ছাত্রলীগ পুনর্বাসন প্রকল্প!
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের অবস্থা সে রকমই। ‘কাকের লেজে ময়ূরপালক লাগালেও কাক ময়ূর হয় না’ ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার ছাত্রলীগের মনস্টার নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। হাসিনা রেজিমের অনেক মন্ত্রী এমপি কারাগারে, অনেকেই পালিয়ে গেছেন, কেউ কেউ আত্মগোপন করে রয়েছেন; কিন্তু ছাত্রলীগে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি। দলটির বড় নেতারা পালালেও ছাত্র সংগঠনটির মধ্যম সারির নেতা-উপনেতা-পাতিনেতারা রয়ে গেছেন সেই আগের মতোই বেপরোয়া। ছাত্রলীগ নেতাদের পুনর্বাসন ও সেল্টার দিচ্ছেন ১৫ বছর বঞ্ছিত ও নির্যাতিত দলগুলোর কিছু ব্যাক্তি।
হাসিনা পালালেও ছাত্রলীগ এখনো দমে যায়নি। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বাহাদুর শাহ পার্কে নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকান্ড প্রমাণ দেয় সংগঠনের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও রয়েছেন আগের মতোই। মাঝখানের এই একযুগে হাসিনা রেজিমে ছাত্রলীগ ফ্যাংকেস্টাইন কায়দায় যেভাবে মানুষ খুন আর একের পর এক অপরাধকান্ড করেছে তা সংগঠনটিকে মানবতাবিরোধী সংঘঠন হিসেবে প্রমাণ দেয়। এমনকি শেখ হাসিনার মতো কর্তৃত্ববাদী মনস্টার নেত্রী ছাত্রলীগের ধারাবাহিক অপরাধকান্ডে বিরক্ত হয়ে সংগঠনটির উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার পালানোর পর আওয়ামী লীগের নেতারা দৌঁড়ের ওপর থাকলেও ছাত্রলীগকে এখন পুনর্বাসনের প্রতিযোগিতা চলছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এবং প্রশাসনযন্ত্রের কিছু দায়িত্বশীল ব্যাক্তি প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে সাবেক ছাত্রলীগ কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ সচিবালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন সাংবাদিকরা জানান, বিএনপির ১৭ বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্রজনতার অভ্যূত্থানে হাসিনার পতন হলেও প্রশাসনে চলছে ভিন্ন স্রোত। ‘প্রশাসনে বদলি, প্রমোশন, নিয়োগের চিত্র দেখে কেউ কেউ নাকি স্লোগান দিচ্ছেন ‘আওয়ামী লীগ-জামায়াত ভাই ভাই/ বিএনপির খাওয়া নাই’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হয়েছে প্রশাসনে কেউ কেউ নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে মোবাইল চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পৈচাসিক কায়দায় নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হলে ছাত্ররা হত্যাকান্ডে জড়িত ৬ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। দেখা যায় আটক ৬ ছাত্রের মধ্যে ৫ জন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মী ও একজন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কর্মী। এর আগে ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে আক্রমন করে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে হত্যা ও আহত করলে ছাত্ররা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খুলে দেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাত্রছাড়া বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। পাশাপাশি বিগত ১৫ বছর দলদারিত্ব করা ছাত্রলীগ মুক্ত হল ঘোষণা করে। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেনের হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতারা কিভাবে হলে যায়গা পেল? ছাত্রলীগের এই গুণ্ডাদের কারা ফের হলে পুনর্বাসন করলো? জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আরো দুটি পৈচাসিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেগুলো প্রায় একই সুত্রে গাঁথা। অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করতেই কি এমন ঘটনা ঘটানো হচ্ছে? এর মধ্যেই খবরে বের হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেট সভায় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. নিয়াজ আহমেদ খান ভিসি হিসেবে যোগদানের পর ১৮ সদস্যের সিণ্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও এ সিদ্ধান্তে পরিস্কার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতারা পৈচাসিক ভাবে হত্যার পর সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ওঠে।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কারণ শিক্ষার্থীরই সেখানে ছাত্ররাজনীতি চাচ্ছেন না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নেপথ্যের কারণ কি ছাত্রলীগ? তারা হলে ফিরতে পারছে না এবং রাজনীতি করতে পারছে না বলেই কি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হচ্ছে? আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ দীর্ঘ ১৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দখল করে রেখেছিল। হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের জুলুম নির্যাতনের কাহিনী গণমাধ্যমে বহুবার ছাপা হয়েছে। ভিসি-প্রভিসিকে কৃতদাস বানিয়ে নিজেরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চালিয়েছে। ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছের পাতাও নড়তো না। কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সশস্ত্র ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের শিক্ষা দেয়ার ঘোষণা দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করে ক্যাম্পাস রক্তাক্ত করে। অতপর সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে ছাত্রলীগ পালিয়ে যায় এবং ক্যাম্পাস ও হলছাড়া হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ পলাতক এবং ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছে না এ কারণে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিণ্ডিকেট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সিণ্ডিকেটের ১৮ সদস্যের দুই তৃতীয়াংশ আওয়ামী লীগ অনুসারি।
হত্যা, ধর্ষন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সিট বাণিজ্য, ঠিকাদারি বাণিজ্য এমন কোনো কাণ্ড নেই যে ছাত্রলীগ ১৫ বছর করেনি। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর টিএসসি এক আলোচনা সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘বিসিএসে তোমরা লিখিত পরীক্ষাটা ভালো করে দাও, বাকি ভাইভা পরীক্ষাটা আমরা দেখবো। তোমাদের মধ্য থেকে যারা চাকরি করতে চাও, আমি প্রয়োজনে কোচিং ক্লাস নিতে রাজি আছি, তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তারপরে আমরা দেখব। যাদের বয়স হয়েছে, যারা চাকরির বাইরে অন্য কিছু করতে করতে চায় বা যাদের চাকরির বয়স নেই, তাদের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ আরো ব্যবস্থা রয়েছে।’ অতপর বিএসএস থেকে শুরু করে সরকারি চাকরি মানেই ছাত্রলীগ। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরির পরীক্ষায় ভাল করলেও পুলিশী তদন্তে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরি থেকে বঞ্ছিত করা হয়। জুলাই-আগষ্টে ছাত্রগণআন্দোলনে সময় পুলিশ প্রশাসনের যারা গুলি করে ছাত্রজনতা হত্যা করেছে তাদের প্রায় সকলেই সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পুলিশ প্রশাসনের যারা চাকরিতে যোগদান না করে পালিয়েছেন তাদের সবাই সাবেক ছাত্রলীগ।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নানা প্রক্রিয়ায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সচিব, ডিসি, এমপি পদে প্রমোশন, পদায়ন, গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রভিসি নিয়োগ, বিভিন্ন ব্যাংক কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, প্রধান উপদেস্টা কার্যালয়সহ বিভিন্ন সেক্টর, কর্পোরেশন, একাডেমি এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কার কমিশনেও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সুশীল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আমলাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ জন্য অনেকেই বলছেন, হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও দেশে এখন চলছে সাবেক ছাত্রলীগ এবং বর্তমান ছাত্রলীগ পুনর্বাসন প্রকল্প।
হুমায়ূন আহমেদের একটি রম্য নাটকে চাকরি প্রকল্প নামের একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছে। প্রতারণামূলক ওই দৃশ্যে ‘এখানে চাকরি দেয়া হয়’ ব্যানার টানিয়ে টেবিল চেয়ার পেতে বসে আছেন দু’জন। চাকরি প্রার্থীরা এলে তাদের পরীক্ষা নেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ প্রতারক চক্রকে ধরতে এলে নিয়োগ কর্তা ও চাকরি প্রত্যাশিরা পরিমরি করে দৌঁড়ে পালানোর চেস্টা করেন। বর্তমানে যা চলছে তা হুমায়ূনের নাটকের মতো দৃশ্য নয়। হাসিনার অনুগত ছাত্রলীগ একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়েই যাচ্ছে; অন্যদিকে ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের প্রশাসনে প্রমোশন, গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর যেন মহোৎসব চলছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