলায়, কোটার ঠাঁই নাই’, মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, কোটার ঠাঁই নাই’, ‹সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথা কবর দে›, ‹কোটা পদ্ধতি নিপাত যাক মেধাবীরা মুক্তি পাক’ সহ নানা স্লোগান দেন।

আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সোহান বলেন, আমরা মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ চাই। সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হোক। অবিলম্বে কোটা পদ্ধতি স্থায়ীভাবে বাতিল ঘোষণা করতে হবে। আমরা মনে করি, কোটা ব্যবস্থা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আরেক শিক্ষার্থী মেহেরুন্নেসা হিমু বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশে নারী কোটা সহ যত ধরনের কোটা আছে সব বাতিল করা হোক। কারণ আমরা নরীরা এখন আর মেধার দিক থেকে পিছিয়ে নেই। চাকরির বাজারে যদি মেধার যথাযথ মূল্যয়ন না করা হয় তাহলে সেটা হবে ভবিষ্যতের জন্য অশনী সংকেত। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।

রেললাইন অবরোধ করে বাকৃবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ: সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা দুই দফায় বিক্ষোভ মিছিল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড়ে রেললাইনে ট্রেন অবরোধ করে অবস্থান নেন। ওই সময় এক ঘণ্টা ট্রেন অবরোধ করে রাখা হয়।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে সমবেত হন তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। পরে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কে আর মার্কেট হয়ে মুক্তমঞ্চে এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে মুক্তমঞ্চের সামনে একটি প্রতিবাদ সভা করেন শিক্ষার্থীরা।

প্রতিবাদ সভা শেষে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড় পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি আবদুল জব্বার মোড়ে পৌঁছালে ওই সময় ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেন আটকে রেখে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ১টা ২০ মিনিট থেকে ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত এক ঘণ্টা রেললাইন অবরোধ করে রাখার পরে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

আন্দোলন চলাকালে ভেটেরিনারি অনুষদের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মাশশারাত মালিহা বলেন, ‘২০১৮-এর ছয় বছর পরে একই কোটা নিয়ে আবার আন্দোলনে নামতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এটিকে কি দেশের উন্নতি বলা যায়? ঘুরেফিরে আমরা ছয় বছর পিছিয়েই রইলাম। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি থাকবেই, তাহলে একাত্তরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রাণত্যাগ অর্থহীন হয়ে যায়। আমরা দেশের বীরদের অবশ্যই সম্মান করি। তবে কোনো ধরনের কোটা-বৈষম্য আমরা মেনে নেব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ, চাকরিতে নিয়োগ ও অন্য সব প্রতিযোগিতার জায়গায় আমরা মেধার শতভাগ মূল্যায়ন চাই।’

অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা আজীবন সর্বোচ্চ সম্মানের যোগ্য। তবে তাঁদের সম্মান দেওয়ার নাম করে কোটাপ্রথার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে চরম বৈষম্যের চেষ্টা করা হচ্ছে। ৪ জুলাইয়ে কোটার বিষয়ে যে রায় হবে, সেখানে আমরা মেধাবীদের জয় দেখতে চাই। আর তা না হলে দেশের সমগ্র ছাত্রসমাজ একযোগে রুখে দাঁড়াবে।’

বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ: সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবিতে গতকাল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ধরে অবরোধ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে সকালে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। পরে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে সেখানে বিক্ষোভ করেন। এ সময় অনেকেই কাফনের কাপড় মহাসড়কে অবস্থান নেন। এক ঘণ্টার বেশি সময় মহাসড়ক অবরোধ করায় ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় সংশ্লিষ্ট রুটের যাত্রীদের।

বিক্ষোভ সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে বৈষম্য মেনে নেওয়া হবে না। তাঁরা আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী কোটা বাদে সব বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবি জানান। ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো দেশের স্বাভাবিক অবস্থা হতে পারে না। মেধাবীরা পরিশ্রম করে চাকরি পাবেন, কোটায় নয়। কোটা প্রথা কখনোই জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে না। এটা দেশের মেধাবীদের সঙ্গে একধরনের উপহাস।

আন্দোলনরত ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সেঁজুতি বলেন, আমরা কোটা চাই না। অবিলম্বে কোটা বাতিল চাই। আশা করি, কোটা বাতিল করে আদালত রায় প্রদান করবেন। যদি কোটা বাতিল না হয়, তাহলে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ: সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে এ কর্মসূচি শুরু হয়ে ইউনিভার্সিটি সেন্টার ভবনের সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় গোলচত্বরে এসে শেষ হয়। এরপর সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ‘সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ব্যানারে এই কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবি জানান।

বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটাপ্রথার কবর দে; গর্জে উঠুক আরেকবার, একাত্তরের হাতিয়ার; কোটা না মেধা? মেধা, মেধা; অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন, কোটাপ্রথার বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন; আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই; আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার; কোটাপ্রথা যেখানে, লড়াই হবে সেখানে’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।

অবস্থান কর্মসূচিতে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুল্লা আল গালিবের সঞ্চলনায় বক্তব্য দেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব হোসেন ও সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী আজাদ শিকদার।

ফয়সাল আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালে বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি, সে দেশে এই বৈষম্যমূলক কোটা অযৌক্তিক। যেখানে স্বাধীন দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করা হয়, সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় প্রজন্মকে কোটার সুবিধা দেওয়া বৈষম্যমূলক। আমাদের দাবি, ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা বাতিল করা হোক। মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দিতে হবে।

আজাদ শিকদার বলেন, ২০১৮ সালে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা চাকরিতে অন্যায্য ও অযৌক্তিক কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৪ অক্টোবর ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক কোটা চালু করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত হতাশার বিষয়, চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন করা হচ্ছে বলে মনে করি। আমরা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছি। আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান থাকবে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) শিক্ষার্থীরা।

চবি সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রাম-হাটহাজারী মহাসড়ক অবরোধ করে কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলন করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। পরে শহীদ মিনার চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, কলা অনুষদ, বুদ্ধিজীবী চত্বর, কাটা পাহাড় ও জিরো পয়েন্ট মোড় হয়ে ১ নম্বর গেইট সংলগ্ন চট্টগ্রাম-হাটহাজারী মহাসড়কে গিয়ে শেষ হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করে সমাবেশ করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা অবরোধ মহাসড়কের উভয় লেনে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা তৃতীয় দিনের মত কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায়ের বিপক্ষে আন্দোলন করছি। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। সারাদেশের শিক্ষার্থীরা জেগে উঠেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনের পর আমাদের সাথে কেন বৈষম্য করা হচ্ছে? আমরা ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বো না।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কৃষক জামালের ক্ষেতে রঙিন ফুলকপি, উদ্বুদ্ধ হচ্ছে অন্য কৃষকরাও

কৃষক জামালের ক্ষেতে রঙিন ফুলকপি, উদ্বুদ্ধ হচ্ছে অন্য কৃষকরাও

জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল

জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল

কুয়াশা ও তাপমাত্রা নিয়ে নতুন তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের

কুয়াশা ও তাপমাত্রা নিয়ে নতুন তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের

কলকাতায় প্রকাশ্যে মুরগির মাংস বিক্রি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

কলকাতায় প্রকাশ্যে মুরগির মাংস বিক্রি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় ফেনীতে সুদানের নাগরিক আটক

ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় ফেনীতে সুদানের নাগরিক আটক

ক্ষমতা গ্রহণ করেই বাইডেন আমলের ৭৮ নির্বাহী আদেশ বাতিল ট্রাম্পের

ক্ষমতা গ্রহণ করেই বাইডেন আমলের ৭৮ নির্বাহী আদেশ বাতিল ট্রাম্পের

পেকুয়ায় প্রাচীন খাল উদ্ধারে পদক্ষেপ জনমনে স্বস্তি

পেকুয়ায় প্রাচীন খাল উদ্ধারে পদক্ষেপ জনমনে স্বস্তি

ঢাকার বাতাস ২৪৬ স্কোর নিয়ে আজ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’

ঢাকার বাতাস ২৪৬ স্কোর নিয়ে আজ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’

ট্রাম্প ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় জড়িত ১৫০০ জনকে ক্ষমা করলেন

ট্রাম্প ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় জড়িত ১৫০০ জনকে ক্ষমা করলেন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘সেকেন্ড লেডি’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘সেকেন্ড লেডি’

গাজা একটি ‘বিশাল ধ্বংসস্তূপ’, পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন: ট্রাম্প

গাজা একটি ‘বিশাল ধ্বংসস্তূপ’, পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন: ট্রাম্প

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রথম পদক্ষেপ গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি: ডোনাল্ড ট্রাম্প

মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রথম পদক্ষেপ গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি: ডোনাল্ড ট্রাম্প

ট্রাম্পের শপথ : যোগ দেন চীনের হ্যান ঝেং ভারতের জয়শঙ্কর

ট্রাম্পের শপথ : যোগ দেন চীনের হ্যান ঝেং ভারতের জয়শঙ্কর

সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

সত্যিই কি মারা গেছেন ম্যাশ? কি বলছে রিউমর স্ক্যানার?

সত্যিই কি মারা গেছেন ম্যাশ? কি বলছে রিউমর স্ক্যানার?

সেই যুবকের বিরুদ্ধে ৯০০ টাকা চুরির মামলা

সেই যুবকের বিরুদ্ধে ৯০০ টাকা চুরির মামলা

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা ট্রাম্পের

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা ট্রাম্পের

সাফারি পার্কের দেয়াল টপকে পালিয়ে গেল নীলগাই

সাফারি পার্কের দেয়াল টপকে পালিয়ে গেল নীলগাই

জোকোভিচ-আলকারাজ হাইভোল্টেজ লড়াই আজ

জোকোভিচ-আলকারাজ হাইভোল্টেজ লড়াই আজ

বড় জয়ে পয়েন্ট টেবিলে দুই নম্বরে চিটাগাং

বড় জয়ে পয়েন্ট টেবিলে দুই নম্বরে চিটাগাং