চট্টগ্রামের আওয়ামী দানবেরা অধরা
২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:১০ এএম
দীর্ঘদিন প্রবাসে নির্বাসনে থাকার পর দেশে ফিরে রাউজানের গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক মসজিদে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করতে যান বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মুছা। নামাজ শেষ হতেই মসজিদের ভেতরেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা, যারা সেই সময়কার এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী জুনুর অনুসারী। বিগত ১৬ ফেব্রুয়ারি অসংখ্য মুসল্লির সামনে প্রবাসী এই বিএনপি নেতাকে নির্মমভাবে খুনের পরও কেউ তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসার সাহস করেনি। আবার খুনের পর মামলাও নেয়নি পুলিশ। আদালতে মামলা হলেও তার কোনো তদন্ত হয়নি। কারণ আওয়ামী এমপি ফজলে করিমের ইশারা ছাড়া সেখানে ‘গাছের পাতাও নড়তো না’।
রাউজানের মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামে গত দেড় দশক এক দানবীয় শাসন কায়েম করে আওয়ামী লীগ। ওই সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী, এমপি, নেতা-পাতি নেতা নিজেদের রাজা মনে করতো। তাদের কথায় চলতো পুলিশসহ প্রশাসন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাসা, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জমি দখল ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা, গুম, শত শত নেতাকর্মীকে ঘরবাড়ি ছাড়া করে এসব দস্যুরা। দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে অপরাধের সব ঘাটের নিয়ন্ত্রণ ছিলো তাদের হাতে। মানুষকে জিম্মি করে এসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা নিজেদের আখের গোছান।
ভোটারবিহীন হাসিনা সরকারের মাফিয়াতন্ত্রের মন্ত্রী এমপিদের অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন এক গণবিপ্লবে পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন হয়, হাসিনা পালাতে বাধ্য হন। তবে স্বৈরাচারের পতনের পক্ষকাল পরেও তাদের দোসর এসব দানবেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। অক্ষত থেকে যাচ্ছে লুটপাটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া দেশে-বিদেশে তাদের অর্থবিত্তের পাহাড়। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় থাকা অস্ত্র, গোলাবারুদের ভাণ্ডার অক্ষতই থেকে যাচ্ছে।
বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হুমকিতে দেশ ছাড়েন রাউজান পৌরসভার হাজীপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মুছা। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর পর অনেকটা গোপনে দেশে ফেরেন। পরদিন মা-বাবার কবর জেয়ারত করতে গ্রামের বাড়ি যান। আর সেখানে ফজলে করিম বাহিনীর হাতে খুন হয়ে লাশ হয়ে ফেরেন তিনি। বিগত দেড় দশকে রাউজানে ফজলে করিমের একচ্ছত্র আধিপত্য চলেছে। বিরোধী মতের কাউকেই থাকতে দেয়া হয়নি এলাকায়। যারা ছিলেন তাদের উপর চলেছে জুলুম নির্যাতন। কথায় কথায় লোকজনকে থানায় নিয়ে আটক করে মুক্তিপণ আদায় ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। রাউজানের মত রাঙ্গুনিয়াতেও দাপটের সাথে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বিরোধী দল বলে সেখানে কারও অস্তিত্বই ছিল না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছেন হাছান মাহমুদ ও তার পরিবারের সদস্যরা। রাঙ্গুনিয়াসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। দেশে-বিদেশে অনেক সম্পদের মালিক হাছান মাহমুদ ও তার পরিবারের সদস্যরা।
আনোয়ারায় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। লন্ডনে ধরা পড়েছে তার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। দেশ থেকে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার অনুসারী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যাডারদের কাছে জিম্মি ছিল সাধারণ মানুষ। সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী বিচ্ছুর অপকর্ম এখনও সবার মুখে মুখে। দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক এ আওয়ামী লীগ নেতা পটিয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে আওয়ামী লীগের একাংশও ছিল জিম্মি। বাঁশখালীর সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ও তার বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল বাঁশখালীবাসী।
সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আবু রেজা নদভী, সন্দ্বীপে মাহফুজুর রহমান মিতার বাহিনীর জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় দখলে নিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন নদভী। তার এই অপকর্মের অন্যতম সহযোগী ছিল সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মহাজোটের শরিক তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপট ছিল ফটিকছড়ি জুড়ে। মহানগরীতে নওফেলের ক্যাডার বাহিনীর টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, খুনোখুনি এবং ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারে কায়েম হয় ত্রাসের রাজত্ব। নওফেলের ক্যাডারদের দৌরাত্ম চলেছে মহানগর থেকে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত। সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে অপরাধের সকল ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেছে সরকারি দলের মন্ত্রী নেতাদের মদদপুষ্টরা।
