প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর : প্রত্যাশা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ উচ্চতায় উন্নীত
০৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম
চীন বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশ সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জুলাই। চারদিনের এ সফর। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে যান ভারতে। দুই দফা ভারত সফরের পর যাচ্ছেন চীনে। ভারত ও চীনের সর্ম্পক মসৃণ নয় বরং বৈরি। পরস্পর বৈরী এ দুই বৃহৎ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চমৎকার ও ভারসাম্যমূলক। এর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি এ দু’ দেশের সঙ্গে সমানতালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে তার একটি নিজস্ব মূল্যায়নও আছে। গত ২৫ জুন ভারত সফর নিয়ে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দু’ দেশের বিষয়ে বলেছেন, ভারত আমাদের চরম দুঃসময়ের বন্ধু। আবার চীন যেভাবে নিজেদের উন্নত করছে, সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সেগুলো সামনে রেখে সম্পর্ক রেখে যাচ্ছি। আমি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে যাচ্ছি। আমি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। চীন সফর প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, চীন আমাকে দাওয়াত দিয়েছে। আমি চীনে যাব। আমি যাবো না কেন? বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই চলবো। কার কী ঝগড়া, সেটা তাদের সঙ্গে থাক। আমার না। দেশের মানুষের কতটুকু উন্নতি করতে পারি, সেটাই আমার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা খুব পরিষ্কার ও স্পষ্ট। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে কেন্দ্র করে এক ধরনের উৎকণ্ঠা আছে ভারতেরÑ না জানি বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে! প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারত ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বারক সইয়ের মাধ্যমে অনেক কিছু পেয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের ট্রেন চলাচলের করিডোর পেয়েছে। রেল করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। অনেকে বলছেন, একপেশে চুক্তিতে দেশের সার্বভৌমত্ব পর্যন্ত হুমকিতে পড়েছে। সব পেয়েও ভারত কতটা খুশি, সেটাই প্রশ্ন। ভারত চায়, বাংলাদেশ সব সময় তার পক্ষে বা প্রভাববলয়ে থাক। তার কথা মতো চলুক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তার একটি জবাবও আছে। ভারত যাই ভাবুক, তার চীন সফরকে বিশ্লেষকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ বলে বিবেচনা করছেন। মনে করছেন, সফরটি গেম চেঞ্জার। চীনও সফরকে যথোচিত মূল্য দিচ্ছে। ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ডিকাবের অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে মাইলফলক হবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিঙ বলছেন, এ সফরে চীন- বাংলাদেশ সর্ম্পক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে। তার ভাষায়, বাংলাদেশ ও চীন নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কীভাবে কাজ করবে, এ সফরে তা নির্ধারিত হবে। তার এ কথা থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশ ও চীন আগামী দিনগুলোতে একসাথে কীভাবে পথ চলবে তার একটা নকশা এ সফরে তৈরি হবে।
চীন বাংলাদেশের বহু পুরানো ও পরীক্ষিত বন্ধু। দু’ দেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রাচীন ও অনেক গভীরে প্রথিত। এরই প্রেক্ষাপটে নির্মিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতায় উন্নীত হয়, যখন ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সূত্রে তা নিবিড় কৌশলগত অংশীদারিত্বে রূপ নিতে যাচ্ছে। শিং জিন পিংয়ের ওই সফরের মধ্য দিয়ে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। এবার চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্পর্কের এই ক্রমোন্নয়ন ও ক্রমবিকাশের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে চীনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পঞ্চনীতির। সেটা চীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরের মাধ্যমে আরো এগিয়ে নিতে চায়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিঙয়ের ভাষায়, ওই পঞ্চনীতি হলো: পারস্পরিক রাজনৈতিক বিশ্বাস আরো গভীর, উন্নয়ন কৌশলগুলোকে আরো একত্র, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার উচ্চ অগ্রগতি, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি বাড়নো, গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ।
