ঢাকা   রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৭ আশ্বিন ১৪৩১
খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার সার

বিএডিসির উদাসীনতায় ভেজা ও নষ্ট সার শুকিয়ে ঢুকছে গুদামে

Daily Inqilab অভয়নগর(যশোর) উপজেলা সংবাদদাতা

২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশে সারের চাহিদার সামঞ্জস্য না রেখে অতিরিক্ত সার আমদানি করার জন্য বিএডিসির প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণ নন-ইউরিয়া সার। সারে চাহিদা মূলত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত। কিন্তু বিএডিসির সার সারা বছর ধরে আমদানি করে থাকে। একদিকে যেমন বিএডিসির গুদামজাত করণে স্বল্পতা ও অদক্ষ পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগের কারণে বিপুল পরিমাণ সার নষ্ট হচ্ছে। সারাবছর খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি করপোরেশনের (বিএডিসি) আমদানিকৃত লাখ লাখ বস্তা নন-ইউরিয়া সার। আসন্ন বোরো মৌসুম সামনে রেখে ওই সার শুকিয়ে ক্রাশিং করে ফের নতুন বস্তায় ভরে বিএডিসি গুদামে পাঠাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদাররা। অপেক্ষাকৃত গুণাগুন নষ্ট হওয়া ওই সার কিনে কৃষক প্রতারিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে দায়িত্বরতদের বছরের পর বছর রয়েছে উদাসীনতা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরজুড়েই দেশের চাহিদা অনুযায়ী ৬০ ভাগ সার যশোরের অভয়নগরের বাণিজ্য শহর নওয়াপাড়া থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমদানী ও সরবাহরাহ করা হয়। দেশের নওয়াপাড়া, খুলনা ৭নং ঘাট, মুক্তারপুর, আশুগঞ্জ ঘাটে খোলা আকাশের নিচে নামমাত্র তাঁবু টাঙিয়ে এসব সার রাখতে দেখা যায়। গত বছর ডলার সঙ্কটের মধ্যেও বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করা সার এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে পড়ে রয়েছে।

একটি সূত্র বলছে, মুক্তারপুরের আমান ঘাটে এখনো প্রায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ বস্তা ডিএপি সার পানিতে ভিজে-গলে মানহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। যার আমদানি মূল্য ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা হতে পারে। দেশে ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার ওই সারে বিপুল অর্থ ভর্তুকি গুনছে। কিন্তু বিএডিসি কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের গাফিলতিতে ভালো সার নিম্নমানে নেমেছে, যা কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্থ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ভেজা সারের বস্তা শ্রমিকরা রোদে দিয়ে শুকাচ্ছেন। আর যেসব বস্তা পুরোপুরি ভিজে সার নরম হয়ে গেছে। সেসব বস্তা থেকে সার ঢেলে শুকিয়ে দলা বাঁধিয়ে তারপর আবার ক্রাশিং করে নতুন বস্তায় রি-প্যাকিং করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন সারও মেশানো হচ্ছে। এরপর আশপাশের বিএডিসি গুদামে সরবরাহ করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএডিসির আমদানি করা ওই সারের শীপ ব্রোকার ও পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে ‘মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কয়েক মাস আগে সার ভিজে যাওয়ার ঘটনা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন বিএডিসির জিএম আজিম উদ্দিন, ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন, মুভমেন্ট ম্যানেজার নোমান উদ্দিন, যুগ্ম-পরিচালক কামাল উদ্দিন। প্রাথমিকভাবে সার পরিবহন ঠিকাদারের দায়িত্বহীনতার কারণে সরকারের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হলেও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। গুঞ্জন রয়েছে, সংস্থাটির শীর্ষপদের এক কর্মকর্তা ও তৎকালীন সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদের হস্তক্ষেপে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এমনকি ঊর্ধ্বতনদের ইশারায় বিএডিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ অফিসার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিশেষ কারণে মানহীন সার গুদামে ঢোকাতে বিধি নিষেধ দিতে পারেননি। সরকারি আইন অনুযায়ী, সার সুষ্ঠুভাবে গুদামে পৌঁছে দিতে না পারলে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদারের কাছ থেকে আমদানিমূল্য আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে এসব ঘটনায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিএডিসি কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ ফর্মুলায় তুষ্ট রেখে নষ্ট সার গুদামে পৌঁছে দিয়ে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্থ করছে। কয়েকটি জেলায় বিগত কয়েক মাসের বরাদ্দের বিপরীতে গুদাম থেকে মানহীন সার ডিলারদের সরবরাহ করলে কৃষক পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। কৃষক ও ডিলাররা এই সারের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পাননি প্রতিকার।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই সার বিএডিসির মেড্ডা গোডাউন থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও এমন অভিযোগ পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন। যশোরের কেশবপুর উপজেলার মাধবপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, প্রতি মৌসুমে যখনই সারের প্রয়োজন হয় ঠিক সেই মুহূর্তে স্থানীয় ডিলার পয়েন্টে চাহিদা মোতাবেক সার সরবরাহ থাকে না। গেল মৌসুমে বস্তায় ২০০ টাকা বেশি দিয়ে সার কিনতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও প্রচুর চাহিদার ওই সময়ে ভেজা ও জমাটবাঁধা সার কিনতে বাধ্য হতে হয়।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় আরেকজন কৃষক আতাউর রহমান বলেন, সারের ত্রুটি ধরতে গেলে স্থানীয় ডিলার মালিকরা বলে থাকেন- গুদাম থেকে যা পেয়েছি তাই বিক্রি করছি। পছন্দ হলে কেনেন, না হলে রেখে যান। এতে বাধ্য হয়েই জমাটবাঁধা সার কিনতে বাধ্য হই। এ ধরনের সার ব্যবহার করে ঠিকমতো ফসলের হিসাবও মেলে না। অভয়নগরের বিসিআইসি ডিলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, ‘গত মৌসুমে স্থানীয় গোডাউনগুলো থেকে ভেজার কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া নিম্নমানের ডিএপি সার সরবরাহ করা হয়। যার কারণে বরাদ্দের সব সার উত্তোলন করিনি। যা উত্তোলন করেছি তা কৃষক না কেনার কারণে স্থানীয় মৎস্য খামারিদের কাছে অল্প মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি।

সার ভেজা প্রসঙ্গে এক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। এদিকে, সারের গুণাগুণ নষ্টের জন্য বিএডিসিকে দায়ী করছেন কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, সারাদেশের বিএডিসি গুদামগুলোর ধারণ ক্ষমতা দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। অথচ প্রতিবছর বিএডিসি আমদানি করে ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন। ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত আমদানি করার কারণে সময়মতো সার পৌঁছে দিলেও গুদামে জায়গার অভাবে তারা বুঝে নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে খোলা আকাশের নিচে তাঁবু টাঙিয়ে মজুদ রাখতে বাধ্য হয় ঠিকাদাররা। যদিও বিএডিসির যোগসাজশে কিছু অদক্ষ ঠিকাদার পরিবহনের কাজ নিয়ে ওই সার কালোবাজারে বিক্রির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার নজির রয়েছে। গত বছর বঙ্গ ট্রেডার্স নামে একটি পরিবহন ঠিকাদারের কাছে থাকা প্রায় ২০ লাখ বস্তা ডিএপি সার ভিজে নষ্ট হয়। তুলনামূলক মানহীন ওই সার রোদে শুকিয়ে ভালো সারের সঙ্গে মিশিয়ে বিএডিসি গুদামে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। এখনো বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের সার গুদামে পাঠানো হচ্ছে।

বিগত বছর গুলোতে দেখা গেছে সার আত্নসাতের ঘটনায় জড়িত ছিল প্রোটন ট্রেডার্স, কুষ্টিয়া ট্রেডার্স, নবাব এন্ড কোং, কেএন এন্টার প্রাইজএর মত অনেক বিএডিসি পরিবহন ঠিকাদার এখনো লক্ষ লক্ষ বস্তা পঁচা গলা সার মুক্তাপুর ঘাটে পড়ে রয়েছে। দেশের বিাভন্ন এলাকার গুদাম রক্ষকদের সাথে রফা দফা করে ওই সার বিএডিসিকে বুঝে দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (সার) মো. আজিম উদ্দিন ও ব্যবস্থাপক (বিক্রয়) মো. কবিরুল হাসান এর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি।

সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ব্যবস্থাপক (সংরক্ষণ) কানিজ ফারজানা সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমাদের সার রাখার জন্য পর্যাপ্ত গুদাম আছে। বাইরে যেগুলো আছে তা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

দেশে সংস্কার  ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ

যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ

ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১

ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১

ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী

ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