শূন্য+শূন্য+শূন্য=শূন্য
১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত এবারের জলবায়ু সম্মেলন দরিদ্র দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মূলত এবারের সম্মেলনে দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থায়নের বিষয়টি আলোচ্য সূচির শীর্ষে রয়েছে। এ সম্মেলন আগামী ২২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। জলবায়ু সংকটের ভুক্তভোগী দরিদ্র দেশগুলোকে আরও অর্থসহায়তা দেওয়ার পথ খুঁজে বের করাই এবারের সম্মেলনের মূল লক্ষ্য। তাই এ নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ জন্য উন্নত বিশ্ব কী পরিমাণ অর্থায়ন করে বা বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থ আদায় করতে পারে সেটাই মূখ্য বিষয়। তা ছাড়া বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ এবারে সম্মেলনের অপেক্ষা করছিল, যে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ট্রিলিয়ন ডলারের চাহিদার কতটা পূরণ করে তা দেখার জন্য। অন্যদিকে বছরের রেকর্ড উষ্ণায়ন, তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিমাত্রায় বরফ পড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আলোচনার ইস্যুগুলোতো ছিলই। তবে এ সম্মেলনে ইন্নতবিশ্বের অর্থ ছাড়েরর বিষয়টি নিয়ে শুরুতেই বেশ শঙ্কা দেয়। এবার কয়েকটি বড় অর্থনীতি এবং সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর ফলে এ সম্মেলনের সফলতা শুরুতেই প্রশ্নর মুখে পড়েছে।
সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ-২৯-এর ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি বক্তৃতা দেন। যে তত্ত্ব নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতদিন ধরে কথা বলে আসছিলেন, বাকু জলবায়ু সম্মেলনে সেই ‘থ্রি জিরো বা তিন শূন্য’ তত্ত্বকেই বড় করে তুলে ধরলেন তিনি। গত ১৩ নভেম্বর সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, এটাই এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে। গড়ে তুলবে এক নতুন পৃথিবী, যা সবার জন্য বাসযোগ্য হবে। এই পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের সবাইকে শুধু এমন এক জীবনশৈলী গ্রহণ করতে হবে, যা এই পৃথিবীকে সবার জন্য নিরাপদ করে তুলবে।
এবারের কপ-২৯ সম্মেলনে আলোচনার মূল বিষয় ছিল অর্থ। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির আওতায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০৩০ সালের মধ্যে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। এ লক্ষ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সামলাতে ২০২৫ সাল নাগাদ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থসহায়তা দিতে রাজি হয়েছিল বড় অর্থনীতির দেশগুলো। তবে এখন পর্যন্ত সেই সহায়তার পরিমাণ সন্তোষজনক নয়। আর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় থাকা বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণকারী চীন ও উপসাগরীয় দেশগুলো এই সহায়তা তহবিলে অর্থ দিচ্ছে না।
আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত গত কপ সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়েছিল, সেটিও এবার এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। তবে এটা কর্যকর করা কঠিন। কারণ, চলতি বছর জি-২০ সম্মেলনে কিছু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছে। আর সম্প্রতি কলম্বিয়ায় জাতিসংঘের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক আলোচনাও কোনো ঐকমত্য ছাড়া শেষ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর জলবায়ু নিয়ে নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আগামী ২০ জানুয়ারি তিনি ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। পরিবেশবান্ধব জ্বালানিকে তিনি বরাবরই একটি ‘প্রতারণা’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্যারিস চুক্তি থেকেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিতে চান। ফলে জলবায়ু সহায়তা তহবিলে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিস্থিতি যখন প্রতিবছরই আরও তীব্র আকার ধারণ করছে, তখন কপ সম্মেলন সফল করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, প্রতিবছর আমাদের পৃথিবী যে একটু একটু করে উষ্ণ হচ্ছে, তা থামাতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। তিনি বলেন, এ সম্মেলন কতটা সফল হলো বা ভ্যর্থ হলো বাংলাদেশের প্রাপ্তি কতটুকু এলো এসব বলার সময় এখনো আসেনি। তবে বাংলাদেশ চেষ্টা করেছে তার সর্বোচ্চ দাবিটা আদায় করতে।
সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত এবং উজ্জ্বল। তার উপস্থাপনও ছিল ব্যতিক্রম। পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করা ও বাসযোগ্য করে তুলতে তিনি যে অনেকের চেয়ে একটু অন্যভাবে ভাবেন, সে কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বহুদিনের সেই স্বপ্নের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তন ক্রমেই খারাপ হয়ে চলেছে। আমাদের সভ্যতা প্রবল ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেহেতু আমরা নিজেদের মূল্যবোধগুলো ক্রমাগত ধ্বংস করে চলেছি। এ থেকে পরিত্রাণে আমাদের বুদ্ধি, অর্থ ও যুবশক্তিকে একত্র করতে হবে, যাতে এক নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে। সে জন্য আমাদের গ্রহণ করতে হবে এক নতুন ধাঁচের জীবন, যাতে এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হয়। অর্থাৎ মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বণ নিঃসরণ শূন্যে নামাতে পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত ও বাসযোগ্য এক নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে।
ড. ইউনূসের এই তিন শূন্যের তথ্য বিশ্বের জন্য নি:সন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই তাত্ত্বিকতার চেয়ে বাস্তবতার আলোকে প্রাপ্যতাই যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, এবং সে কারণে বাকুতে বাংলাদেশ তার দাবি-দাওয়া কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছে সেটা বিবেচ্য। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একজন অভিজ্ঞ পরিবেশবাদী কর্মী। তিনি পরিবেশ উন্নয়নে দীর্ঘদিন যাবৎ লড়াই করছেন। তিনি সম্মেলনে যোগ না দিলেও যে টিম ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছে তা নি:সন্দেহে অনেক যোগ্য। নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববাসীর সামনে যে শূন্য থিওরি তুলে ধরেছেন তা সর্বত্রই আলোচিত। এ ছাড়া তার টিমও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা তুলে ধরেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে কথা বলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে বন্যার কারণে ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি তহবিল ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’, প্যারিস চুক্তির সবুজ জলবায়ু তহবিল এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে সব কিছুতেই প্রতিশ্রতি ছাড়া এখনো আর কিছুই মিলেনি। তাই পরিবেশবাদীরা অনেকেই বলছেন এবারের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক বেশি হলেও প্রপ্তি হয়েছে তিন শূন্যের যোগফল সমান শূন্য।
তবে এ নিয়ে এখনই আশাহত হওয়ার কিছু নেই। সম্মেলন আগামী ২২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। এখন দেখার বিষয় উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নশীলদের কতটা সাহায্য করবে? অতিরিক্ত নির্গমন কমানোর পাশাপাশি দেশগুলোর সামনে আরেকটি বড় আলোচনা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিণতি মোকাবিলা করতে এবং অর্থনীতিকে কার্বন নির্গমনমুক্ত করতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কতটা আর্থিক সহায়তা দেয়া উচিত, সে বিষয়ে একমত হওয়া। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে অবশ্য সময় লেগেছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তহবিলের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেয়া হয়েছে উচ্চ সুদে ঋণের আকারে। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত মনে করেন, আজারবাইজানের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা ২০০ বিলিয়ন থেকে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনে সম্মত হতে পারে। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনী দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি ন্যায্য আর্থিক চুক্তি হলে সেটা কার্যত সফলতা বয়ে আনতে পারে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কৃষক জামালের ক্ষেতে রঙিন ফুলকপি, উদ্বুদ্ধ হচ্ছে অন্য কৃষকরাও
জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার বাতিল
কুয়াশা ও তাপমাত্রা নিয়ে নতুন তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের
কলকাতায় প্রকাশ্যে মুরগির মাংস বিক্রি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত
ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় ফেনীতে সুদানের নাগরিক আটক
ক্ষমতা গ্রহণ করেই বাইডেন আমলের ৭৮ নির্বাহী আদেশ বাতিল ট্রাম্পের
পেকুয়ায় প্রাচীন খাল উদ্ধারে পদক্ষেপ জনমনে স্বস্তি
ঢাকার বাতাস ২৪৬ স্কোর নিয়ে আজ ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’
ট্রাম্প ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় জড়িত ১৫০০ জনকে ক্ষমা করলেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘সেকেন্ড লেডি’
গাজা একটি ‘বিশাল ধ্বংসস্তূপ’, পুনর্নির্মাণ করা প্রয়োজন: ট্রাম্প
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রথম পদক্ষেপ গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি: ডোনাল্ড ট্রাম্প
ট্রাম্পের শপথ : যোগ দেন চীনের হ্যান ঝেং ভারতের জয়শঙ্কর
সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
সত্যিই কি মারা গেছেন ম্যাশ? কি বলছে রিউমর স্ক্যানার?
সেই যুবকের বিরুদ্ধে ৯০০ টাকা চুরির মামলা
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা ট্রাম্পের
সাফারি পার্কের দেয়াল টপকে পালিয়ে গেল নীলগাই
জোকোভিচ-আলকারাজ হাইভোল্টেজ লড়াই আজ
বড় জয়ে পয়েন্ট টেবিলে দুই নম্বরে চিটাগাং