রাতের ঢাকা আতঙ্কের নগরী
৩০ জুলাই ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৪, ১২:০৭ এএম
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় পূর্ব নাখালপাড়ার লিচু বাগান রোডের একটি মেসে থাকি আমি। সামনে পরীক্ষা। বুধবার গভীর রাতে ব্যস্ত ছিলাম পড়ালেখা নিয়ে। হঠাৎ পুলিশ আসে মেসে। তার সঙ্গে থাকা অন্য শিক্ষার্থীদের পুরো মেসে চালায় তল্লাশি। পরে কিছু না পেয়ে নাম-ঠিকানা নিয়ে চলে যায়। কিন্তু আতঙ্ক কাটে না কারোর। মনের ভেতর ভয়, কখন আবার পুলিশ আসে। তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী মাহাবুব (ছদ্র নাম) এ কথা বলেন।
মেসের আরেক শিক্ষার্থী আবির আহমেদ জানান, আমরা লেখাপড়া করছিলাম। সম্প্রতি সহিংসতার ঘটনায় প্রতিদিন বিভিন্ন মেসে পুলিশের তল্লাশির খবর শুনি। ভয়ে ভয়ে ছিলাম কবে আমাদের এখানে আসে। শেষ পর্যন্ত এলো। এখন ভয়ে পড়ালেখা করতে পারছি না। আবার কবে আসে, কখন কী হয়, কিছুই বুঝতে পারছি না। খুব ভয় লাগছে। ভাবছি মেস ছেড়ে দেব। কিন্তু কোথায় যাব? ঢাকায় তো আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মেসে ও বাসাবাড়িতে ব্লক রেইড অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। যাদের মোবাইল ফোনে সহিংসতার ভিডিও, ছবি ও শরীরে আঘাত বা গুলির চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। চলমান কোটা আন্দোলতে সংঘাত, নাশকতা ও সহিংসতা ঘিরে ব্লকরেইড দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আর এই ব্লকরেইড এখন রাজধানীর রাতের নগরী এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে। কারণ যেদিন যে এলাকায় ব্লকরেইড দেয়া হয় সেদিন ওই এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক কাজ করে। অভিযোগ আছে, অভিযানে থাকা পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যরা অনেক সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন না। এমনিতেই যখন পুলিশ কারও বাসায় প্রবেশ করে তখন আতঙ্কে অনেকে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তার ওপর জিজ্ঞাসাবাদে একটু হেরফের হলেই আটক করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত, শিবিরের নেতাকর্মীরা আতঙ্কে বাড়িছাড়া। আতঙ্কের কারনে সন্ধার পর পাড়া মহল্লা ছোট ছোট দোকানগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। একটু রাত হলেওই রাজধানীর কোথাও কোন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকার বা খাবারের হোটেল খোলা পাওয়া যাচ্ছে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৪৩টি। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ২৮২২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
গতকাল সোমবার ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এডিসি কে এন রায় নিয়তি জানান, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত সহিংসতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৩টি। আর এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ডিএমপি গ্রেপ্তার করেছে ২৮২২ জনকে। গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমদ গতকাল ঢাকা এক সমাবেশে বলেন, ছাত্রদের ওপর যে মামলা হচ্ছে, মামলাটা হলো পুলিশের মামলাবাজি এবং মামলাবাজি হলো পুলিশের ব্যবসা। আপনারা এই ব্যবসা বন্ধ করুন। ছাত্র ছাত্রীদেরকে অযথা মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘর থেকে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে আসতেছেন। মোবাইলে কী ধারণ করা আছে না আছে; ৫ কোটি মানুষের মোবাইলে আপনি এই আন্দোলনের ছবি পাবেন। ৫ কোটি মানুষকে আপনি জেলে দিবেন। জেল বড় করেন। কারণ মোবাইল চেক করলে সবার মোবাইলে আপনারা আন্দোলনের চিত্র দেখবেন।