চীন বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী। একই সঙ্গে বড় বাণিজ্য সহযোগীও। পদ্মাসেতুসহ দেশের বহু রাস্তা, ব্রিজ, স্থাপনা, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল বহু কিছু চীনা অর্থে ও লোকবলে হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে উন্নয়ন অগ্রাধিকার পাবে। বাণিজ্যক্ষেত্রে চীনের প্রায় একতরফা প্রাধান্য থাকলেও এর বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনাও আছে, যদি দু’ দেশের ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেয়। ইনকিলাবের খবরে প্রকাশ, এবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চীন সফরে যাচ্ছে শীর্ষস্থানীয় দু’শতাধিক ব্যবসায়ী। তারা আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত। এই প্রথমবারের মতো চীনে দু’ দেশের ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ বিজনেস, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট হতে যাচ্ছে। এতে চীনের প্রায় ৭-৮শ’ ব্যবসায়ী অংশ নিচ্ছে। উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের এই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, সম্পর্ক ভবিষ্যতে বাণিজ্য বিকাশ বিশেষত বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে ঘাটতি মোচনে সহায়তা করবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দু’ দেশের ব্যবসায়ীরা তাদের ক্ষেত্রে গেম চ্যাঞ্জার হয়ে উঠতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী চীন সফরে বাংলাদেশ চীনের কাছে অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ চাইবে বলে পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলার অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য। আর ৫ বিলিয়ন ডলার চীন থেকে পণ্য আমদানির দায় মেটানোর জন্য। এটা ইউয়ানে নেয়া হবে। ডলার সংকটের কারণে চীন থেকে আমদানির দায় মেটানো সম্ভব না হওয়ায় এ ঋণ নেয়া হচ্ছে। এতে আমদানিকারকরা সুবিধা পাবে। একইসঙ্গে তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়ক হবে। কোনো কোনো পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প সহায়তা, বাজেট সহায়তা ও রিজার্ভ সহায়তার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকার জাপানের বঙ্গোপসাগরীয় শিল্পাঞ্চল প্রবৃদ্ধি বলয়ে যুক্ত হয়ে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে যে সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে, তারই আদলে পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (সিডি) নিচ্ছে এবং চাচ্ছে তাতে অংশীদার হোক চীন। বাংলাদেশের ইচ্ছার বিষয়টি ইতোমধ্যে চীনের বিভিন্ন মহলে জানানো হয়েছে এবং ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ বিষয়ে সমঝোতা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর বাইরে সড়ক ও রেলের ৯টি প্রকল্পে চীনের ঋণ আশা করছে বাংলাদেশ। এই ৯টি প্রকল্পের ৬টি রেলের। বাকী ৩টি সড়কের। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নানা বিষয় স্থান পেতে পারে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ-জ্বালানি, সমুদ্রকেন্দ্রিক সহযোগিতা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিআরআই, মুক্তবাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, জলবায়ু, ডিজিটাল, স্বাস্থ্য সহযোগিতা, রোহিঙ্গা ইস্যু, তিস্তা প্রকল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ডিজিটাল ইকোনমি, মিডিয়া সহযোগিতা, জনগণ পর্যায়ে যোগযোগ ইস্যুতে বেশকিছু চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে।
ভৌগলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী অবস্থানে তার অবস্থিতি। অবস্থানগত কারণেই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। দূরের যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মূল্য দেয়। এই তিন পক্ষই বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। যেহেতু তাদের স্বার্থের বিভিন্নতা রয়েছে, সুতরাং সবার ইচ্ছা পূরণের সাথী হওয়া সম্ভব নয় বাংলাদেশের পক্ষে। এই ত্রিশক্তির সঙ্গে বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক নীতি নিয়ে চলছে। এতে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। এই যেমন, তিস্তা মহাপ্রকল্প নিয়ে চীন আগে থেকেই কাজ করছে। বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন সব সময় প্রস্তুত। অথচ, হঠাৎই ভারত চানক্যনীতির কৌশল গ্রহণ করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তাব দিয়ে বসেছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নে বাগড়া লাগানোই ভারতের ওই প্রস্তাব দেয়ার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অভিমত দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, ভারত যে আগ্রাসী, এটা তার একটা প্রমাণ। এতে চীনের