ভোটারবিহীন নির্বাচনের মন্ত্রী এমপি ছাড়াও পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কথিত জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় ছিলেন স্বঘোষিত রাজা। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ছিল না কারও। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অস্ত্রহাতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে দেখা গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর গাড়িভর্তি অস্ত্র নিয়ে মুরাদপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করার ব্যবস্থা করে দেন। তার দলেল ক্যাডারেরা প্রকাশ্যে গুলি করে। ছাত্রলীগ যুবলীগের গুলিতে মুরাদপুর ও বহদ্দারহাটে ছয় জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় শত শত শিক্ষার্থী ও পথচারী।
সরকার পতনের পর এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একের পর এক মামলা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, নওফেলসহ পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, মেয়রসহ অনেকের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে। তবে এসব মামলায় এখনও পর্যন্ত কোন আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি। সরকার পতনের পর জনতার ধাওয়া খেয়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক এমপি এম এ লতিফকে হেফাজতে নেয় সেনাবাহিনী। পরে তাকে ডবলমুরিং থানার একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে বিমানবন্দর থেকে আটক করার গুজব শোনা গেলেও এর কোন সত্যতা এখনও পাওয়া যায়নি। বিগত ১৫ বছর মানুষের উপর জুলুমকারী আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, নেতারা এখনও আড়ালে থেকে গেছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া পুলিশ প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণে এসব অপরাধীরা অধরা থেকে যাচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে স্বৈরাচারী সরকারের দোসর, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জোরালো দাবি উঠছে না। কোথাও কোথাও বিএনপির কিছু নেতার বিরুদ্ধে এসব লুটেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। শনিবার মীরসরাইতে যুবলীগের শীর্ষ নেতা নিয়াজ মোরশেদ এলিটকে রক্ষায় তার বাড়িতে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার।
উত্তর জেলা বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ‘নগদ’র মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাটকারী এবং বিগত সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের জুলুম নির্যাতনের অন্যতম অর্থ জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত ওই এলিটকে রক্ষায় তার বাড়িতে যান গোলাম আকবর। আর তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে তাকে ঘেরাও করে রাখেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। পরে সেনাবাহিনী কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সেখান থেকে রক্ষা পান ওই বিএনপি নেতা।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন
দীর্ঘদিন পর প্রিয় দেশে ফেরার ঘোষনায় খুশির জোয়ারে ভাসছে মুরাদনগর উপজেলায়
ঢাবি ও বণিক বার্তার যৌথ আয়োজনে ৮ম নন-ফিকশন বইমেলা শুরু আগামীকাল
মঠবাড়িয়ায় মালয়শিয়া প্রবাসীর ঘরে ডাকাতি, বৃদ্ধাসহ ৩ নারী আহত
টুইটার থেকে এক্স ,ইলন মাস্কের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন যুগ
বিপুল পরিমাণ গাঁজা, ট্রাক ও ধানসহ নকলার মাদক কারবারিকে ফুলপুরে আটক
বিপিএলে অনিশ্চিত সাকিব নাম লেখালেন পিএসএলে
আলফাডাঙ্গায় চলছে হালি পেঁয়াজ লাগানোর মহোৎসব, শ্রমিকের অভাবে বাড়ছে চাষির খরচ
শ্রীনগরে পুকুর থেকে ভাসমান বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার
কলকাতায় দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা চিন্ময়ের আইনজীবী এবার জাতিসংঘে যাওয়ার হুমকি দিলেন
রোববার হারিছ চৌধুরীর পুনর্দাফন
চলছে বিক্ষোভ, তারেক রহমানকে স্মারকলিপি, জবির অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ
চীনে তৈরি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ
কোহলির আরও বড় শাস্তি প্রাপ্য ছিল: পন্টিং
বান্দরবানে আগুন দিয়ে ১৭ ঘর পুড়ে দেয়ার সাথে জড়িত দের ছাড় দেয়া হবে না- পার্বত্য উপদেষ্টা
জাহাজ সেভেন মার্ডারের খুনি ধর্মান্তরিত ইরফানের অজানা কাহিনী
খুলনার তাবলীগ মসজিদ এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল
দেশে কি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে? জামায়াত আমীরের প্রশ্ন
ভারতে ইসকন মন্দিরে চিন্ময়ের আইনজীবীর বৈঠক
নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের আইনগত কোনো বাধা নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল