দেশজুড়ে অবনতি হতে পারে বন্যা

উত্তরাঞ্চলে বন্যার্তদের খাদ্যাভাব

Daily Inqilab শফিউল আলম/জেলা/ উপজেলা সংবাদদাতা

০৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ এএম

দেশের উত্তর জনপদ ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বন্যার আরো অবনতি হয়েছে। বন্যার বিস্তার ঘটছে মধ্যাঞ্চলের অনেক এলাকায়। বানের পানিতে থৈ থৈ করছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বন্যার সাথে সাথে ফুঁসে উঠা ও ভাঙন-প্রবণ নদ-নদীগুলোর ভাঙন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশ জুড়ে অবনতি হতে পারে বন্যা । দেশের অভ্যন্তরীণ টানা বৃষ্টিপাত ও উজানে ভারত থেকে অবিরাম আসা ঢলের কারণে বন্যা বিস্তৃত হচ্ছে এবং বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। বিরাজ করছে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই সাথে উত্তাল নদ-নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ফসলি জমি, খেত-খামার, বসতঘর, জনপদ রাস্তাঘাট। উত্তরাঞ্চলে বন্যার্তদের মাঝে খাদ্যাভাব এবং বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বানভাসি অনেকেই অসুস্থ। তাদের জরুরি ওষুধ-পথ্য ও চিকিৎসার সমস্যা প্রকট। বানভাসিদের কোনও কাজকর্ম জুটছে না, জুটছে না খাবার। এক-আধবেলা খেয়ে না খেয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে তারা দিনাতিপাত করছে। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সাহায্যের আশায় তাকিয়ে আছে বানভাসিরা। দেখা নেই ত্রাণকর্মীদের কিংবা ত্রাণ তৎপরতার।
গতকাল শনিবার বিকাল ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, দুধকুমার, ঘাঘট, সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনাসহ দশটি নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম থেকে মধ্যাঞ্চলব্যাপী নদ-নদীগুলো ফুঁসে উঠেছে। বন্যা মধ্যাঞ্চলে আরও বিস্তৃত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃহত্তর সিলেট ও নেত্রকোণায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কোথাও উন্নতি, কোথাও অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যা কবলিত হয়েছে উত্তর, উত্তর-মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দশটি জেলা। বন্যায় অন্তত ১২ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। খাবার, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানির অভাবে বন্যার্তদের দুঃখ-দুর্দশার শেষ নেই। সর্বত্র গৃহপালিত পশুপাখির খাদ্যাভাবে বিপাকে পড়েছে গৃহস্থী কৃষক পরিবারগুলো। তাছাড়া বানের পানিতে ডুবে আছে ফসলি জমি, শাক-সবজি ক্ষেত, খামার। বন্যার্তরা উপায়হীন। বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল, দ্বীপ-চর ও চরাঞ্চলের লাখো মানুষ বেশি বিপাকে পড়েছে।
গতকাল বিকাল পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ জেলাগুলোতে বন্যা পারিস্থিতি আরও অবনতির হয়েছে। মধ্যাঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে টাঙ্গাইল থেকে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত ফুঁসে উঠেছে। উত্তর-পশ্চিমে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আগেই বন্যা কবলিত সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কোথাও ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, কোথাও প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত বিপদসমীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো হচ্ছেÑ দুধকুমার, ধরলা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা, সোমেশ^রী ও মেঘনা।
এদিকে উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চলে দেশের অন্যতম বৃহত্তম অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি পয়েন্টের সবক’টিতে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে গতকাল বিকাল পর্যন্ত পানি কিছুটা হ্রাস পায়। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার, হাতিয়া পয়েন্টে ৬৮ সে.মি. এবং চিলমারী পয়েন্টে ৭০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যমুনা নদের ১০টি পয়েন্টে পানি কোথাও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে, কোথাও বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৪, বাহাদুরাবাদে ৯২, সাঘাটায় ৯৪, সারিয়াকান্দিতে ৫৮, কাজীপুর ৫৯, জগন্নাথগঞ্জে ১১৮, সিরাজগঞ্জে ৬১ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া যমুনা নদের পানি মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়িতে আরও বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ঢাকার কাছে মধ্যাঞ্চল ও মধ্য-পূর্বাঞ্চলে মেঘনা নদীর পানি মুন্সীগঞ্জে মেঘনা-সেতু পয়েন্টে পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩ সে.মি., এমনকি মেঘনার মোহনায় ভোলার দৌলতখানে ৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী দুধকুমার পাটেশ^রীতে বিপদসীমার ৩৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রামে ধরলা নদী বিপদসীমার ১০ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধায় ঘাঘট নদী বিপদসীমার ৩৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ১২ সে.মি. নিচে অবস্থান করছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুরমা নদী দু’টি পয়েন্টে ও কুশিয়ারা নদী ৩টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পুরাতন-সুরমা দিরাইয়ে এবং সোমেশ^রী নদী কলমাকান্দায় বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুলেটিনে কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে, যমুনা নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ধীরগতিতে হ্রাস পেতে পারে। এ সময়ে যমুনা নদের পানি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বৈশি^ক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলাসমূহের যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদী গোয়ালন্দ পয়েন্টে সতর্কসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ঘাঘট নদীসমূহের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। ধরলা, দুধকুমার ও ঘাঘট নদী সংলগ্ন কুড়িগ্রাম গাইবান্ধা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যমুনেশ^রী, করতোয়া, বাঙ্গালী, আপার-করতোয়া, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, ইছামতী-যমুনা, আত্রাই, মহানন্দা এবং ছোট-যমুনা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে এবং তা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