স্থানীয়রা জানান, সহিংসতা চলাকালে অনেক শিক্ষার্থী তাদের বাড়ি যেতে পারেনি। পরিস্থিতির কারণে মেসেই থাকতে হয়েছে। পুলিশ মেসে মেসে তল্লাশি চালানোয় আতঙ্ক আরও বাড়ছে। কখন যে পুলিশ আসে এ আতঙ্কে অনেকে বাসা থেকেই বের হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অপারেশন) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, নাশকতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককেই যাচাই-বাছাই শেষে গ্রেফতার করা হচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশে চিরুনি অভিযান অব্যাহত থাকবে। তল্লাশিকালে যাচাই-বাছাই করছে পুলিশ। যারা দোষী কেবল তাদেরই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, শনিবার রাতে বিজিবি’র সহযোগিতায় পুলিশ আজিমপুর কোয়ার্টার এলাকায় ব্লকরেইড দিয়েছে। শুরুতেই ওই এলাকার প্রত্যেকটি প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তা ঘিরে ফেলে তারা। তারপর একে একে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গিয়ে অভিযান চালায়। সংঘাত সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এমন সাধারণ মানুষরাও ভয়ের মধ্যে ছিলেন। এলাকাবাসী বলেন, শনিবার রাতের ব্লকরেইডে অনেককে আটক করা হয়েছে। শামসুল আলম নামের এক বাসিন্দা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক গাড়ি এলাকায় যখন প্রবেশ করে তখন সবাই ভয়ে বাসার ভেতরে অবস্থান করে। বাইরে যারা ছিল তাদের কড়া জেরার মধ্যে পড়তে হয়েছে। অনেককে হেনস্তা করা হয়েছে। তারপর তারা অনেক বাসায় গিয়ে অভিযান চালায়।
এদিকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ অযথাই সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। রাস্তায় বা বাসায় অবস্থানের সময় যাদের মোবাইলে কোটা আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকেও আটক করা হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক যাদের সঙ্গে শত্রুতা রয়েছে তাদেরকে জামায়াত-শিবির হিসাবে পরিচয় দিয়ে গ্রেপ্তার করানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক নিরীহ ও সাধারণ মানুষও বিপদে পড়ে যাচ্ছেন।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ছাত্র পরিচয়টাই তাদের জন্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেস ছেড়েও তারা নিরাপদ নন। বাড়ি যাওয়ার পথে বাসে হচ্ছে তল্লাশি, মোবাইল ফোনে আন্দোলনের ছবি ভিডিও থাকলে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, এমনকি আটকও করা হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। আটক হওয়া থেকে বাঁচতে অনেকেই নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন বলে পরিচয় দিচ্ছেন, নিজের পরিচয়পত্রও লুকিয়ে রাখছেন। নিজেদের নিরাপদ রাখতে দ্রুত সময়ের মধ্যে মেস ছাড়ার নির্দেশ দেন বাড়ির মালিকরা। কারফিউ থাকায় বাড়িতে যেতে না পারায় অনেকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছে থাকছেন। নারী শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কে আছেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্যাংকিং সেবা খাতে এখনো ভারতীয় আধিপত্য
পরিষ্কার বার্তা চায় জনগণ
অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ
কারাগারে এস কে সুর
‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’
ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে
অভি খালাস! তাহলে খুনী কে?
জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা টিকটক কিনছেন না মাস্ক
ধামরাইয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানায় ফের আবার ডাকাতির চেষ্টা
রাজউক জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন
দ্বিতীয় দিনের মতো অনশনে অব্যাহতি পাওয়া এসআইরা
বন্ধ বেক্সিমকো খুলে দেয়ার দাবিতে শ্রমিকদের মানববন্ধন
আধুনিক ডেটা ওয়্যারহাউজ স্থাপন করবে বিবিএস
পরিবারসহ জ্যাকব ও ছেলেসহ সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
প্রিন্স মামুনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন শুনানির নতুন তারিখ
সামাজিক ও আচরণ পরিবর্তনের বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান ইউজিসি’র
চুক্তিতে নিয়োগের দৌড়ে নওফেলের জালাল উদ্দিন চৌধুরী
পুলিশের চাকরি হারিয়ে ছিনতাইয়ে নামেন হাকিম
ভোটার তালিকা হালনাগাদে সহায়তা করবে ইউএনডিপি
সাকরাইনে মেতেছে পুরান ঢাকা