ক্ষুদ্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু তার কোনো প্রকাশ নেই। বরং চীনা রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে যা বলেছেন, তা খুবই গুরুত্ববহ ও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, তিস্তা নদী বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ফলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাদের সহায়তা গ্রহণ করবে, সেটা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের বিষয়। বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের প্রতি চীন শ্রদ্ধাশীল থাকবে। তিনি এও বলেছেন, তিস্তা প্রকল্প করতে চীন প্রস্তুত, তবে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ। এমনকি প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে কাজ করতেও রাজি। সার্বভৌম সমতা এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতির অনুসারী দেশের পক্ষে এ ধরনের কথা বলা সম্ভব।
প্রতিবেশী হিসেবে হিন্দুত্ববাদী ভারতের আচরণ আধিপত্যবাদী ও সংকীর্ণ। এ কারণে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক ভালো নেই। পাকিস্তান তো তার চির বৈরী। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও তার সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। মালদ্বীপ পর্যন্ত বিগড়ে গেছে। প্রতিবেশী চীন তার প্রধান আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ। কাজেই তার সঙ্গে সম্পর্ক কীরূপ, সহজেই অনুমেয়। প্রতিবেশী ও ভারতমিত্র দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বাড়ছে। সেটাও চীনের প্রতি ভারতের কুপিত হওয়ার একটা কারণ বটে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের রসায়ন পর্যবেক্ষক মহলের অজানা নেই। এটা একতরফা সম্পর্ক। কোনোরূপ প্রতিদান ছাড়াই ভারত যা চাইছে, অবলীলায় তা দিয়ে দেয়ার নীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত্তি এটাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে পথনকশা প্রণীত হয়েছে, তাতে ষোলআনা লাভ হয়েছে ভারতের। বাংলাদেশর জন্য কিছু নেই। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের ‘নেবো আর নেবো, কিছুই দেবো না’ এ রকম নীতি দেখতে চায় না। এর বাইরে যেতে চায়। সেক্ষেত্রে চীনই তাদের কার্যকর সহযোগিতা দিতে পারে। এক্ষেত্রে বিশিষ্টজনদের অনেকেই বলে থাকেন, স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ভারত এটার প্রমাণ দিতে পারেনি। অথচ করোনার সময় চীন প্রমাণ দিয়েছে তারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের পাশে থাকতে চায়।
চীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌম সমতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন নীতিতে বিশ্বাসী। এ কারণে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও খ্যাতি, সুনাম ও প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে টপকিয়ে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ার পথে হাটছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। তার মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলোও তাই। তাদের প্রভাব ও প্রভাব বলয় ‘দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। তাদের যেমন কিছু দেয়ার নেই; ইচ্ছাও নেই। ভারতেরও দেয়ার সক্ষমতা নেই। পক্ষান্তরে চীন এশিয়া, আফ্রিকাসহ গোটা বিশ্বে সহযোগিতার যে দুয়ার উন্মুক্ত করেছে তাতে সবাই উপকৃত হচ্ছে। ফলে চীনের প্রিয়তা বাড়ছে। আফগানিস্তানের মতো দেশেও চীনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান।
বাংলাদেশের বড় সুবিধা হলো, চীন প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশকে অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে গণ্য করে। আর্থ-বাণিজ্যিকসহ সব ধরনের সহায়তা দিতে সে সব সময় একপায়ে খাড়া। পদ্মা সেতুর ঋণ যখন বিশ্বব্যাংক আটকে দিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন; তখন চীন এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চীন যে ভূমিকা ও অবদান রেখে যাচ্ছে, তার কোনো তুলনা নেই। চীনের কাছে বাংলাদেশের আরো অনেক কিছু পাওয়ার আছে। ওয়াকিবহালদের জানা, বাংলাদেশ যে পূর্বমুখী নীতি নিয়েছিল, তাতে চীন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। প্রতিবেশী মিয়ানমার ও চীন পূর্বমুখী নীতির সমর্থক ছিল। এই নীতির লক্ষ্য ছিল, যোগাযোগ ও আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক পূর্বের দেশগুলিতে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে লাভবান হওয়া। মিয়ানমার ছিল প্রথম দেশ, পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়নে যার ভূমিকা হতো নিয়ামকের। পূর্বমুখী নীতির সম্প্রসারণ একদিকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড, লাউস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ঘটতো, অন্যদিকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং ও অন্যত্র ঘটতো। বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্কেরই প্রসার ঘটতো না, মানবিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কও বিকশিত হতো। পূর্বমুখী নীতি এখনো এগিয়ে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসে পূর্বমুখী নীতির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হতে পারে। বাংলাদেশ-চীন এক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। মিয়ানমার চীনের অভিন্ন মিত্র। বাংলাদেশের সঙ্গেও তার সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ। মিয়ানমার এগিয়ে এলে, চীন এগিয়ে এলে পূর্বমুখী নীতির বাস্তবায়ন সম্ভবপর হতে পারে।
স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের পূর্বমুখী নীতির বিপরীতে ভারত অনুরূপ পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশকে তাতে শামিল হওয়ার আহ্বান জানায়। তারপর বাংলাদেশের পূর্বমুখী নীতি থেমে যায়।
আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের একটি বড় রকমের মাথা ব্যাথার কারণ। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এটা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সবচেয়ে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারে চীন। এ বিষয়ে আলোচনা ও বাস্তব অগ্রগতি প্রত্যাশা করে বাংলাদেশের মানুষ। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত মিয়ানমার সরকারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।
আজকাল আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির কথা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত ও উল্লেখিত হচ্ছে। আসলে যোগাযোগ ও সংযুক্তি দরকার মানবিক ও আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্যই। ভারতও কানেক্টিভিটির কথা বলে। তবে সে কানেক্টিভিটি সম্পূর্ণ তার নিজের স্বার্থে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল ট্রানজিটের যে সমঝোতা হয়েছে, সেটা ট্রানজিটও নয়, কানেক্টিভিটিও নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে তা করিডোর মাত্র। ভারতের ট্রেন বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারত যাবে। একে কেন ট্রানজিট বলা হবে? আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি হতে পারে ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, চীন, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করে। এ রকম বহুদেশীয় বা বহুপক্ষীয় ট্রানজিট নয় কেন? তাহলে তো সংশ্লিষ্ট সব দেশই এই কানেক্টিভিটির সুবিধা পেতে পারে। এরকম কানেক্টিভিটি গড়ে তুলতে ভারতের উদারতা প্রয়োজন। সে উদারতা ভারত কি দেখাতে পারবে?
পরিশেষে বলবো, যে কোনো দিক ও বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচক হতে পারে। আমরা আশা করবো, উভয় পক্ষ খোলাখুলি আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যেতে সচেষ্ট হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
সাতক্ষীরায় ব্যবসায়ির ২৩ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মূল মাস্টারমাইন্ড আলিমুদ্দিনসহ দু'জন গ্রেপ্তার
কেন্দ্রীয় কৃষক দল নেতাকে বিএনপি নেতার হুশিয়ারি
এনামুলকে সরিয়ে রাজশাহীর নেতৃত্বে তাসকিন
কাপ্তাইয়ে পাহাড় কাটার ঘটনাস্থলে গিয়ে সত্যতা পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর
শিক্ষার্থীদের জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করতে হবে : আভা রাণী দেব
হাসিনার গোপন চুক্তি বাতিলে ভারতকে চিঠি দেবে বাংলাদেশ
মাগুরায় এক শ্রমিকের মৃত দেহ উদ্ধার
জিয়া পরিষদের দপ্তর সম্পাদক হলেন সালথার হেমায়েত হোসেন
ভূমি উপদেষ্টা হলেন আলী ইমাম মজুমদার
শ্রীপুরে কারখানার বয়লার বিস্ফোরণ, আহত ২০
যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি -২ এর মাথা থেকে নামতে পারেনি আওয়ামী ভূত
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক এমপি বাহারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিগত সরকারের আমলে প্রতিটি সেক্টরের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হয়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
প্রকাশ পেল 'রিকশা গার্ল' সিনেমার মিউজিক ভিডিও 'কোন লাটাইয়ে উড়বা ঘুড়ি'
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার: জিএম কাদের
সিলেটকে তলানীতে পাঠিয়ে ঢাকার দ্বিতীয় জয়
আবু সাঈদ হত্যা: রংপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল
ট্রাম্পের ২.০: তার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ফিরছেন যারা
গম সহ কৃষি পণ্যে উৎপাদন ও গুনগত মান ব্যহতের আশংকা
'শাহরুখ খান ফরএভার' ক্রিসের এমন বার্তার কি জবাব দিলেন শাহরুখ?