সামিট গ্রুপের আজিজের খুঁটি কে?
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
শেখ হাসিনা পালনোর পর রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। কারো ব্যাংক হিসেব তলব, কারো ব্যাংক হিসেব জব্দ করা হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু শেখ হাসিনার অনুকম্পায় বিদ্যুৎ সেক্টর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়া সামিটের মালিক আবদুল আজিজ খান। তিনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। প্রশ্ন হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনে সামিটের গ্রুপের মালিক আবদুল আজিজ খানের খুঁটি কে? দেশে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলছে। সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাংবাদিক, সাবেক বিচারপতি, পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা কেউ বাদ যাচ্ছেন না। কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। কেউ এমনিতেই গ্রেফতার হচ্ছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম কেবল সামিটের আবদুল আজিজ। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের শরীক সামিটের আজিজের গায়ে পরিবর্তনের কোনো হাওয়াই লাগছে না? শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব খাতে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে তার মধ্যে বিদ্যুৎ খাত অন্যতম। এর নেতৃত্বে ছিল সামিট গ্রুপ। কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ক্যাপাসিটি চার্য বাবদ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের নামে হাজার কোটি টাকা পাচারসহ টেন্ডার ছাড়া জ্বালানি অবকাঠামো খাতে বড় বড় প্রকল্পের অনুমোদন বাগিয়ে নেয় সামিট।
অথচ সামিটের কর্ণধার আজিজ খান ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার খুঁটির জোর কথায়? প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে সামিটের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল বন্ধের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে। তার পরও ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং বিপুল লোকসানের জন্য বিশ্লেষকরা আওয়ামী লীগ সরকারের অপরিকল্পিত উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও দায়মুক্তি আইনের আড়ালে দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা প্রদানকে দায়ী করেন। পাশাপাশি ওই সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ ঊর্ধ্বতন মহলের দুর্নীতি এ খাতকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করেন তারা। দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতিকে পুঁজি করে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ বিধান পাস করা হয় ২০১০ সালে। এই আইনে টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এর পর দেশের ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ চাহিদার অবাস্তব প্রাক্কলন করে একের পর এক ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রয়োজন না থাকলেও অনেক প্রকল্প দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাকসহ প্রায় দুই ডজন সংসদ সদস্য সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা প্রকল্পের কাজ পান। সামিট, ইউনাইটেড পাওয়ার, বাংলাক্যাট, মোহাম্মদী গ্রুপ, ডরিন, বারাক, সিনহাসহ বেশ কিছু কোম্পানি একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে। যদিও এত বেশি কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ফলে অনেক কেন্দ্রই নামমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শত শত কোটি টাকা আয় করে।সামিট গ্রুপের ব্যবসা মূলত বাংলাদেশ কেন্দ্রিক হলেও গ্রুপটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর হোল্ডিং কোম্পানি ‘সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল’ নিবন্ধিত হয়েছে সিঙ্গাপুরে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের বড় অংশই দেশের কাজে আসেনি এবং এই বিদেশি নিবন্ধন থাকার কারণে টাকা পাচারের সুযোগও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ক্রেতা প্রধানত সরকার। ফলে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে কোনো দায় তাদের ছিল না। কেবল সরকারকে খুশি করেই ব্যবসা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে তারা। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি এখন আর্থিক সংকটে সামিটের মতো বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান (আইপিপি)গুলোর পাওনা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশি বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট স্থাপিত সক্ষমতার প্রায় ২১ শতাংশই সামিটের। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা রয়েছে ২০টি। যার সক্ষমতা প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট। দেখা গেছে, চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর অনুমতি দিয়েছে সরকার। ফলে গত ১৫ বছর বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্য বাবদ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কেবল সামিট গ্রুপকে ৪ হাজার ৪০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে, যা এ সময়ের মধ্যে পরিশোধিত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের প্রায় ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আঞ্চলিক ফাইবার অপটিকস কেবলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতকে যুক্ত করেছে সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে সাবমেরিন কেবল স্থাপনের বিষয়টিও এখন প্রক্রিয়াধীন। কোম্পানিটির সাবসিডিয়ারি সামিট টাওয়ার্স লিমিটেডের মাধ্যমে দেশের টেলিকম খাতের টাওয়ার শেয়ারিং ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছে সামিট গ্রুপ। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের (এসএপিএল) মাধ্যমে বন্দর ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় অফ-ডক (অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল) ফ্যাসিলিটিগুলোর অন্যতম। তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি দেশের রপ্তানি পণ্যের কনটেইনারের ২০ শতাংশ এবং আমদানি পণ্যের কনটেইনারের ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ হ্যান্ডলিং করে। মুন্সীগঞ্জে এসএপিএলের গড়ে তোলা মুক্তারপুর টার্মিনাল দেশে বেসরকারি খাতের প্রথম অভ্যন্তরীণ নৌ-টার্মিনাল ফ্যাসিলিটি। কোম্পানিটির একটি সাবসিডিয়ারি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ইস্ট গেটওয়ে (আই) প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা বন্দরের জেটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া কোম্পানিটির সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাবসিডিয়ারি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট পিটিই লিমিটেড আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁ করে। চট্টগ্রাম, মুক্তারপুর ও কলকাতার বন্দর ব্যবসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করে এ সাবসিডিয়ারি। ভারতের পাটনায়ও একটি বন্দর উন্নয়নের কাজ পেয়েছে সামিট, যা এখন নির্মাণাধীন। আবাসন খাতের ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট রয়েছে সামিট গ্রুপ। ঢাকায় ৩২ লাখ বর্গফুট স্পেস নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গ্রুপটি। পাঁচ তারকা ও চার তারকা হোটেল নির্মাণের কাজও করেছে তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের কাজ করেছে সামিট টেকনোপলিস লিমিটেড। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) চুক্তি করে সামিট। এছাড়া ফিনল্যান্ডভিত্তিক ওয়ার্টসিলার সঙ্গে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে সামিট। বর্তমানে জেরা, জিই, মিৎসুবিশি ও তাইয়ো ইন্স্যুরেন্স সামিটের ইক্যুইটি হোল্ডার্স হিসেবে রয়েছে।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থনৈতিকখাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত সরকারের আমলে জ্বালানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে হওয়া চুক্তি খতিয়ে দেখা হবে। সব ধরনের চুক্তি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলোর মূল চুক্তির কাগজ চাওয়া হবে এবং খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক চাপে সরকারি কর্মকর্তারা সঠিক তথ্য দিতে অসহায় ছিলেন। ফলে তারা বাধ্য হয়েই যেকোনো সরকারি প্রাক্কলন করতেন। যারা ভয়ে বা চাপে এতদিন সঠিক তথ্য দিতে পারেননি তাদের বলা হয়েছে এখন সময় এসেছে সেটি কাজে লাগান।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ছবি সরিয়ে ফেললেন ভারতের সেনাপ্রধান
বরিশাল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন এন্ড অ্যলায়েড সায়েন্সেস চিকিৎসা সেবায় ব্যাপক অবদান রাখছে
হাসিনাকে নিয়ে ‘সম্ভাব্য ঝুঁকি’তে সচেতন ছিলেন না টিউলিপ এটি ‘দুঃখজনক’ : লরি ম্যাগনাস
শেখ পরিবার একটি চোরের কারখানা’
অব্যাহতি পাওয়া এসআইদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতা মামুন
জিমি কার্টারের প্রতি ৩০ দিনের শোকাবস্থা উপেক্ষা করে ট্রাম্পের পতাকা উত্তোলন
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা: খালেদা-তারেকসহ সব আসামি খালাস
টিউলিপের জায়গায় নিয়োগ পেলেন এমা রেনল্ডস
পদত্যাগপত্রে টিউলিপ সিদ্দিক যা লিখেছেন
টিউলিপের পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেস উইংয়ের বিবৃতি
আজ বায়ুদূষণের শীর্ষে কায়রো, ঢাকার অবস্থান ৬ নম্বরে
মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে লাশ হলো "মা"!
মীরসরাইয়ে মুন্না খুনের ঘটনায়, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক বহিষ্কার
দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন গ্রেফতার
আজ সারদায় ৪৮০ এসআইয়ের সমাপনী কুচকাওয়াজ
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি, মানবিক সংকট চরমে
ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেফতার
সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন রিসোর্ট পুড়ে ছাই
শুল্ক রেলস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি
শুল্ক–কর বৃদ্ধির ফলে দেশের তামাক খাতে কী প্রভাব পড়বে