পাউবো’র পর্যবেক্ষণাধীন দেশের ১১০টি নদ-নদীর পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৬৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি এবং ৪২টিতে হ্রাস পায়। ৫টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত ছিল। বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ও বিপদসীমায় রয়েছে দশটি নদ-নদী ২১টি পয়েন্টে। গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে ১৫৪, কুচবিহারে ১২৬, দার্জিলিংয়ে ১১৭, কলিমপংয়ে ৯৩, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৯০ মিলিমিটার।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি পাঁচ সেন্টিমিটার কমে কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদীর পানি ৪২ সেন্টিমিটার বেড়ে কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ও ধরলাসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আপাতত না বাড়লেও দুধকুমার নদীর পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। আগামী আরও কয়েকদিন বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে। এবছর ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
জেলা কুড়িগ্রামে ৭২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৫টি ইউনিয়নই বন্যাদুর্গত। এক লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি। গত মঙ্গলবার থেকে বানের পানির সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন তারা। অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে। অনেক দুর্গত এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন বন্যা দুর্গতরা। অনেকে অভিযোগ করেছেন সরকারি ত্রাণ সহায়তা অপ্রতুল। এখনো দুর্গম এলাকাগুলোতে সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ ইনকিলাবকে জানান, সবদিকে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব দুর্গত পরিবারের কাছে সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এবছর বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারে। বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তিনি সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন।
এদিকে গত শুক্রবার বিকেলে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় কলাগাছের ভেলায় চড়ে যাওয়ার সময় দুই বোনসহ তিন জন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন নাগেশ্বরী উপজেলার কালিগঞ্জ ইউনিয়নের বেগুনী পাড়া গ্রামের শাহাদাৎ হোসেনের দুই মেয়ে সুমাইয়া আক্তার, মাছুমা আক্তার এবং একই উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ব্যাপারী পাড়া গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মুন্সির ছেলে সিরাজুল ইসলাম। দুই বোন ভেলায় করে প্রতিবেশী খালার বাড়িতে যাচ্ছিল এবং সিরাজুল ইসলাম ভেলায় চড়ে বাজারে যাচ্ছিলেন শুকনো খাবার কেনার জন্য।
লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, চতুর্থ দফায় বন্যার কবলে পড়ছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢল কারণে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমা সীমার ছুঁই ছুই করছে। এতে তিস্তা ও ধরলা তীরবর্তী এলাকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে তিস্তার বাঁধ। এ অবস্থায় নদীপাড়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে জেলার ৫ উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ৩ হাজার পরিবার। গতকাল সকাল ৯টায় তিস্তা ব্যারাজের পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। অপর দিকে ধরলার শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সে.মি. নিচে প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। পাউবো বলছে, পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে স্বল্পমেয়াদী বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, তিস্তা ও ধরলার নদীর পানি বিপৎসীমা সীমার ছুঁই ছুই করছে। এতে লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরের বসতবাড়ি ও রাস্তা ঘাট পানি নিচে তলিয়ে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষ। পাশাপাশি গবাদি পশু হাঁস মুরগি নিয়ে বিপদে আছেন নদীপাড়ে বাসিন্দারা।
তিস্তা পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, নিজ গড্ডিমারী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না, চর সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি,রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করায় আবারও বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিস্তা পাড়ের আজগার আলী জানান, গত দুইদিন ধরে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঘরবাড়িতে পানি উঠে গিয়েছে। রাস্তাঘাটে চলাচল করতে কষ্ট হচ্ছে। গরু বাছুর নিয়ে আমরা বিপদে আছি।
এ বিষয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা জানান, উজানের ঢলে আবারো তিস্তার পানি বৃদ্ধি পায়ে সকাল থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জাকির হোসেন জানান, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে অনেক ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। গড্ডিমারিতে তিস্তা একটি বাঁধ ধসে যাওয়া শুরু হয়েছে। বিষয়টি আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। অত্র ইউনিয়নে প্রায় ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি। লালমনিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, তিস্তার পানি ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা আমরা জেনেছি। বর্তমানে বিপদসীমা ১০ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। তীরবর্তী এলাকায় কিছু পরিবার পানিবন্দি হতে পারে তবে এ ধরনের তথ্য আমাদের কাছে নেই।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, পানির স্রোতে ভুঞাপুরের ভালকুটিয়ায় একটি কাচা সড়ক ভেঙে গিয়ে প্রবল পানির স্রোতে আশ-পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পরেছে। এ দিকে ভুয়াপুরের গোবিন্দাসি বাজারে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। টাঙ্গাইলে নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা বন্যা কবলিত হচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে টাঙ্গাইল জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ঝিনাই নদীর পানি বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার এবং ধলেশ^রী নদীর পানি ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ভুঞাপুর, কালিহাতী, গোপাপলপুর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নদীর পানি প্রবেশ অব্যাহত আছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে এসব উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার বাড়ি-ঘর ও ফসলী জমি।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার যমুনা-ব্রহ্মপুত্র-জিঞ্জিরাম নদ নদীর পানি প্লাবিত হয়ে গ্রাম থেকে পৌর শহরের আনাচে কানাচে প্রবেশ করেছে। নদ-নদীতে ভাঙন অব্যাহত। একাধিক সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বানভাসি মানুষের আশ্রয়ণ কেন্দ্রের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে অনেক এলাকায়। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানিবন্দি । এক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে দেওয়ানগঞ্জবাসী। পাঁচ দিনের ভারি বর্ষণের সাথে নদ-নদী গুলোতে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার ৬৩ সে.মি পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬২ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শুক্রবার ৩১ সে. মি পানি বৃদ্ধি পেলেও গতকাল শনিবার পানি স্থির ছিলো। তবে বিপদসীমার ৯৩ সে.মি উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। তিনদিন পানি বাড়ায় উপজেলা পৌর শহরের উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স, নির্বাহী এলাকা, রেলওয়ে স্টেশন, বেলতলী বাজার, চিকাজানি আকন্দপাড়া সহ ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম মিলে প্রায় ১৩ হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। বানভাসি ৫০০ এর অধিক পরিবার ৭ টি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। ইতোমধ্যে এসব পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা হিসাবে উপজেলা প্রশাসন ১২.৩০ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করেছে। এবং ১৬৫ প্যাকেট শুকনা খাবার ।
যমুনার ভাঙন তান্ডব অব্যাহত রয়েছে চিকাজানি ও চুকাইবাড়ি ইউনিয়নে। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার হচ্ছে মন্ডলবাজার, গুলুঘাট, পোল্যাকান্দি, ঝালোরচর ও সানন্দবাড়ি এলাকার পাটাধোয়াপাড়া। জিঞ্জিরিাম নদও নিরবে ভাঙছে তার পাশ^বর্তী লম্বাপাড়া, হাড়ুয়াবাড়ী, গোয়ালকান্দা এলাকাগুলো। নদী গর্ভে যাচ্ছে ফসলি জমি, বসতবাড়ি। বানভাসি মানুষেরা আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে স্কুল কলেজ ও রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে।
স্রোতের বেগে দেওয়ানগঞ্জ-খোলাবাড়ি সড়কের উত্তর পাশের সেতুটির গোড়ায় ধ্বসে গেছে। হাতিভাঙা ইউনিয়নের মহারাণী খালের উপর নির্মানাধীণ ব্রিজ পাশর্^ সড়ক সহ মোল্লারচর নৌকা ঘাটের সড়কটির মাঝেও ভেঙে গেছে। পৌর শহরের যাতায়াত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন আছে গুজিমারি, মাদারের চর, মন্ডল বাজার এলাকা সহ আরো কয়েকটি এলাকায়।
পানিবন্দি হয়ে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিশারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চুকাইবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছিন্নমুকুল প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরভবসুর সাহাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, কাঠারবিল হাতিভাঙ্গা আফরোজা বেগম এ বি উচ্চ বিদ্যালয় সহ অধিক প্রতিষ্ঠান। বন্যার পানি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অবনতি হওয়াই চলমান এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থীদের বেগ পোহাতে হচ্ছে । সেই সাথে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দিতেও একই রকম ভোগান্তি ।
পৌর বাসিন্দা এমদাদুল হক জিয়ন সহ অনেকের ভাষ্য বন্যা মোকাবেলার পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় বানভাসি মানুষগুলো মানবতার জীবনযাপন করছে। সেই সাথে নদী ভাঙন ঠেকাতে দেওয়ানগঞ্জের জন্য স্থায়ী বেড়ি বাঁধ অত্যন্ত জরুরি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স জানান, ভেঙে যাওয়া সড়কগুলো সংস্কার চলছে। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান নিলেন ৩৫ প্রত্যাশীরা
হাসিনার গোপন চুক্তি বাতিলে ভারতকে চিঠি দেবে বাংলাদেশ
ভূমি উপদেষ্টা হলেন আলী ইমাম মজুমদার
বিগত সরকারের আমলে প্রতিটি সেক্টরের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হয়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ভোক্তার অভিযোগের জন্য ওয়েব পোর্টাল চালু
আরও

আরও পড়ুন

শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান নিলেন ৩৫ প্রত্যাশীরা

শিক্ষা ভবনের সামনে অবস্থান নিলেন ৩৫ প্রত্যাশীরা

সাতক্ষীরায় ব্যবসায়ির ২৩ লাখ  টাকা ছিনতাইয়ের  মূল মাস্টারমাইন্ড আলিমুদ্দিনসহ দু'জন গ্রেপ্তার

সাতক্ষীরায় ব্যবসায়ির ২৩ লাখ  টাকা ছিনতাইয়ের  মূল মাস্টারমাইন্ড আলিমুদ্দিনসহ দু'জন গ্রেপ্তার

কেন্দ্রীয় কৃষক দল নেতাকে বিএনপি নেতার হুশিয়ারি

কেন্দ্রীয় কৃষক দল নেতাকে বিএনপি নেতার হুশিয়ারি

এনামুলকে সরিয়ে রাজশাহীর নেতৃত্বে তাসকিন

এনামুলকে সরিয়ে রাজশাহীর নেতৃত্বে তাসকিন

কাপ্তাইয়ে পাহাড় কাটার ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর

কাপ্তাইয়ে পাহাড় কাটার ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর

শিক্ষার্থীদের জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করতে হবে  :  আভা রাণী দেব

শিক্ষার্থীদের জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করতে হবে : আভা রাণী দেব

হাসিনার গোপন চুক্তি বাতিলে ভারতকে চিঠি দেবে বাংলাদেশ

হাসিনার গোপন চুক্তি বাতিলে ভারতকে চিঠি দেবে বাংলাদেশ

মাগুরায় এক শ্রমিকের মৃত দেহ উদ্ধার

মাগুরায় এক শ্রমিকের মৃত দেহ উদ্ধার

জিয়া পরিষদের দপ্তর সম্পাদক হলেন সালথার হেমায়েত হোসেন

জিয়া পরিষদের দপ্তর সম্পাদক হলেন সালথার হেমায়েত হোসেন

ভূমি উপদেষ্টা হলেন আলী ইমাম মজুমদার

ভূমি উপদেষ্টা হলেন আলী ইমাম মজুমদার

শ্রীপুরে কারখানার বয়লার বিস্ফোরণ, আহত ২০

শ্রীপুরে কারখানার বয়লার বিস্ফোরণ, আহত ২০

যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি -২ এর মাথা থেকে নামতে পারেনি আওয়ামী ভূত

যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি -২ এর মাথা থেকে নামতে পারেনি আওয়ামী ভূত

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক এমপি বাহারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক এমপি বাহারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

বিগত সরকারের আমলে প্রতিটি সেক্টরের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হয়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

বিগত সরকারের আমলে প্রতিটি সেক্টরের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হয়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

প্রকাশ পেল 'রিকশা গার্ল' সিনেমার মিউজিক ভিডিও 'কোন লাটাইয়ে উড়বা ঘুড়ি'

প্রকাশ পেল 'রিকশা গার্ল' সিনেমার মিউজিক ভিডিও 'কোন লাটাইয়ে উড়বা ঘুড়ি'

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার: জিএম কাদের

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার: জিএম কাদের

সিলেটকে তলানীতে পাঠিয়ে ঢাকার দ্বিতীয় জয়

সিলেটকে তলানীতে পাঠিয়ে ঢাকার দ্বিতীয় জয়

আবু সাঈদ হত্যা: রংপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল

আবু সাঈদ হত্যা: রংপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল

ট্রাম্পের ২.০: তার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন যারা

ট্রাম্পের ২.০: তার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন যারা

গম সহ কৃষি পণ্যে উৎপাদন ও গুনগত মান ব্যহতের আশংকা

গম সহ কৃষি পণ্যে উৎপাদন ও গুনগত মান ব্যহতের আশংকা